বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

উদ্বোধনের অপেক্ষায় ছয় লেনের মধুমতী সেতু

সাজ্জাদ হোসেন, নড়াইল

উদ্বোধনের অপেক্ষায় ছয় লেনের মধুমতী সেতু

‘আগামী মাসের যে কোনো দিন মধুমতী সেতু উদ্বোধনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সময় দিলেই উদ্বোধন হবে এ সেতু। তিনি আগামী মাসে (অক্টোবর) যেদিন সময় দেবেন, সেদিনই বহুল প্রত্যাশিত মধুমতী সেতুর উদ্বোধন হতে পারে।’ এ তথ্য জানিয়েছেন সেতুটির প্রকল্প ব্যবস্থাপক ও সওজ নড়াইলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুজ্জামান। সেতুর যে কাজগুলো বাকি আছে, সেগুলোও এর মধ্যে শেষ হয়ে যাবে বলেও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। এদিকে উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা দেশের প্রথম ছয়লেনের দৃষ্টিনন্দন সেতুটি ইতোমধ্যে কালনা সেতু নামে পরিচিতি পেলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুটির নামকরণ করেছেন নদীর নামে। মধুমতী সেতু টোলের হার চূড়ান্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। জানা গেছে, কনটেইনার বা ভারী মালামাল পরিবহনে সক্ষম যানের টোল ধরা হয়েছে ৫৬৫ টাকা, বড় ট্রাক বা কাভার্ড ভ্যান ৪৫০ টাকা, মধ্যম ট্রাক ২২৫ টাকা, বড় বাস ২০৫ টাকা, ছোট ট্রাক ১৭০ টাকা, পাওয়ার টিলার বা ট্রাক্টর ১৩৫ টাকা, মিনিবাস বা কোস্টার ১১৫ টাকা, মাইক্রোবাস বা পিকআপ ৯০ টাকা, সিডান কার ৫৫ টাকা, টেম্পো বা সিএনজিচালিত অটোরিকশা ২৫ টাকা, মোটরসাইকেল ১০ টাকা এবং ভ্যান, রিকশা বা বাইসাইকেল ৫ টাকা। সেতুর কাজ শেষ হওয়ার পাশাপাশি, গাড়ি চলাচলের উপযোগী হয়েছে। আগামী মাসে উদ্বোধনের লক্ষ্যে এখন সেতুতে মূলত দরকারি দুই ধরনের কাজ চলছে। এগুলো হচ্ছে খুঁটিতে (ল্যাম্পপোস্ট) বাতি জ্বালানো এবং টোল প্লাজা প্রস্তুত করা। এর মধ্যে টোল প্লাজার কাজ চলতি মাসের মধ্যে শেষ হবে। আর ল্যাম্পপোস্ট চীনে তৈরি হয়েছে, তা ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম নৌবন্দরে পৌঁছেছে। এগুলো আসলে সেতুতে বসাতে এক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা যায়, নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার কালনা পয়েন্টে মধুমতী নদীর ওপর এ সেতুর অবস্থান। সেতুর পূর্ব পাড়ে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলা এবং পশ্চিম পাড়ে নড়াইলের লোহাগড়া। দৃষ্টিনন্দন ছয়লেনের এ সেতু হতে যাচ্ছে এশিয়ান হাইওয়ের অংশ। পদ্মা সেতু পার হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নড়াইলসহ ১০ জেলার প্রবেশদ্বার হবে এ সেতু। বহুল প্রতীক্ষিত স্বপ্নের এ সেতুর মাঝখানে বসানো হয়েছে ভিয়েতনামে তৈরি বিশ্বের সর্ববৃহৎ ১৫০ মিটার দীর্ঘ নেলসন লস আর্চ টাইপের (ধনুকের মতো বাঁকা) স্টিলের স্প্যান। মূলত জাপানের নিপ্পন কোম্পানির তৈরি ধনুকের মতো বাঁকা এ স্প্যানটি ছয়লেনের এ সেতুটিকে দৃষ্টিনন্দন এবং আকর্ষণীয় করে তুলেছে। সেতুর সবচেয়ে জটিল এ স্প্যান বসানোসহ ইতোমধ্যে প্রায় ৯৯ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এখন অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন এ অঞ্চলের মানুষ। এই সেতু চালু হলে নড়াইলের সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে। বাংলাদেশ সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে এ সেতু হচ্ছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জাপানের টেককেন করপোরেশন ও ওয়াইবিসি এবং বাংলাদেশের আবদুল মোনেম লিমিটেড যৌথভাবে এ সেতুর বাস্তবায়ন করছে। সেতু কর্তৃপক্ষ জানায়, মধুমতী নদীতে দৃষ্টিনন্দন ছয়লেন বিশিষ্ট এ সেতু নির্মাণে ৭০ একরের বেশি জমি অধিগ্রহণের পর ২০২০ সালের ১৫ মে বাস্তবায়ন শুরু হয়। সেতুর উভয় পাশে ৪ দশমিক ২৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ৩০ দশমিক ৫০ মিটার প্রস্থ সংযোগ সড়ক রয়েছে।

এ সেতু নির্মাণে মোট ব্যয় হচ্ছে ৯৫৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এ সেতু চালু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলার মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হবে। নড়াইল, যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, বেনাপোল, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর জেলাবাসী মাগুরা-ফরিদপুর হয়ে যাতায়াতের পরিবর্তে সরাসরি কালনা সেতু পার হয়ে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ঢাকাগামী যানবাহন যাতায়াত সহজ ও সংক্ষিপ্ত পথ হবে। এ ছাড়া স্থলবন্দর বেনাপোলের আমদানি-রপ্তানি পণ্যাদি পরিবহনেও এই সেতু ব্যবহার করা যাবে। তখন ঢাকার সঙ্গে নড়াইলের দূরত্ব হবে মাত্র ১২৫ কিলোমিটার অর্থাৎ কমে যাবে ১৮০ কিলোমিটার। মধুমতি সেতু চালু হলে নড়াইলে শিল্প-সংস্কৃতি, পর্যটন ও কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে। এর ফলে নড়াইলের ব্যবসায়ী ও সুবিধাভোগীরা আর্থ সামাজিক, কৃষি বিপণন, মৎস্য হাচারি এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিনয়োগ করবেন। তাদের মালামাল পরিবহনের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আসবে। মধুমতি সেতু চালু পরবর্তী আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট রাতারাতি পরিবর্তন হবে। ফরেন ইনভেস্টমেন্ট হবে, বিশেষ করে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) এখানে হচ্ছে। এর জন্য কালনা এলাকায় মধুমতি নদীর তীরে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর ৩০০ একর জমি অধিগ্রহণের একটি প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠিয়েছে জেলা প্রশাসন। শিগগিরই এ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ দৃশ্যমান হবে। ফলে অর্থনৈতিক অঞ্চলের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করবেন। এ ছাড়া জেলা শহরের অদূরেই বিসিক শিল্প নগরী হতে যাচ্ছে। এর জন্য নড়াইল সদরের ধোপাখোলা এলাকায় মহাসড়কের পাশে ৩৫০ একর জমিতে বিসিক শিল্পনগরী গড়ে তোলার জন্য অধিগ্রহণের জন্য ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) নড়াইল জেলা কর্তৃপক্ষ। এসবের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, মধুমতি সেতুর কল্যাণে নড়াইলের কৃষিও ফুলেফেঁপে উঠবে। নড়াইল জেলা সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ি চাষের জন্য বিখ্যাত। মধুমতি সেতু চালু হলে এখানকার গলদা চিংড়ি বিদেশ ছাড়াও দেশের বাজারে বাজারজাত করতে সহজ হবে। সেতু চালু হলে চিংড়ি রপ্তানিতে গতিশীলতা আরও বাড়বে। মধুমতি সেতু চালু হলে পর্যটন শিল্পেরও বিকাশ ঘটবে। চিত্রা নদী পারেই বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের স্বপ্নের ‘শিশু স্বর্গ’ও আর্ট গ্যালারি। এ ছাড়া হাটবাড়িয়া জমিদার বাড়ি, চিত্রাপাড়ের জমিদার আমলের বাঁধা ঘাট, ভিক্টোরিয়া কলেজ, অরুনিমা রিসোর্ট, চিত্রা রিসোর্ট ও নিরিবিলি পিকনিক স্পটসহ চিত্রা পাড়ের রিসোর্টগুলো ও ইছামতির শাপলার বিল ঘিরে পর্যটকদের সমাগম বাড়বে। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদচারণায় মুখর থাকবে বিনোদন কেন্দ্রগুলো। জানতে চাইলে সেতুটির প্রকল্প ব্যবস্থাপক ও সওজ নড়াইলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুজ্জামান বলেন,‘ সেতুটি গাড়ি চলাচলের উপযোগী হয়েছে। সংযোগ সড়কের কাজও শেষ। ল্যাম্পপোস্ট ও টোল প্লাজার কাজ চলছে। চীনে তৈরি ল্যাম্পপোস্টগুলো ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম নৌবন্দরে এসে পৌঁছেছে। সব মিলিয়ে বাকি কাজ এ মাসের মধ্যেই সম্পন্ন হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সময় দিলেই উদ্বোধন হবে এ সেতু। আশা করি আগামী (অক্টোবর) মাসের  যেকোনো দিন উদ্বোধন হতে পারে। ইতোমধ্যে আমাদের হাতে এসেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারি করা সেতুটির টোলের হার নির্ধারণের চূড়ান্ত প্রজ্ঞাপনের কপিটি।’

সর্বশেষ খবর