রবিবার, ২৯ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

১৪ বছর বন্ধ অপারেশন থিয়েটার

মো. শামীম কাদির, জয়পুরহাট

১৪ বছর বন্ধ অপারেশন থিয়েটার

জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলায় প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার মানুষের বাস। এ উপজেলার অধিকাংশ মানুষের স্বাস্থ্যসেবার একমাত্র ঠিকানা ৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। তবে হাসপাতালটিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে রোগীরা কাক্সিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ১১ পদে বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র একজন। এ ছাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির অপারেশন থিয়েটার বন্ধ রয়েছে ১৪ বছরের বেশি সময় ধরে। ফলে বাধ্য হয়ে উপজেলাবাসীকে উন্নত চিকিৎসাসেবা নিতে ধরনা দিতে হয় জয়পুরহাট জেলা ও পাশর্^বর্তী বগুড়া  জেলার বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। এদিকে আক্কেলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক সংকটের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানানো হলেও ব্যবস্থ্য নেওয়া হয়নি বলে দাবি সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের।  আক্কেলপুর উপজেলার একটি পৌরসভাসহ পাঁচটি ইউনিয়নের মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে ১৯৭৫ সালে স্থাপিত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করাসহ আধুনিক ভবন নির্মিত হয় ২০০৬ সালে। সেই সময় থেকেই অপারেশন করার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় একটি সুসজ্জিত রুমসহ আধুনিক যন্ত্রপাতি। এ ছাড়াও সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের ব্যবস্থার জন্য রয়েছে সোলার সিস্টেম। অথচ এ অপারেশন থিয়েটারটি কোনো কাজে আসছে না। প্রথম অবস্থায় অপারেশন থিয়েটারটি চালু ছিল।

 কিন্তু অল্প কিছুদিন রোগীর অপারেশন চলার পর ২০০৮ সাল থেকে চিকিৎসক ও লোকবলের অভাবে অপারেশন থিয়েটারটি বন্ধ হয়ে যায়।

তারপর ১৪ বছর পার হয়ে গেলেও আর চালু করা সম্ভব হয়নি থিয়েটারটি। দীর্ঘদিন ধরে অপারেশন থিয়েটারের রুমটি ব্যবহার না করায় এর যন্ত্রপাতিগুলো অকেজো হওয়াসহ বৃষ্টির পানি ছাদ দিয়ে পড়ার কারণে বৈদ্যুতিক লাইনগুলো অকেজো হয়ে পড়েছে। বর্তমানে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে অ্যানেসথেসিয়া চিকিৎসক ও প্রশিক্ষিত নার্স থাকলেও গাইনি ও সার্জারি চিকিৎসকের অভাবে কোনো অপারেশন করানো সম্ভব হচ্ছে না। অথচ ২০০৬ সালে হাসপাতালটি ৫০ শয্যা হওয়ার পর অপারেশন থিয়েটারে টিউমার, ফোঁড়া, অর্থোপেডিক্সসহ বিভিন্ন ছোট ও মাঝারি ধরনের অপারেশন নামমাত্র সরকারি ফি নিয়ে করা হতো। এতে শুধু আক্কেলপুর উপজেলা নয়, পাশের বদলগাছী উপজেলাসহ পাশের বিভিন্ন উপজেলার রোগীরা এ হাসপাতালে ভিড় করত। কিন্তু অপারেশন বন্ধ থাকায় গরিব ও অসহায় রোগীদের নানা ভোগান্তির শিকার হওয়াসহ গরিব অসহায় রোগীদের অর্থদণ্ড গুনতে হচ্ছে। এ সুযোগে ফায়দা লুটছে বেসরকারি ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ। সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গাইনি বিশেষজ্ঞ, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, শিশু বিশেষজ্ঞ, কার্ডিওলজি বিশেষজ্ঞ, অর্থোপেডিক্স, সার্জারি বিশেষজ্ঞ, চর্ম ও যৌন বিশেষজ্ঞ, চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও নাক-কান ও গলা বিশেষজ্ঞসহ ১১ জন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পদ রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে ১১ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মধ্যে শুধু একজন অ্যানেসথেসিয়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। এ ছাড়া তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৮৫টি পদের মধ্যে ৫২ জন কর্মরত রয়েছেন। সরেজমিন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতালের বহির্বিভাগে ও অন্তর্বিভাগে চাহিদা অনুযায়ী রোগীদের মিলছে না ওষুধ। ফলে রোগীদের বাহির থেকে ওষুধ কিনে চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। যন্ত্র পুরনো হওয়ায় এক্সরে করতে রোগীদের বাহিরে যেতে হচ্ছে। হাসপাতালে বাথরুমগুলো নোংরা। এ ছাড়া ব্যবহারকৃত সিরিঞ্জ ও স্যালাইনের প্যাকেট রোগীর বেডের পাশে স্তূপ করে পড়ে থাকতে ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভিতর যত্রতত্র অটোরিকশা পার্কিং করে রাখা হয়েছে। চিকিৎসাসেবা নিতে আসা আক্কেলপুর উপজেলার কানুপুর গ্রামের ১২ বছরের নাঈম হোসেনের পিতা আফজাল হোসেন বলেন, প্রস্রাবের জ্বালাপোড়ার সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে এসেছিলাম। চিকিৎসাপত্রে অন্যান্য ওষুধ না পেলেও শুধু প্যারাসিটামল পেয়েছি। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া আক্কেলপুরের জাফরপুর গ্রামের দুই বছরের শিশু আবদুল্লাহর অভিভাবক আবেদ আলী ও আক্কেলপুর উপজেলার কানুপুর গ্রামের চার বছরের শিশু জান্নাতুল ফেরদৌসের অভিভাবক মরিয়ম বেগম বলেন, শুধু হাসপাতাল থেকে এক ছিপি ওষুধ ও স্যালাইন দিচ্ছে। বাকি ওষুধ বাহির থেকে কিনতে হচ্ছে। পাশর্^বর্তী নওগাঁ জেলার খাদাইল গ্রামের মো. আলী ও আক্কেলপুরের কাঁঠালতলী গ্রামের সাগর হোসেন বলেন, চিকিৎসক সংকটের কারণে রোগীরা যেমন প্রাপ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তেমনি চিকিৎসকদেরও সীমাবদ্ধতার মধ্যে যথার্থ সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আক্কেলপুর উপজেলার বিহারপুর গ্রামের সাজেদা বেগমের মা রওশন আরা ও রায়কালি গ্রামের আলম হোসেন, তার মেয়ের সিজারিয়ান অপারেশন করা হয়েছে জয়পুরহাট শহরে। স্বল্প আয়ের মানুষ অথচ খরচ করতে হয়েছে ১২ হাজার টাকা। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে অপারেশনের ব্যবস্থা করা হলে কোনো অর্থ খরচ হতো না। একই কথা জানান মওদুদ আহম্মেদ, তার স্ত্রীকে সিজারিয়ান অপারেশন করান জয়পুরহাটের একটি ক্লিনিকে। ওখানে ওষুধ বেড ভাড়া আর ডাক্তার বাবদ খরচ হয়েছে ১৪ হাজার টাকা।

এ ব্যাপারে আক্কেলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মো. রুহুল আমিন বলেন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ১১টি পদের মধ্যে ১০টি শূন্য। একজন গাইনি বিশেষজ্ঞকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তিনি যোগদান না করে বদলি নিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। ফলে গাইনি ও সার্জারি বিশেষজ্ঞের অভাবে বহুদিন ধরে সব ধরনের অপারেশন বন্ধ রয়েছে। এসব পদে চিকিৎসক পদায়ন করা হলে, আমরা অপারেশনের জন্য প্রস্তুত। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। হাসপাতালে কর্মরত তিনজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এ ছাড়া বাজারের মধ্যে হাসপাতাল হওয়ায় বাহির থেকে লোকজন এসে বাথরুম নোংরা করে রেখে যায়। গুরুত্বপূর্ণ ওষুধগুলো ভর্তিকৃত রোগীদের জন্য রাখা হয়েছে। জয়পুরহাট জেলা সিভিল সার্জন ডা. ওয়াজেদ আলী বলেন, চিকিৎসক পদায়নের ব্যাপারটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ব্যাপার। গাইনি ও সার্জারি বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিয়ে অপারেশন চালু করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানালেন এই কর্মকর্তা।

 

সর্বশেষ খবর