বৃহস্পতিবার, ১২ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

অবহেলায় ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্যসেবা, ভোগান্তি

পাবনা প্রতিনিধি

অবহেলায় ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্যসেবা, ভোগান্তি

চিকিৎসক, কর্মচারীদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, দায়িত্বে অবহেলা ও অব্যবস্থাপনায় ভেঙে পড়েছে পাবনা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা। জেলার প্রায় ৩০ লাখ মানুষের জরুরি ও জটিল চিকিৎসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটির চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের বিরুদ্ধে পাহাড়সম অভিযোগ রোগীদের। অনিয়মের প্রতিবাদ করলে অপমান এমনকি মারধোরের শিকারও হয়েছেন অনেকেই। এসব ঘটনা ওপেন সিক্রেট হলেও অভিযুক্ত চিকিৎসক-কর্মচারীরা অস্বীকার করেছেন সব অভিযোগ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সম্প্রতি পাবনা জেনারেল হাসপাতালে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দিয়েছেন ডা. ওমর ফারুক মীর। ঈদুল ফিতরের আগে হাসপাতালের চিকিৎসক, কর্মচারীদের দায়িত্বে অবহেলা, সময়মতো উপস্থিত না হওয়া বিষয়টি উল্লেখ করে সহকারী পরিচালককে কারণ দর্শানোর নোটিস দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। ছুটির পর চিকিৎসক-কর্মচারীদের দায়িত্বে অবহেলা না করার নির্দেশনা দিয়ে লিখিত সতর্কবার্তা পাঠান সহকারী পরিচালক। এরপরই স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ সাধারণ সম্পাদক হাসপাতালের অর্থপেডিক বিভাগের চিকিৎসক ডা. জাহেদী হাসান রুমীর নেতৃত্বে সহকারী পরিচালক ওমর ফারুক মীরকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে তার কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে ৮ ও ৯ মে অফিস করতে বাধা দেয় চিকিৎসকদের একটি অংশ। নিজ কক্ষের সামনে লাঞ্ছিতও হন সহকারী পরিচালক। পরে সিনিয়র চিকিৎসকদের সমর্থন না পেয়ে একপর্যায়ে তালা খুলে দেন তারা। তবে স্বাচিপ নেতাদের বিরোধিতা ও অসহযোগিতার কারণে এখনো প্রশাসনিক শৃঙ্খলা স্বাভাবিক হয়নি। এর প্রভাব পড়ছে চিকিৎসা কার্যক্রমেও। ভোগান্তিতে পড়েছেন রোগীরা। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) পাবনা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. জাহেদী হাসান রুমী বলেন, ডা. ওমর ফারুক মীর হাসপাতালে যোগদানের পর থেকে নানা অনিয়ম, দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। এতে হাসপাতালের সব কাঠামো ভেঙে পড়েছে। সম্প্রতি সদর উপজেলার টেবুনিয়া বাজার এলাকায় সন্ত্রাসীরা হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কামরুজ্জামান নয়নকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। এই বিষয়টি তাকে জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেননি। এতে চিকিৎসকরা ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছিলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক জানান, পাবনার স্থানীয় বাসিন্দা ও দলের নাম ভাঙিয়ে বেশ কয়েকজন চিকিৎসক দীর্ঘদিন কর্তব্যে অবহেলা করে আসছেন। হাসপাতালের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, ওষুধ কোম্পানি থেকে সুবিধা নেন তারা। হাসপাতালে দায়সারা দায়িত্ব পালন করেন। কখনো বায়োমেট্রিক উপস্থিতি মেশিনে হাজিরা দিয়েই আবারও বাইরে চলে যান। অতীতের কোনো সহকারী পরিচালকই তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। দীর্ঘদিন একই হাসপাতালে চাকরি করায় তারাও কারও কথার তোয়াক্কা করেন না। সহকারী পরিচালক ডা. ওমর ফারুক মীরও প্রশাসনিক কাজে কৌশলী নন। ফলে, নানা বিষয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে।

সরেজমিন গতকাল পাবনা জেনারেল হাসপাতালে গিয়েও দেখা মেলে ভোগান্তির নানা চিত্র। মঙ্গলবার সকালে অস্ত্রোপচার হওয়া ভাঙা পা নিয়ে ফলোআপ চিকিৎসার জন্য ডা. জাহেদী হাসান রুমীর কাছে ঈশ্বরদী থেকে আসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী রুহুল আমিন। দীর্ঘসময় অপেক্ষা করেও চিকিৎসা না পেয়ে হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে চিকিৎসকের ফোন নম্বর চাইলে তিনি মারমুখী আচরণ করেন বলে অভিযোগ রুহুলের। রুহুল আমিন বলেন, ছাত্রশিবিরের সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়ে পায়ে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হলে আমি জেনারেল হাসপাতালে ডা. রুমীর সঙ্গে দেখা করি। তিনি নানা অজুহাতে আমাকে ১৭ দিন ঘুরিয়ে অপারেশন করেছেন। ফলোআপ চিকিৎসায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রেখে চেম্বারে দেখা করতে বলেছেন। সরকারের বেতন নিয়ে এই চিকিৎসকরা সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে রোগীদের ভোগান্তি সৃষ্টি করছে, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন রুহুল। এদিকে, গণমাধ্যমে বক্তব্য প্রদানের কিছুক্ষণের মধ্যেই রুহুল আমিনকে লোক পাঠিয়ে ডেকে নেন ডা. জাহেদী হাসান রুমী। পরে তাকে হাসপাতালেই চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে বলে জানান রুহল আমিন। কেবল তাই নয়, হাসপাতাল কম্পাউন্ডের মধ্যে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে একটি ওষুধের দোকান পরিচালনা করে একটি চক্র। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠকে স্থানীয় সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক প্রিন্স অবৈধ দোকানটি উচ্ছেদে একাধিকবার নির্দেশনা দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, স্বাচিপ নেতারা এ দোকান থেকে বড় অঙ্কের লভ্যাংশ পান। চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয় ও স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রয়োজনের দ্বিগুণ ওষুধ ও উপকরণ বেশি দামে কিনতে রোগীদের বাধ্য করেন। পরে তা রোগীদের ফেরত না দিয়ে ওই দোকানেই বিক্রি করে দেন। আহসান রাজীব নামের এক সেবাপ্রার্থী অভিযোগ করেন, গত কয়েক দিন আগে আমার বাবার হাত কেটে গেলে হাসপাতালে নিয়ে আসি। স্বাস্থ্যকর্মীরা গজ, ব্যান্ডেজ, ওষুধ সব কিছুই দ্বিগুণ পরিমাণ কিনতে বাধ্য করে। হাত সেলাই করার সময় তারা অতিরিক্ত ওষুধ সরিয়ে ফেলে। ভিতরের কক্ষে ওষুধগুলো দেখে আমি ফেরত চাইলে মারমুখী হয়ে ওঠে তারা। সম্মান বাঁচাতে তা ফেরত না নিয়েই চলে আসি। সহকারী পরিচালক ডা. ওমর ফারুক মীর বলেন, জেনারেল হাসপাতাল ২৫০ শয্যার হলেও সেখানে গড়ে হাজারেরও বেশি রোগী ভর্তি থাকে। সীমিত জনবল দিয়ে হাসপাতাল পরিচালনায় নানা ধরনের অসুবিধা হয়। আশা করছি চিকিৎসকদের ভুল বোঝাবুঝি দ্রুতই কেটে যাবে। সবাই দায়িত্বশীল আচরণ করলে সেবার মান বাড়ানো সম্ভব।

 

সর্বশেষ খবর