শনিবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

চালবোঝাই ট্রাক গায়েব আতঙ্ক

৫ বছরে ৫০ ট্রাক উধাও

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি

চালবোঝাই ট্রাক গায়েব আতঙ্ক

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চালের মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরের চাল ব্যবসায়ীদের মধ্যে চালবোঝাই ট্রাক গায়েব আতঙ্ক পেয়ে বসেছে। একের পর এক মহাসড়ক থেকে চালবোঝাই ট্রাক উধাও হয়ে গেলেও প্রশাসন এর কোনো কূল-কিনারা করতে পারছে না। ব্যবসায়ীরা জানান, গত পাঁচ বছরে খাজানগর থেকে ৫০টির বেশি চালবোঝাই ট্রাক গায়েব হয়েছে। এসব ঘটনার মধ্যে পুলিশ প্রশাসন মাত্র তিন-চারটি ঘটনার রহস্য উদঘাটন করতে পেরেছে। মিল মালিকরা তিন থেকে চার দিন পর জানতে পারছেন তাদের ট্রাক উধাও হয়ে গেছে। এ অবস্থায় মাসের পর মাস এমন আতঙ্ক নিয়ে ব্যবসা করতে হচ্ছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চালের মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরের চাল ব্যবসায়ীদের। ট্রাক উধাওয়ের মতো ঘটনা ঘটে চললেও তা উদ্ধার হয় না বললেই চলে। গত তিন মাসে নূর অটো রাইস মিলের দুটি চালবোঝাই ট্রাক গায়েব হয়ে গেছে। এখনো যার কোনো কূল-কিনারা হয়নি। সর্বশেষ গত ৪ জানুয়ারি (মঙ্গলবার) মিল গেট থেকে একটি কাভার্ড ভ্যান চালবোঝাই করে নারায়ণগঞ্জ জেলার উদ্দেশে রওনা হয়। সাড়ে ৮ লাখ টাকার বাসমতি চাল ছিল সে ভ্যানে। মালিক চার দিন পর জানতে পারেন তার চাল যে ঠিকানায় পাঠানো হয়েছে সেই ঠিকানায় পৌঁছায়নি। এরপর তিনি দিশাহারা হয়ে পড়েন। থানায় অভিযোগ করেন, তবে এখনো চাল ও ট্রাকের কোনো হদিস পাননি তিনি। খাজানগরের ব্যবসায়ীরা জানান, গত পাঁচ বছরে এখান থেকে অন্তত ৫০টির বেশি চালবোঝাই ট্রাক উধাও হয়েছে। এর মধ্যে দুই থেকে তিনটি ট্রাকের হদিস মিললেও বাকিগুলোর কোনো কূল-কিনারা হয়নি। এ অবস্থায় খাজানগর মোকামের মিল মালিকরা আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে এ চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানিয়েছেন। নূর অটো রাইস মিলের মালিক আমিরুল ইসলাম জানান, গত তিন মাসের মধ্যে তার দুটি চালবোঝাই ট্রাক উধাও হয়ে গেছে। যার কোনো খোঁজ মেলেনি। আগের বার সাড়ে ৭ লাখ টাকার চাল ছিল, আর এবার বাসমতি বোঝাই চাল ছিল যার দাম সাড়ে ৮ লাখ টাকা। তার ব্যাংকে ১৬ কোটি টাকার মতো লোন রয়েছে। গত তিন মাসে ১৫ লাখ টাকার চাল হারিয়ে তিনি এখন পাগল প্রায়। শরীরের অবস্থা ভালো নয়। গত কয়েকদিন ধরে নিজের লোক দিয়ে ঢাকাসহ নানা জায়গায় খোঁজ করে খোয়া যাওয়া চালবোঝাই ট্রাকের কোনো হদিস মেলাতে পারেননি। নূর অটো রাইস মিলের ৪ জানুয়ারি চালবোঝাই ট্রাক খোয়া যাওয়ার পর খবর পান গত ৭ জানুয়ারি। ওই দিনই কুষ্টিয়া মডেল থানায় দালালদের নামে জিডি করেন। এই কাভার্ড ভ্যানে চাল ছিল ৪৭০ বস্তা চাল। মিল মালিকরা বলছেন, খাজানগরে চালবোঝাই ট্রাক ছিনতাই ও উধাওয়ের ঘটনা নতুন নয়। দীর্ঘ সময় ধরে এটি হয়ে আসছে। এর পেছনে বড় কোনো চক্র জড়িত রয়েছে। তাদের ধারণা খাজানগর মোকাম এলাকার কেউ কেউ এ চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন। স্থানীয় চক্রের হাত ছাড়া একের পর এক এমন ঘটনা ঘটার কথা নয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খাজানগর এলাকার যারা অটো রাইস মিলের মালিক তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব পরিবহন রয়েছে। তবে অনেক সময় ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের সংকট হলে স্থানীয় দালাল অফিসের মাধ্যমে তা সংগ্রহ করা হয়। সম্প্রতি নূর অটো রাইস মিলের যে দুটি ট্রাক উধাও হয়েছে তা সংগ্রহ করা হয় খাজানগর দোস্তপাড়া এলাকার দালাল অফিসের মাধ্যমে।

এখানে রাশেদ, মহিদুল ও মনো নামের কয়েকজন দালালের কাজ করেন।

তারা সব সময় মিলগুলোতে যোগাযোগ রাখেন। মালিকরা পরিবহন চাইলে তারা ঠিক করে দেন। কমিশন পান এ জন্য।

