শুক্রবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

শীতবস্ত্র

ইলিয়াস বাবর

শীতবস্ত্র

সকাল থেকেই বেড়ে গেছে বাবার ব্যস্ততা। অন্য শনিবারের কথা অবশ্য আলাদা। তখন বাবা ঘুম থেকে ওঠে দেরিতে। আমি রেডি হতে হতে মায়ের ডাকাডাকিতে কোনোমতে বিছানা ছাড়ে। তারপর আমাকে নিয়ে স্কুলের পথে। মন ভালো থাকলে, জরুরি কোনো কাজ না পড়লে বিকালে পাশের শিশুপার্কে নিয়ে যায় আমাদের। আমাদের মানে, আমি আর বোন শোভা। বাবা তখন আমাদের সঙ্গে বাদাম চিবোয়, চিপস খায়। আমি আর শোভা যখন দোলনায় চড়ি বাবা তখন আমাদের দিকে হাসি হাসি মুখে চেয়ে থাকে। আচ্ছা, বাবাও কি আমাদের মতো ছেলেবেলা পেয়েছে? সে না পাক, আমি আর শোভা যে এরকম একটা বাবা পেয়েছি তাতেই আনন্দ। বাবা আমাকে নিয়ে রিকশা ধরে। আমি জানি, রিকশাওয়ালাকে ২০ টাকা দিলেই হবে। আমরা প্রতিদিন ওতেই যাই; বাবাও তাই দেয়। আজ আমাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে বাবা একটা অনুষ্ঠানে যাবে, তাই সকাল সকাল প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। সুন্দর একটা শার্ট পরছে, তার ওপর কোট; কী দারুণ লাগছে না বাবাকে!

—বাবা, কোথায় যাবে আজ?

—একটা অনুষ্ঠান আছে।

—তা তো জানি, কিসের অনুষ্ঠান? আমরা যাব না?

—নীলিম দেখ, তুমি পড় ক্লাস ফাইভে; মানে তুমি এখনো ছোট। আমি যাব বড়দের অনুষ্ঠানে, ওখানে তোমার কাজ নেই।

—বল না বাবা, প্লিজ।

—শীতবস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠান।

—ও, কারা করছে?

—আমরা বন্ধুরা মিলে। আজ বড় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা গরিব লোকদের কম্বল দেব।

—তাই? স্যার বলেছে, গরিবদের সাহায্য করা ভালো কাজ।

—তোমার স্যার খুব ভালো বলেছেন।

আমি কথা আর বাড়াই না। রিকশা চলছে তার মতো। আরে, শীত তো পড়ে রাতে! দিনের আলোয় কতজনকে আর পাওয়া যাবে? আমি সেদিন ছোট চাচার সঙ্গে ক্লাবে বিয়ের দাওয়াতে যাওয়ার সময় দেখছি, রাস্তার পাশে শুয়ে আছে অনেক মানুষ। গায়ে ছেঁড়া জামা, ময়লা কাঁথা তাও ছেঁড়া। ইস, কী কষ্ট হচ্ছিল তাদের! আমরা বাসায় কতকিছু গায়ে দেই, তবুও ঠাণ্ডায় জুবুথুবু হয়ে যাই, আর ওরা? ছোট চাচা বলেছে, ওরা গরিব মানুষ, টাকা নেই, বাসা নেই, কাপড়ও নেই। বুড়ো এক লোক থির-থির করে কাঁপছে। আমার বয়সী এক ছেলে মাগো মাগো করছে শীতে টিকতে না পেরে। কত মানুষ যায় রাস্তা দিয়ে কিন্তু ওদের দিকে তাকায় না, ওদের কথা ভাবে না। কই, দিনে তো ওসব মানুষকে রাস্তায় দেখা যায় না! তো বাবারা দিনের আলোয় কাদের শীতবস্ত্র দেবে? ধুর, মাথায় ধরে এসব!

—বাবা, তোমরা দিনে শীতবস্ত্র দিচ্ছ কেন?

—তো, কখন দেব?

—রাতে? হা হা হা... এই শীতের রাতে কুয়াশা খেয়ে কে বের হবে? সারা দিন চাকরি করে, ব্যবসা করে কেউ কি রাতে আসবে?

—এটা কোনো কথা হলো? রাতে যদি বের-ই না হও, তো শীতের কষ্ট বুঝবে কী করে? তোমরা মানুষের উপকার করছ?

—ছোট ছেলে ওসব বুঝবে না।

—আমি ফাইভে পড়ি, আর তুমি বল ছোট; কোনো কিছু যদি ভুল করি তখন তো ঠিকই বলবে, নীলিম তুমি এখন বড়ো হচ্ছ...

—নীলিম তো দেখি পাকা পাকা কথা জানে।

—হা হা হা... বল না বাবা দিনে কেন?

—রাতে কি আর সাংবাদিকরা ছবি তুলতে আসবে? ছবি তুলতে না পারলে তো পত্রিকায় নিউজ আসবে না। কেউ জানবে না আমাদের শীতবস্ত্র বিতরণের খবর।

—ও, তাই?

বাবা একদম চুপ। কথা শেষ হতে না হতেই দেখি বাবার কান লাল হয়ে গেছে। কপালের চামড়ায় ভাঁজ। কোনো কিছুতে ধরা পড়লে বাবার এমন হয়। রিকশা আমাকে নামিয়ে দেয় স্কুল গেটে। রিকশা বাবাকে নিয়ে চলছে তাদের শীতবস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠানের দিকে। আমার চোখে তখনো ভাসছে বাবার ধরাপড়া মুখের করুণ ছবি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর