শুক্রবার, ২৭ জুন, ২০১৪ ০০:০০ টা

শেয়াল কেন হুক্কাহুয়া ডাকে?

আ.শ.ম বাবর আলী

শেয়াল কেন হুক্কাহুয়া ডাকে?

সে অনেক দিন আগের কথা।

এক বনে একসঙ্গে বাস করত একটা কুকুর আর একটা শেয়াল।

তাদের দুজনের মধ্যে খুব ভাব ছিল। খুব মিলেমিশে থাকত তারা। দুজনে একসঙ্গে মিলে যে খাবার সংগ্রহ করত, তা ভাগ করে খেতো তারা। আর সেই খাবারের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে তাদের মধ্যে কখনো কোনো ঝগড়া-বিবাদ অথবা মনোমালিন্যের সৃষ্টি হতো না।

একদিন সারা দিনেও তারা কোনো খাদ্য সংগ্রহ করতে পারেনি। এমনি করে রাত হয়ে গেছে। রাত মানে, তীব্র শীতের রাত। কড়া শীতে জঙ্গলের মধ্যে কাঁপছে তারা। ক্ষুধাও লেগেছে খুব। পেটের জ্বালা আর শীতের জ্বালা_ দুটো মিলে জীবন যায় যায়। বিশেষ করে শীতে যেন হাড়গোড় সব ভেঙে আসছে। এ অবস্থায় কি করা যায়, তাই নিয়ে ভাবছে দুজন।

এ সময় তারা দেখলো, অনেক দূরে টিমটিম করে একটা আগুনের শিখা জ্বলছে। তা দেখে শিয়ালকে বলল কুকুর, 'চলো বন্ধু, আমরা ওখানে গিয়ে ওই আগুনের মালিকের কাছ থেকে কিছু আগুন ধার করে নিয়ে আসি।'

শেয়াল অাঁতকে উঠে বলল, 'ওরে বাবারে, দরকার নেই আমার ওখানে যাওয়ার। তাপ পোহানোর জন্য ওখানে আগুন আনতে গিয়ে বেঘোরে প্রাণটা হারাই আর কি! তুমি যাও বন্ধু। তোমার শত্রু কম। তুমি গিয়ে মালিকের কাছ থেকে একটু আগুন নিয়ে এসো। আর তাছাড়া তুমি আমার চেয়ে সাহসীও বেশি।

কুকুর বলল, 'না বন্ধু, তুমি আমার চেয়ে অনেক চালাক। তাই তো লোকেরা তোমাকে শেয়াল পণ্ডিত বলে ডাকে। তোমাকে কেউ বিপদে ফেলতে পারবে না।'

এমনিভাবে দুজনের মধ্যে অনেক কথাবার্তা হলো। তারপর সিদ্ধান্ত হলো কুকুরই যাবে আগুন আনতে।

কুকুরকে বিদায় দেওয়ার সময় শেয়াল বলল, 'তুমি যাও বন্ধু। আগুন নিয়ে শীঘ্রই ফিরে এসো। আমি তোমার পথ চেয়ে থাকব। সাবধান আসার সময় পথ হারিয়ে ফেলো না। তোমার আসতে যদি দেরি হয়, আমি ভাবব, সত্যিই তুমি পথ হারিয়ে ফেলেছো। তখন তোমাকে আমি জোর গলায় ডাকতে থাকব। আমার ডাক শুনে সেই ডাক অনুসরণ করে তুমি ফিরে এসো। যাও বন্ধু যাও।'

যাত্রা দিল কুকুর। ভয়ে ভয়ে আস্তে আস্তে এগোতে লাগলো সে।

এমনি করে এক সময় গিয়ে পৌঁছলো ওই আগুনের কাছাকাছি। দেখল, বেশ দাউ দাউ করে সেখানে আগুন জ্বলছে। কিছুটা দূর থেকে সে আগুনের তাপ এসে লাগল কুকুরের গায়ে। বেশ আরাম লাগছে তার। মনে হচ্ছে, হঠাৎ করে অনেকখানি চাঙ্গা হয়ে উঠেছে সে। জ্বালানো আগুনের পাশে গিয়ে সে গুটিগুটি হয়ে শুয়ে পড়ল। ইস্! কত আরাম!! আরামে শরীরটা অলসতায় ভরে যাচ্ছে।

এমনি সময় তার নাকের মধ্যে কী সুন্দর একটা গন্ধ এসে ঢুকছে। মাথাটা একটুখানি উঁচু করে দেখলো কয়েকজন লোক ওই আগুনের মধ্যে মুরগির মাংস গরম করছে।