রাশেদ ও মহিদুল আবার কুষ্টিয়া শহরের সঞ্জয় নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে এ পরিবহন সংগ্রহ করে চালকল মালিকদের কাছে নিয়ে আসেন। গত ৪ জানুয়ারি নূর অটো রাইস মিল থেকে যে চাল কাভার্ড ভ্যানে বোঝাই করা হয় সেটির রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছিল ঢাকা মেট্রো ট- ১৫-২২৫৭, ইঞ্জিন নম্বর ছিল বি ৫৬২৬২৭৮২৯৯৯। ড্রাইভারের নাম রানা আহমেদ। উত্তরার ঠিকানা দেওয়া হয়। ট্রাক বিকালে মিলে ঢুকে রাতে বেরিয়ে যায়। সিসি ক্যামেরায় সেই ভিডিও ফুটেজও রয়েছে। চাল হারানোর পর বিআরটিএ অফিসে কাগজপত্র নিয়ে গেলে তারা জানায় এগুলো ভুয়া। একইভাবে তিন মাস আগে যে গাড়িতে চাল পাঠানো হয় তার কাগজপত্র ছিল ভুয়া। সেই ট্রাক সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন মনো নামের এক দালাল। একইভাবে সম্প্রতি সময়ে আবদুল্লাহ অটো রাইস, দাদা অটো রাইস, মামুন এগ্রো আরও কয়েকটি মিল মালিকের চাল উধাও হয়ে গেছে। আবার একই সময়ে দাদা রাইস মিলের ধানবোঝাই একাধিক ট্রাকও উধাও হয়ে গেছে মহাসড়ক থেকে। প্রতিটি ঘটনায় কোনো না কোনো চক্রের হাত রয়েছে বলে মিল মালিকরা মনে করছেন। একের পর এক এমন ঘটনায় শঙ্কিত মিল মালিক ও মালিক সমিতির নেতারা। কুষ্টিয়া মেজর অটো অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির একাংশের সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন প্রধান বলেন, চালকল মালিকদের এমনিতেই নানা সমস্যা-সংকট রয়েছে। তারপর বাড়তি আতঙ্ক হিসেবে যোগ হয়েছে ট্রাক হারিয়ে যাওয়া। এতে করে লাখ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে মালিকদের। আবার থানা পুলিশ করেও অনেক সময় হদিস মিলছে না। একটি শক্ত সিন্ডিকেট এর পেছনে রয়েছে। পুরো চক্রকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। এর আগে নূর অটো রাইস মিলের প্রথম যে ট্রাকটি খোয়া গিয়েছিল তাতে চাল ছিল সাড়ে ৭ লাখ টাকার। সে সময় মিল মালিকরা বিচার বসান। এ জন্য দালাল মনো, মহিদুল ও রাশেদের জরিমানা করা হয় ৪ লাখ টাকা। মনোর একাই দেড় লাখ টাকার ওপরে জরিমানা করা হয়। তবে বাকি ৪ লাখ টাকা আর ফেরত পাননি তিনি। চালকল মালিক সমিতির একাংশের সভাপতি ওমর ফারুক জানান. সম্প্রতি সময়ে চালবোঝাই ট্রাক হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা বেড়েছে। একই সঙ্গে ধানবোঝাই ট্রাক ছিনতাই হচ্ছে। বিষয়টি মিল মালিকদের ভাবিয়ে তুলেছে। নূর অটো রাইস মিলের মালিক আমিরুল ইসলামের পর পর দুটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটল। এর পেছনে স্থানীয় চক্রের সদস্যরা জড়িত বলে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানিয়েছেন। আর যেসব গাড়িতে চাল যাচ্ছে তাদের কাগজপত্র দেখে তাদের পক্ষে কোনোভাবেই বোঝার উপায় নেই সেগুলো নকল। যে কারণে চাল হারিয়ে যাওয়ার পর তার কোনো হদিস মিলছে না। মিল মালিকরা জানান, এসব চাল ঢাকা ও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা কিনে থাকে চক্রের কাছ থেকে। তারা কম দামে চাল কিনে আবার অন্যদের কাছে বিক্রি করে দেয় বলে জানা গেছে। কুষ্টিয়া থেকে হারিয়ে যাওয়া চাল সম্প্রতি চট্টগ্রামের একটি মার্কেট থেকে উদ্ধার হয়। এদিকে বছরে কোটি কোটি টাকার চাল হারিয়ে যাওয়ার ঘটনায় অনেক ব্যবসায়ী পথে বসার উপক্রম হয়েছে। অনেকে ব্যাংক লোন সময়মতো পরিশোধ করতে পারছেন না। কুষ্টিয়া মডেল থানায় ট্রাক হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বেশ কিছু অভিযোগ পড়েছে। এ বিষয়ে কথা হয় থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সাব্বিরুল আলমের সঙ্গে। চালবোঝাই ট্রাক উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনায় কয়েকটি অভিযোগ পড়েছে। অভিযোগ পাওয়ার পর আমাদের টিম কাজ করছে। আমরা বিষয়টি খুব গুরুত্ব নিয়ে দেখছি। দালালদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। বাইরেও খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে। এর আগে এক মালিকের খোয়া যাওয়া চাল উদ্ধার করা হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন।

সর্বশেষ খবর