বুধবার, ৫ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

দখল-দূষণে হারিয়ে যাচ্ছে কুষ্টিয়ার আট নদী

আল-মামুন সাগর, কুষ্টিয়া

দখল-দূষণে হারিয়ে যাচ্ছে কুষ্টিয়ার আট নদী

দখল-দূষণে কুষ্টিয়া জেলার আটটি নদী হারিয়ে যেতে বসেছে। জেলার ছয়টি উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এসব নদী চরম অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। নদীর বেশির ভাগই পদ্মা-গড়াইর শাখা হলেও অবৈধ দখল, পলি পড়ে যাওয়া ও দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ার কারণে ভরা যৌবন হারিয়ে এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে প্রশাসনের নজরদারির অভাবে অনেক স্থানেই প্রভাবশালীরা নদীর বুকে পিলার দিয়ে নানা রকম স্থাপনা গড়ে তুলেছেন। জলাধার সংরক্ষণ আইন থাকলেও কেউ এই আইনের তোয়াক্কা করছেন না। নদ-নদী ও খাল-বিল দখল করে একের পর এক অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে। সরকারি হিসাব মতে, কুষ্টিয়া জেলায় নদ-নদী ও খাল ও বিল দখলকারীর সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার। নদ-নদী দখলের পাশাপাশি সমানতালে চলছে নদী দূষণের পাল্লা। কল-কারখানার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদ-নদীতে। কোথাও কোথাও ড্রেনের সংযোগ এমনকি মল-মূত্রও গিয়ে মিশছে নদীতে। জানা যায়, পদ্মা নদী দৌলতপুর থেকে শুরু করে খোকসা উপজেলার মাঝপাড়া পর্যন্ত প্রায় ৮০ কিলোমিটার বিস্তৃত। পদ্মা নদীর প্রধান শাখা গড়াই নদী ৫০ কিলোমিটার, গড়াই নদীর শাখা কালী নদী ছেঁউড়িয়া থেকে ৩৫ কিলোমিটার, সাগরখালী নদী ভেড়ামারা থেকে ১৫ কিলোমিটার এবং হিসনা নদী ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এক যুগ আগেও জেলার এসব নদ-নদীর যৌবন ছিল। কিন্তু কালের পরিক্রমায় দখল এবং দূষণের কারণে এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি নদীর এখন আর কোনো পানি প্রবাহ নেই। জেলার ভারত সীমান্ত উপজেলা লাগোয়া দৌলতপুরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে পদ্মা নদী থেকে উৎপত্তি হওয়া মাথাভাঙ্গা ও হিসনা নদী। কিন্তু দখল ও দূষণের কারণে এই নদী দুটি এখন চরম অস্তিত্ব¡ সংকটে। বর্ষা মৌসুমে নদী দুটির কোথাও কোথাও পানি দেখা গেলেও শুষ্ক মৌসুমে একেবারে মরা খালে পরিণত হয়। কোথাও কোথাও নদীর বুকে তামাক ও ধান চাষ করা হচ্ছে। ভেড়ামারা উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে চন্দনা নদী। পদ্মা নদী থেকে উৎপত্তি হওয়া এক সময়কার চন্দনা নদীর কোনো অস্তিত্ব¡¡ এখন আর চোখে পড়ে না। প্রভাবশালীদের দখলে চলে গেছে নদীর সিংহ ভাগ। মিরপুর উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সাগরখালী নদী। নদীটি এখন মৃতপ্রায়। বছর কয়েক আগে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে খনন করে নদীটি আবার সচল করার উদ্যোগ নিলেও তাতে কোনো সুফল মেলেনি। নদীর দীর্ঘ এলাকা এখন জলশূন্য। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে কুমার নদ। গড়াইয়ের শাখা এ নদটি এখন বিলীন হওয়ার পথে। বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে নদটিতে। ঝাউদিয়া ও বৈদ্যনাথপুর বাজার সংলগ্ন এলাকায় নদীর বড় অংশ দখল করে মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছে।

 কুমারখালী উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ডাকুয়া ও কালী নদী। দুটি নদী শুকিয়ে এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। খোকসা উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সিরাজপুর হাওর নদী। গড়াইর অন্যতম এ শাখা নদীটি শুকিয়ে গেছে বেশ কয়েক বছর আগেই। নদীর দুই অংশে দুটি কালভার্ট ও স্লুইসগেট অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ নির্মাণের ফলে নদী তার স্বাভাবিক অবস্থা হারিয়ে ফেলেছে। জেলা প্রশাসনের সূত্র জানায়, কুষ্টিয়ার নদ-নদী ও খালের বিভিন্ন জায়গায় অন্তত ৩ হাজার দখলদার রয়েছে। ফলে নদ-নদী ও খালের প্রবাহ এখন আর স্বাভাবিক নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসন পৃথকভাবে এসব দখলদারকে চিহ্নিত করেছে। জেলার ছয়টি উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়া কার্যালয় সরেজমিন পরিদর্শন করে এসব তালিকা  তৈরি করেছে। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) শাখার একটি সূত্রের দাবি কয়েক বছর আগের এই তালিকার বাইরে বর্তমানে দখলদারদের প্রকৃত সংখ্যা এখন আরও অনেক বেশি। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে পাওয়া দখলদারদের তালিকায় রয়েছে পদ্মা নদী, গড়াই নদী ও কয়েকটি বিল। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকায় এসব নদ-নদীর বাইরেও বেশি দখল করে আছে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের ছোট বড় খালগুলো। সবচেয়ে বেশি দখলদার রয়েছে ভেড়ামারার হিসনা নদীর। সেখানে নদী দখল করে পাকা দালানও করা হয়েছে। সরেজমিনে হিসনা নদী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নদীর উভয় পাড়ে বাড়ি ও দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। নদীর বুকে পানি না থাকায় কোনো কোনো জায়গায় ধান চাষ করা হয়েছে। দেখে বোঝার উপায় নেই এটা একটা নদী। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এক সময় হিসনা নদীতে বড় বড় ট্রলার চলেছে। নদীর বর্তমান অবস্থা দেখে সেই কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকা অনুযায়ী- পদ্মা নদী, গড়াই নদী ও সেচ প্রকল্পের ছোট বড় খাল দখল করে আছে অন্তত ২ হাজার ৯২১ জন দখলদার। বেশির ভাগই পাকা ও আধাপাকা টিনের বসতঘর। কোনো কোনো জায়গায় টিনের দোকান রয়েছে। জেলা প্রশাসক মো. সাইদুল ইসলাম জানান, নদ-নদী ও খাল দখলকারীদের তালিকা আমাদের কাছে রয়েছে।  যে কোনো উপায়ে নদ-নদী ও খালের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনীয় সব রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আফছার উদ্দিন জানান, জেলার বেশ কয়েকটি খাল সংকুচিত হয়ে গেছে। সেগুলো খনন করা প্রয়োজন। করোনার কারণে দীর্ঘদিন ধরে জেলায় উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ রয়েছে। এসব অবৈধ দখলদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সর্বশেষ খবর