এ দৃশ্য দেখে শেয়ালের ক্ষুধাটা পেটের মধ্যে আরও মোচড় দিয়ে উঠল। জিহ্বাতে টকটক করে পানি এসে গেল। লোভটা তার দ্বিগুণ বেড়ে গেল। ইস্! ওই মুরগির মাংসের অন্তত কিছুটা যদি সে খেতে পারত।

ক্ষুধার সঙ্গে একরাশ লোভ নিয়ে সে উঠে পড়লো। আস্তে আস্তে এক পা-দুই পা করে এগিয়ে চলল সামনের দিকে। এসে পৌঁছাল একেবারে কাছে। টপটপ করে লালা গড়িয়ে পড়ল তার জিহ্বা বেয়ে। অপলকভাবে সে তাকিয়ে রইল মাংস টুকরোর দিকে।

এ সময় তার কাছে এলো একটা লোক। লোকটা তাকে ধমক দিয়ে বলল, 'বেটা কুকুর, তুই এসেছিস মাংস চুরি করতে? দূর হ এখান থেকে।'

কুকুরটি কাকুতি-মিনতি করে বলল, 'তুমি বিশ্বাস কর, মাংস চুরি করতে আমি আসিনি। শীতে আমি মরে যাচ্ছি। তাই এখানে এসেছি তোমাদের জ্বালানো আগুনটা একটু পোহাতে।'

কুকুরের কথা বিশ্বাস করল লোকটি। শীতে কুঁকড়ে যাওয়া কুকুরটার প্রতি তার কিছুটা দরদও হলো। তাই সে বলল, ' বেশ, ঠিক আছে। আগুন পোহা। কিন্তু শীত নিবারণ হওয়ার পরই চলে যাবি এখান থেকে। তখন কিছুতেই আর এখানে থাকতে পারবি না।'

তাতে রাজি হলো কুকুর। চার পা গুটিয়ে বসে আগুন পোহাতে লাগলো।

আগুন পোহায়ে তার শীত অনেকটা কমে গেছে বটে। কিন্তু তার পেটের ক্ষুধা কমেনি; বরং পরপর বেড়েই চলেছে। ততক্ষণে লোকেরা মুরগির মাংস নিয়ে চলে গেছে। কুকরটা তাকিয়ে দেখল, মুরগির অনেক হাড়গোড় পড়ে আছে ওখানে। কুকুরটা একটু উঠে গিয়ে ওইসব ফেলানো হাড়গুলো চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে শুরু করল। এমনিভাবে সে পেটের ক্ষুধা কিছুটা মেটালো। তারপর শরীরে কিছুটা স্বস্তিবোধ করায় আলসেমির শরীর নিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ল।

যখন তার ঘুম ভেঙে গেছে সে দেখল, ভোর হয়ে গেছে। আশ্রয়দাতা লোকটি তার কাছে এসে বলল, 'কী ব্যাপার! এখনো তুই চলে যাসনি? এখনো শীত যায়নি তোর?

কুকুর বলল, 'এখন আর আমার তেমন শীত নেই। কিন্তু একটা অনুরোধ করতে চাই আমি প্রভু তোমার কাছে?'

লোকটি জানতে চাইল, 'কি? কী আবার অনুরোধ তোর?'

কুকুর বলল, 'আমি আর বনে ফিরে যাব না। ওখানে বড় কষ্টের জায়গা। এখন থেকে আমি থাকব তোমার বাড়িতে। তোমার বাড়ি পাহারা দেব, ঘর পাহারা দেব, জিনিসপত্র পাহারা দেব। চোর তাড়াবো। সব সময় তোমার ভক্ত হয়ে তোমার পিছে পিছে থাকব। আর তোমাদের সবার ফেলে দেওয়া কাঁটামাটা, হাড়গোড় ইত্যাদি খেয়ে আমি বেঁচে থাকব। সব সময় প্রভুভক্ত হয়ে তোমার সঙ্গে সঙ্গে থাকব।'

কুকুরের কথাগুলো পছন্দ হলো লাকটির। তাই তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল সে।

সেই থেকে মানুষের বাড়িতে প্রভুভক্ত হয়ে মানুষের বাড়ি পাহারা দিয়ে যাচ্ছে কুকুর। মানুষের ফেলে দেওয়া খাবারগুলো মজা করে খেয়ে জীবন কাটাচ্ছে।

আর ওদিকে শেয়াল অপেক্ষা করছে, এখনো ফিরে আসছে না কুকুর।

শেয়াল মনে করছে, নিশ্চয়ই পথ হারিয়ে ফেলেছে বন্ধু কুকুর। তাই পথের নিশান দেওয়ার জন্য হুক্কাহুয়া হুক্কাহুয়া করে গলা ছেড়ে ডাক দিতে থাকে।

 

 

 

সর্বশেষ খবর