রবিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ধানে লোকসান, চায়ে স্বপ্ন

রেজাউল করিম মানিক, লালমনিরহাট

ধানে লোকসান, চায়ে স্বপ্ন

লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার তালুক দুলালী গ্রামের জামাল উদ্দিনের সংসার চলত চাষাবাদ করে। তিনি প্রধানত ধান, পাট আর সবজির আবাদ করলেও খরচ বাদ দিয়ে তেমন একটা লাভের মুখ দেখতেন না। তবে সেই দিন গত হয়েছে তার। এই কৃষকের আয় বাড়িয়ে দিয়েছে চা। নিভৃত পল্লীতে চা পাতার চাষ করে ভাগ্য বদলে গেছে তার। উপজেলার ভেলাবাড়ি ইউনিয়নের তালুক দুলালীর পাশাপাশি সারপুকুর  ইউনিয়নে কয়েক বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে পাশের গোড়ল গ্রামেও চায়ের আবাদ হচ্ছে।  গ্রামগুলোর বাসিন্দারা জানান, কয়েক বছর আগেও তাদের এলাকার বেশির ভাগ জমি খালি পড়ে থাকত। সেই দৃশ্যে পরিবর্তন আসে জেলার হাতীবান্ধার সোমার চা বাগান দেখে। ২০১৩ সালে তালুক দুলালী গ্রামে প্রায় চার একর জমিতে পরীক্ষামূলক চা চাষ শুরু হয়। সেখানে সফল হওয়ার পর পাশের আরও কয়েকটি এলাকায়ও ১২ একর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে চা পাতা উৎপাদন শুরু হয়। শেষে সোমা টি গার্ডেনের দেখানো পথে গ্রামগুলোর অনেকে ব্যক্তিগতভাবে চা চাষে নেমে পড়েন। জামাল উদ্দিন জানান, তিনি ২০১৭ সালে প্রথম তার পতিত জমিতে চা পাতার বাগান করেন। সেখান থেকে পরিকল্পনা করেন, তিনিও চা চাষ করবেন। পরে বুয়েটের শিক্ষকের সহযোগিতায় ২০১৮ সালে তিনি চা গাছের চারা এনে ৬০ শতাংশ জমিতে বাগান করেন। পরে এই বাগান ছড়িয়ে যায় আড়াই একরে। বাগান থেকে পাতা সংগ্রহের সময় কথা হয় জামাল উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘পঞ্চগড় থেকে দুটি পিকআপ ভ্যানে চা গাছের চারা এনে লাগিয়েছি। ওখানকার শ্রমিকরা চারা রোপণ করে দিয়ে গেছে। চারা, শ্রমিক, সার সব মিলিয়ে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। এখন বছরে চারবার পাতা সংগ্রহ করি। এ পর্যন্ত খরচ বাদে ৩ লাখ টাকা আয় করেছি। ১২০ শতক জমিতে চা বাগান আছে। আরও বাড়াব। চা চাষ সহজ ও ব্যয় কম। কোম্পানির গাড়ি বাগানে এসে চা পাতা কিনে নিয়ে যায়। এবার আড়াই হাজার কেজি পাতা পেয়েছি। প্রতি কেজি পাতা ২২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি।’ তালুক দুলালী গ্রামে গিয়ে কথা হয় গৃহবধূ হামিদা খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বাড়ির পাশে পরিত্যক্ত জাগায় চায়ের গাছ নাগাছি। সেই গাছের চা পাতা বেচে তেল-সাবানের খরচ বাদেও কিছু জমা করুছি।’ গোড়ল গ্রামে চায়ের গাছে সেচ দিচ্ছিলেন আবুল বাশার মুক্তা। তিনি জানান, চা চাষে কোনো ঝামেলা নেই। নেই বেশি পরিশ্রম। চা চাষ অত্যন্ত সহজ ও লাভজনক। যেসব জমিতে অন্য কোনো ফসল হয় না, সেখানে সহজে চায়ের চাষ করে লাভবান হওয়া যায়। প্রতিটি চা গাছ থেকে ২৫ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত পাতা পাওয়া যায়। খরচ বাদে প্রতি একরে চা চাষ করে বছরে ১ লাখ টাকার বেশি আয় করা যায়। কথা হয় ভেলাবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে। তিনি তালুক দুলালী গ্রামে নিজেদের চা বাগানে শ্রমিক দিয়ে পরিচর্যার কাজ তদারকি করছিলেন। তিনি বলেন, ‘তালুক দুলালী ও দুলালী গ্রামের লোকদের সহযোগিতায় আমরা ১৬ একর জমিতে চা চাষ করছি। সেই সঙ্গে ওই গ্রাম দুটির যারা চা চাষ করতে আগ্রহী ছিল, তাদের গাছের চারা এনে দিতে সহায়তা করেছি।’ মোহাম্মদ  আলী জানান, চারা লাগাতে ১৮ ইঞ্চি গভীর ও চারদিকে ১২ ইঞ্চি প্রস্থ করে গর্ত খুঁড়তে হয়। প্রতি গর্তে দুই কেজি পচা গোবর, ১০ গ্রাম টিএসপি, তিন গ্রাম পটাশ ও দুই গ্রাম দানাদার কীটনাশক দেওয়ার ১৫ দিন পর চারা লাগাতে হয়। গাছে বছরে পাঁচটি সেচ দিতে হয়। সব মিলিয়ে এক একর জমিতে চারা লাগাতে খরচ হয় ৬০ হাজার টাকা। দুই বছর পর থেকে চা পাতা সংগ্রহ করা যায়। বছরে এক একর জমিতে লাগানো গাছ থেকে ৮ হাজার কেজি চা পাতা পাওয়া যায়। এই চা পাতা কিনে নিয়ে যায় পঞ্চগড়ে অবস্থিত নর্থ বেঙ্গল সেন্ট্রাল টি ইন্ডাস্ট্রিজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। শুধু আদিতমারীতেই নয়, লালমনিরহাটের কালিগঞ্জ, হাতীবান্ধা, সদর ও পাটগ্রামে বেশ কিছু এলাকায় চাষ হচ্ছে চা। আর ধানের পরিবর্তে চা চাষ করে নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন এখানকার কৃষকরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর লালমনিরহাটের উপপরিচালক শামীম আশরাফ  বলেন, চা একটি জনপ্রিয় পানীয়। এর চাহিদা সর্বজনে। লালমনিরহাটের অনাবাদি ও পতিত  মাটিতে চা চাষ ভালো হচ্ছে। অন্য এলাকায় গাছ লাগানোর তিন বছর পর চা পাতা সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু লালমনিরহাটে চারা লাগানোর দুই বছরের মাথায় পাতা পাওয়া যাচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর