শনিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

মুক্তিযুদ্ধে নিহত একই পরিবারের ১১ শহীদের খোঁজ নেয়নি কেউ

নাটোর প্রতিনিধি

মুক্তিযুদ্ধে নিহত একই পরিবারের ১১ শহীদের খোঁজ নেয়নি কেউ

শহীদ পরিবারের স্বজনরা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

১১ এপ্রিল ১৯৭১। এই দিনে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধের সময় শহীদ হয়েছিলেন নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার নগর ইউনিয়নের পারকোল গ্রামের একই পরিবারের ১১ জন। এ ছাড়া ওই পরিবারের দুই সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। কানু সরকার ও ওসমান আলী সরকার নামে গুলিবিদ্ধ সেই দুই সদস্য ক্ষত নিয়ে যন্ত্রণায় দিন কাটাচ্ছেন যুগের পরে যুগ। দীর্ঘ ৫০ বছরেও এই শহীদ পরিবার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়ায় তাদের শারীরিক যন্ত্রণার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানসিক যন্ত্রণা। এ ছাড়া ওই পরিবারের ১১ শহীদসহ ১৭ শহীদের গণকবরও পড়ে রয়েছে অবহেলা ও অরক্ষিত অবস্থায়। এসব শহীদ ও যুদ্ধাহতদের সরকারি সুযোগ-সুবিধাসহ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাসহ এলাকাবাসী ও পরিবারের সদস্যরা। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধের মুক্তিকামী বাঙালি যোদ্ধারা নাটোরের বিভিন্ন এলাকায় পাকসেনাদের প্রতিরোধে প্রস্তুতি নিতে থাকে। বড়াইগ্রাম উপজেলার ধানাইদহ এলাকায় ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের ওপরে ধানাইদহ ব্রিজ পাহারায় ছিলেন তৎকালীন ইপিআর, পুলিশ-আনসার সসদ্যসহ মুক্তিযোদ্ধারা।  সময়কাল ১৯৭১ এর ১১ এপ্রিল। এই দিন চোখের সামনে বাবা-মা ও ভাই-বোনসহ পরিবারের ১১ সদস্যকে গুলি করে হত্যা করতে দেখেছেন শহীদ শুকুর আলী সরকারের ছেলে কানু সরকার। এ ছাড়া তিনি নিজে এবং তার চাচা ওসমান আলী সরকার গুলিবিদ্ধ হন। কানু সরকার জানান, চোখের সামনে তার বাবা শুকুর আলী সরকার, মা কাঞ্চনী বেগম, ভাই জানু সরকার, দাদি বাবুনি বেগম, বড় আব্বা ছবি সরকার, বড়মা গোলাপি বেগম, তাদের মেয়ে জালেদা খাতুন, আরেক চাচা আছের উদ্দিন সরকার, চাচি জয়েনা বেগম, চাচাতো ভাই জাহাঙ্গীর আলম ও ফুফাতো ভাই মজব আলীকে প্রকাশ্যে ব্রাশ ফায়ার করে পাকসেনারা। প্রাকসেনাদের ব্রাশ ফায়ারে শহীদ হন তারা। আমি ও আমার চাচা ওসমান আলী সরকার এ সময় গুলিবিদ্ধ হই। পাকসেনাদের ছোড়া গুলি এসে আমার বাম পায়ের হাঁটুতে লাগে এবং আমার পাশে থাকা চাচা ওসমান আলীর মাজায় লেগে গুলি বেরিয়ে যায়। রক্তে সয়লাব হয়ে যায়। দুইজনই যন্ত্রণায় ছটফট করছিলাম। তবে পাকসেনাদের নজরে যেন না পড়তে হয় সেজন্য দুইজনের কেউ কোনো টুঁ শব্দ করিনি। একদিকে বাবা-মাসহ পরিবারের লোকদের মৃত্যু দেখে ডুকরে কাঁদতেও পারছিলাম না।

