সোমবার, ১৫ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিশ্চিহ্নের পথে

ফুলপুর (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিশ্চিহ্নের পথে

ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নের ঠাকুরবাখাই-সরচাপুরঘাটে জঘন্যতম গণহত্যার স্মৃতিবিজড়িত একটি ঐতিহাসিক স্থান। একটি প্রভাবশালী মহল এটি নিশ্চিহ্নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা রাতে আঁধারে ওই স্থানে মাটি কেটে অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছে। সরেজমিন গিয়ে এসব চিত্র দেখা গেছে। এই স্থানের পাশে ফুলপুর ও হালুয়াঘাট এই দুটি  উপজেলার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে খরস্রোতা কংস নদী। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেখান দিয়ে সড়ক পথে সহজে হালুয়াঘাট হয়ে ভারতে যাওয়া যেত। মুক্তিযোদ্ধারাসহ সাধারণ মানুষ সেই সহজ পথটি ভারতে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করতেন। মানুষের যাতায়াতের সেই স্রোত থামানোর জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সরচাপুর গুদারাঘাটে একটি শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তোলে। সরচাপুর গুদারাঘাট থেকে ভারত সীমান্ত আনুমানিক ১৫-২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। তাই ওই ঘাঁটির সামরিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। সরচাপুর গুদারাঘাট দিয়ে বাস, ট্রাক, গরুর গাড়িসহ বিভিন্ন যানবাহন যাতায়াত করত। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা যাতায়াত করতেন। সেই জন্যই পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষ থেকে সরচাপুর গুদারাঘাটে শক্তিশালী চেকপোস্ট বসানো হয়। গুদারাঘাটের চেকপোস্টে বেশ কয়েকটি তল্লাশিতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ধরা পড়েন। পরে তাদের ওই ঘাটের কংস নদীর পাড়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এক সময় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর তৎপরতায় সরচাপুর গুদারাঘাট হয়ে ওঠে বিভীষিকাময়  নরক ঘাঁটি। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে এ দেশীয় দালাল ও রাজাকার বাহিনীর অপতৎপরতা। প্রতিদিন পড়ন্ত বিকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ওই জায়গায় শোনা যেত পাকিস্তানি বাহিনীর গুলির আওয়াজ। কত মানুষকে যে ওখানে হত্যা করা হয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। তবে এলাকাবাসী ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষকরা মনে করেন, সরচাপুর গুদারাঘাটে অন্তত পাঁচ থেকে ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সরচাপুর গুদারাঘাটের গুরুত্ব অপরিসীম। এখানের মাটি ও বাতাসের প্রতিটি পরতে পরতে রয়েছে নির্যাতিত মানুষের হাহাকার ও কান্নার আওয়াজ। বীরাঙ্গনা সুরবালা সিং, হালিমা, রাজিয়া, রাবিয়া, মানিক ডাক্তার, সুশান্ত চৌধুরী, কাজল রেখাদের অজস্র চোখের পানি গড়িয়েছে এই সরচাপুর গুদারাঘাট। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও নির্যাতনের বিরানভূমি হিসেবে এটি পরিচিত। এই গুদারাঘাটকে ঘিরে একটি বৃহত্তর যুদ্ধ হয়েছে; যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি স্মৃতিময় যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সেই স্মৃতিবিজড়িত স্থানকে নিশ্চিহ্ন করতে অপতৎপরতা চালিয়েছে একটি কুচক্রী মহল। তারা সরচাপুর গুদারাঘাটের ফুলপুর উপজেলার ঠাকুরবাখাই অংশে ভেকু দিয়ে ট্রাক ভরে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার মাটি বিক্রি করছে। কেউ প্রতিবাদ করলে তার ওপর নেমে আসে নির্যাতন। আবুল কাশেম নামে একজন বলেন, আমাদের চোখের সামনে দিয়ে এই সরচাপুর গুদারাঘাটের মাটি কেটে ধ্বংস করা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। এতে কষ্ট লাগে। প্রতিবাদ করলে তারা বলে যে, আমরা উপজেলা থেকে সরকারিভাবে ডেকে এনেছি। তাই এলাকার কেউ কোনো কিছু বলার সাহস করে না।

গত ১০ নভেম্বর বুধবার দুপুরে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়,  মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ফলকের কাছ থেকে ভেকু দিয়ে মাটি কাটা হচ্ছে। পরে জানতে চাইলে একজন জানান, এই ভেকুর মালিক ফুলপুর পৌরসভার দিউ গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য মোশাররফ হোসেন। স্থানীয় মিজানকে দিয়ে তিনি মাটি কাটান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, এখানে গুঁতাগুঁতি করে লাভ নেই। তারা সরকারি দলের লোক। ইউএনও সাহেবের কাছ থেকে নাকি অনুমতি নিয়ে মাটি কাটছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শীতেষ চন্দ্র সরকার বলেন, আমি মাটি কাটার কোনো অনুমতি দেইনি। মাটি কাটা বন্ধে এখনই ব্যবস্থা নিচ্ছি। পরে পুলিশ গিয়ে মাটি কাটা বন্ধ করে দেয়। তবে মাজারের পাশ থেকে নদীর খাসজমিতে মাটি কাটা অব্যাহত রয়েছে বলে সূত্র জানায়। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার শীতেষ চন্দ্র সরকার বলেন, নদী বা খাসজমি থেকে সরকারি ইজারা ছাড়া মাটি কাটার কোনো সুযোগ নেই। আর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। আবার যদি কেউ ওই স্থানে অবৈধভাবে মাটি কাটে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর