সোমবার, ১৬ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

টানা বৃষ্টিতে বোরো ধানের ক্ষতি

আবদুর রহমান টুলু, বগুড়া

টানা বৃষ্টিতে বোরো ধানের ক্ষতি

টানা বর্ষণে প্রভাব পড়েছে বগুড়ায়। বাম্পার ফলন ঘরে তোলার কথা থাকলেও ঘূর্ণিঝড় অশনির কারণে ঝড়ো বাতাস ও কয়েকদিনের বৃষ্টিতে উঠতি বোরোর ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে বিপাকে পড়েছে বোরো চাষিরা। বৃষ্টির কারণে পানিতে লুটোপুটি খাচ্ছে জমির পাকা ধান। সেইসঙ্গে শ্রমিক সংকটের কারণে ডুবে থাকা ধানের শীষ খেতেই পচে নষ্ট হচ্ছে। ভালো ফলন না পাওয়ার কারণে প্রতি বিঘায় ৭ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকা লোকসানের মুখে পড়বে চাষিরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বগুড়ার উপ সহকারী কর্মকর্তা ফরিদ উদ্দিন জানান, চলতি বছরে জেলায় ১ লাখ ৮৭ হাজার ৪১৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আবাদ হয়েছিল ১ লাখ ৮৭ হাজার ৭৫৫ হেক্টর জমিতে। এর বিপরীতে চাল আকারে উৎপাদন হয় ৮ লাখ ৭ হাজার ৬২৩ মেট্রিক টন চাল। গত বছর চাষ হয়েছিল ১ লাখ ৮৮ হাজার ৫১০ হেক্টর। আর চাল আকারে উৎপাদন হয়েছিল ৮ লাখ ১০ হাজার ৫৯০ মেট্রিক টন। এ বছর প্রতি হেক্টরে ফলন পাওয়া যাবে ৫ থেকে ৬ টন করে। বগুড়ায় লাভজনক হওয়ায় প্রতি বছরই রেকর্ড পরিমাণ জমিতে বোরো চাষ হয়ে থাকে। এবারও ভালো ফলন ও ভালো দামের প্রত্যাশা চাষিদের। জেলার সোনাতলা উপজেলার বোরো চাষি আবু মুসা জানান, ১০ হাজার টাকা খরচে বিঘাপ্রতি ১৮ থেকে ৩০ মণ ধান পাওয়া যায়। জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ধান রোপণ শেষে এপ্রিল মাসের শেষে ধান কেটে ঘরে তুলতে হয়। এবার ঝড়ো বাতাস ও কয়েকদিনের বৃষ্টিতে বোরোর ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতি বিঘায় ৭০০০-৯০০০ টাকা লোকসানের মুখে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শেরপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক বিঘা জমিতে ধান লাগানো থেকে কাটা-মাড়াই ও জমির মালিককে বর্গাবাবদ টাকা দেওয়া পর্যন্ত প্রায় ২২ হাজার ২০০ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। আর বর্গাবাবদ ৭ হাজার টাকা বাদ দিয়ে হিসাব কষলে প্রতিবিঘা জমির বিপরীতে একেকজন কৃষকের খরচের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫ হাজার ২০০ টাকা। অথচ সেই জমি থেকে অশনির বৃষ্টির কারণে সর্বোচ্চ ১৬ থেকে ১৮ মণ হারে ধানের ফলন মিলছে। অশনির আগে এই জমি থেকে ২২ মণ করে ধান পাওয়ার কথা ছিল। বাজারদর অনুযায়ী প্রতিমণ ভেজা ধান ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। সেই হিসাবে প্রতিবিঘা জমি থেকে ৯ থেকে ১০ হাজার টাকার ধান বিক্রি করতে পারছেন। শেরপুর উপজেলা কৃষি অফিস জানায়, চলতি মৌসুমে এই উপজেলায় ২০ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ করা হয়। শুরু থেকে আবহাওয়া ভালো থাকলেও ফসল ঘরে তোলার সময় অনুকূলে নেই। অশনির কারণে প্রায় দুই সপ্তাহ বৃষ্টিপাত হয়েছে। এ জন্য ১ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। তবে বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। অশনির ওই ঝড়-বৃষ্টিতে উপজেলার সিংহভাগ জমির ধান মাটিতে নুয়ে পড়েছে। এমনকি খেতে জমে থাকা সেই পানিতে ধানের শীষ ডুবে পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শ্রমিক সংকটে জমির পাকা ধান কাটতেও পারছেন না তার। এদিকে এসব নানা প্রতিকূলতার মাঝেও বসে নেই কৃষক। খেতের ফসল ঘরে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেই ধান কাটা-মাড়াই শুরু করেছেন। তবে ধান কাটা শ্রমিক সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। চুক্তি অনুযায়ী বাড়ি থেকে জমির দূরত্ব বুঝে এক বিঘা জমির ধান কাটা বাবদ ৫ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক গুনতে হচ্ছে। পাশাপাশি প্রত্যেককে তিন বেলা খাবার খরচ দিতে হচ্ছে।  কৃষক গোলাম রব্বানী বলেন, এমনিতেই বৈরী আবহাওয়া তারপর শ্রমিক সংকট। সেইসঙ্গে ধানের বর্তমান বাজারদর কৃষকের কোমর ভেঙে দিচ্ছে। এই ভাঙা কোমর নিয়ে আগামী মৌসুমের ফসল কী করে চাষ করবেন- এমন ভাবনায় ভীষণভাবে শঙ্কিত তারা। শেরপুর উপজেলার উচরং গ্রামের কৃষক আবদুল বারিক জানান, তিনি চলতি মৌসুমে প্রায় ২০ বিঘা জমিতে বিভিন্ন জাতের বোরো ধান লাগিয়েছেন। এসব জমির ধান পেকেও গেছে। কিন্তু অব্যাহত বৃষ্টি ও ঝড়ে ধান মাটিতে নুয়ে পড়েছে। সেইসঙ্গে খেতের মধ্যে জমে থাকা পানিতে ভাসছে ধান। এমন অবস্থায় শ্রমিকরাও ধান কাটতে রাজি হচ্ছেন না। দ্বিগুণ দাম দিয়ে ১০ বিঘা জমির ধান কাটতে পারলেও বাকি জমির ধান পানির মধ্যেই ভাসছে। ধান দ্রুত কাটতে না পারলে জমিতেই পচে নষ্ট হয়ে যাবে।

এ ছাড়া বৈরী আবহাওয়ার কারণে খেতের কেটে আনা কাঁচা ভেজা ধান কাক্সিক্ষত দামে বিক্রিও করতে পারছেন না। প্রতিমণ ধান ৫৯০-৭০০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। এ জন্য লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের। সাধুবাড়ী গ্রামের কৃষক আবদুস সাত্তার বলেন, নিচু এলাকায় লাগানো প্রায় ১০ বিঘা জমির ধান পানিতে ডুবে রয়েছে। শ্রমিকরা কাটতেই চাচ্ছে না। এ ছাড়া কাটার যে মজুরি দাবি করছে, তা জমির উৎপাদিত সব বিক্রি করেও হবে না। তাই ওইসব জমির ধান কাটার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছি। শেরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, মৌসুমের শেষ সময়ে এসে আবহাওয়া প্রতিকূল হওয়ায় যেসব জমির ধান ৮০ ভাগ পেকে গেছে তা দ্রুত কেটে ঘরে তোলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী কৃষকরা ধান কাটছেন। ইতোমধ্যে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ জমির ধান কেটে ঘরে তুলতে সক্ষম হয়েছে তারা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বগুড়ার উপ-পরিচালক কৃষিবিদ দুলাল হোসেন জানান, ধান ও চালের মূল্য ভালো পাওয়ায় কৃষক ধান চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। আবহাওয়া ভালো না থাকায় কৃষকরা তাড়াতাড়ি তাদের ফলনকৃত ধান ঘরে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা নির্দেশনা মোতাবেক কৃষকদের বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন।

সর্বশেষ খবর