তেমনি যন্ত্রণায় গোটা শরীরে কাঁপুনি শুরু হলেও সাহায্যের জন্য কাউকে চিৎকার করে ডাকতেও পারছিলাম না। ওইদিন পাকসেনাদের গুলিতে আমার পরিবারের ১১ জনসহ ১৭ জন শহীদ হন। পাকসেনারা চলে যাওয়ার পর আমরা বের হয়ে আসি। এ সময় অনেকেই ছোটাছুটি করে নিরাপদ দূরত্বে যেতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। স্থানীয়রাই আমাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছেন। পরে নিহতদের আমাদের বাড়ির পাশে বাঁশবাগানের মধ্যে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়। আমরা পরিবারের যে কজন জীবিত ছিলাম তারা নিরাপদ স্থানে সরে যাই। পরে স্বাধীনতার পর ওই গণকবর চিহ্নিত করে পাকা করা হয়। স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বড়াইগ্রাম উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার আবদুস সাত্তার জানান, ৭১-এর ১১ এপ্রিল পাকসেনাদের একটি দল ঢাকা-নাটোর মহাসড়ক দিয়ে নাটোরের দিকে আসার পথে ধানাইদহ ব্রিজের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। এ সময় ভারী অস্ত্রে সজ্জিত পাকসেনাদের একটি দল পিছু হটে প্রায় এক কিলোমিটার পথ ঘুরে পারকোল গ্রামের মধ্যে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করতে থাকে। পাকসেনাদের ভারী অস্ত্রের মুখে প্রতিরোধ করা সম্ভব না হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে থাকেন। এ সময় ধানাইদহ ব্রিজ এলাকায় মাহাবুব আলী ও সিরাজুল ইসলাম নামে দুই আনসার সদস্যসহ অন্তত ২০ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাদের কয়েকজনকে ব্রিজের পাশে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়। স্বাধীনতার পর ব্রিজের পাশে গণকবর চিহ্নিত করে পাকা করা হয়েছে। বিভিন্ন দিবসে এসব শহীদদের শ্রদ্ধা জানানো হয়। সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তার আরও জানান, ইপিআর, আনসার ও পুলিশ সদস্যসহ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম প্রতিরোধে বাধা পেয়ে  পাকসেনাদের একটি দল গ্রামের পথ ধরে পারকোল গ্রামে ঢুকে পড়ে। তারা ওই গ্রামে প্রবেশের পথে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণসহ বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় প্রতিরোধের চেষ্টা করলে ওই গ্রামের ১৭ জনকে গুলি করে হত্যা করে। এদের মধ্যে শুকুর আলী সরকারসহ তার পরিবারের নারী-পুরুষ মিলে ১১ জন শহীদ হন। গুলিবিদ্ধ হন শুকুর আলী সরকারের ছেলে কানু সরকার ও তার চাচাতো ভাই ওসমান আলী সরকার। এ সময় শহীদদের রক্তে লাল হয়ে যায় ওই গ্রামের একটি পুকুর। পারকোল গ্রামের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালাম জানান, পাকসেনারা চলে যাওয়ার পর আত্মগোপনে থাকা মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষ নিহতদের লাশ গ্রামের একটি বাঁশবাগানের মধ্যে গণকবর দেয়। স্বাধীনতার পর স্থানীয় সংসদ সদস্যের অনুদানে গণকবর পাকা করে চিহ্নিত করে এলাকাবাসী। এরপর গত ৫০ বছরেও আর এই গণকবর ও শহীদদের খোঁজ নেয়নি কেউ। গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ শুকুর সরকারের ছেলে কানু সরকার ও তার পরিবারের সদস্য ওসমান আলী সরকার প্রায় পঙ্গু জীবন কাটাচ্ছেন। শহীদ পরিবারগুলো পায়নি সরকারি সাহায্যসহ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। গুলিবিদ্ধরা এখনো পায়নি কোনো সহায়তা। তাঁদের খোঁজও নেয় না কেউ। বিশেষ দিনগুলোতেও এই শহীদদের স্মরণ করা হয় না। গণকবর পড়ে রয়েছে অরক্ষিত অবস্থায়। এসব শহীদ ও যুদ্ধাহত পরিবারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে তালিকা করাসহ সরকারি সহায়তার দাবি জানিয়েছেন শহীদ পরিবার ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। বড়াইগ্রাম উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার শামছুল হক জানান, ১১ শহীদের ওই পরিবারকে শহীদ পরিবারের মর্যাদা দেওয়ার জন্য বেশ কয়েকবার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলে আবেদন করা  হয়। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। এখন মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে পারেন তাদের পরিবার থেকে। তবে ওই ১১ শহীদসহ ১৭ জনের গণকবরটি অরক্ষিত অবস্থায় থাকার বিষয়টি স্বীকার করেন। জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, একই পরিবারের ১১ জন শহীদ হয়েছেন এমন খবর তিনি জানার পর তাদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। দীর্ঘ দিনেও তাদের কেউ  খোঁজ নেননি এমন খবর তাকে পীড়া দিয়েছে। তিনি তাদের পাশে রয়েছেন। তাদের জন্য যে ধরনের সহায়তার প্রয়োজন তা তিনি করবেন।

 

সর্বশেষ খবর