আকাশটা বেশ ঝকঝকে। নীল। রোদও বেশ কড়কড়ে। একটু একটু হিমেল। নীল আকাশে যেন একটা অদ্ভুত সুন্দর আলোর আভা রেখে সূর্য ডুবে যাচ্ছে! প্রকৃতির এমন সৌন্দর্য দেখেও মন খারাপ দিলশাদের। খেলার মাঠ থেকে চুপিচুপি বাড়ি ফিরে এলো সে। তাদের খেলার মাঠের পাশেই ইটের ভাটা হবে। দিলশাদ দেখেছে, তার মামাদের গ্রামে ইটের ভাটা থেকে ঘন কালো মেঘ হয়ে আকাশ ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়।
দিলশাদ শহরে থাকে। শহুরে বাতাসে দম বন্ধ হয়ে আসে। এক বছর আগে মা-বাবার সাথে ঢাকা থেকে দিলশাদ যখন গ্রামে আসে, তখন গ্রামের কিছু চিনত না, বুঝতও না। এই গ্রাম তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। প্রকৃতির পাঠ নিতে দিলশাদের ভালোই লাগে। প্রকৃতি থেকে যা শেখা যায়, তা বইয়ের মাঝে নেই। অল্প কয়দিনেই অনেক কিছুই জেনেছে; চিনেছে অনেক গাছ আর ফুল-পাখি। গ্রামে ঘুরে বেশ আনন্দ আছে। তাই যেমন করে হোক, এই গ্রামের প্রকৃতি বাঁচাতে হবে।
রাতে রাজন এলো। দিলশাদ মোহাম্মদ আকাশের খুব কাছের বন্ধু শামীম আল রাজন। রাতে রাজন আসার কারণ হলো, সন্ধ্যায় খেলার মাঠ থেকে দিলশাদের ওভাবে চলে আসার কারণ জানতে। রাজনকে দেখে দিলশাদের সাহস আরো বেড়ে গেছে। রাজন খুব সাহসী কিশোর। রাজনকে ইটের ভাটা সম্পর্কে সবকিছু বুঝিয়ে বললো দিলশাদ। সবকিছু শুনে দিলশাদকে বললো, ‘চিন্তা করিস না। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে দেখা যাক আমরা কি করতে পারি।’ এই বলে রাজন চলে গেল। ভোরের কুয়াশা থাকতে থাকতেই রাজন এসে পড়লো। সঙ্গে দুটো সাইকেল। ওরা সাইকেলে করে জেলা সদরে যাবে। পরিবেশ অধিদপ্তরে অভিযোগ দেবে। রাজনের বাবা আজহারুল ইসলাম মানিক রাজনীতি করেন। সচেতন মানুষ। রাজন তার বাবার কাছ থেকেই পরিবেশ অধিদপ্তরের কথা জেনেছে। দিলশাদের সাইকেল চালাতে খুব ভালো লাগছিল। নির্জন ভোর। কেমন সাদাটে আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। আশপাশের গ্রামগুলো পুরোপুরি জাগেনি তখনো। ধূলোমাটির পথ। দু’পাশে ফসলের মাঠ। ঠান্ডা বাতাসে জলজ গন্ধ। সামনেই চায়ের স্টল। সাইকেল থেকে নেমে ওরা আখের গুড় আর তেজপাতা দিয়ে বানানো মসলাদার চায়ের স্বাদ নিলো। গরম গরম ভাপা পিঠাও খেলো।জেলা সদরে অভিযোগ করে বাড়ি ফিরে এসেছে তারা। দুপুরে খাবার খেয়ে দিলশাদ আর রাজন সকল বন্ধুকে বিকেলে মাঠে ডাকলো। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। এক এক করে সবাই আসা শুরু করেছে। ধুলজুড়ি স্কুল মাঠে গ্রামের একশো কিশোর এসেছে! এবার রাজন দিলশাদকে বললো, ‘তুই বিষয়টা সবাইকে বুঝিয়ে বল।’ দিলশাদ দশ মিনিটের মতো সবাইকে বুঝালো, গ্রামে ইটের ভাটা হলে কী কী ক্ষতি হবে গ্রামের। দিলশাদের কথা শোনার পর আব্দুল কাদির বললো, ‘ভাই আমরা কী করতে পারি?’ রাজন বললো, ‘আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করলে ইটের ভাটা বন্ধ করতে পারবো না। তবে তাদেরকে বাধ্য করবো পরিবেশ বান্ধব ইটের ভাটা করতে।’ অপু, রাহিম, সজিব ও পরশ বললো, ‘তাহলে আগামীকাল থেকে আমরা আশেপাশের স্কুলগুলোর ছাত্রদের সাথে যোগাযোগ করি। আমাদের সাথে ছাত্রছাত্রীদের যোগ দিতে বলি।' দুদিন পরের ঘটনা। এলাকার সমস্ত স্কুলের শিার্থীরা প্ল্যাকার্ড হাতে শ্লোগান দিয়ে ইটভাটার দিকে এগিয়ে আসছে। দিলশাদ প্রবল আপত্তিতে মাথা নাড়লো, ‘না, আমরা গ্রামে ইটের ভাটা হতে দেবো না।’ রাজনও তার বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। ঘটনা আঁচ করতে পেরে এবার ইটভাটার মালিক আব্দুল মোনায়েম সাহেব এগিয়ে এলেন। তিনি শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ঘটনা বাবারা? তোমরা কী কিছু বলবে?’ দিলশাদ বললো, ‘হ্যাঁ কাকা। আমরা এখানে অপরিকল্পিতভাবে ইটভাটা করতে দেবো না।’ ‘তোমরা বললেই তো আর আমি মেনে নিতে পারি না। জমিটা আমার। তোমরা বাধা দেবার কে?’ এবার রাজন বললো, ‘জমিটা আপনার, কিন্তু নির্মল পরিবেশ আমার, আমাদের সবারই প্রয়োজন। আপনি কার্বন নিঃসরণের ব্যবস্থা রেখে পরিবেশ বান্ধব ইটভাটা গড়ুন। এতে আমাদের কোনও আপত্তি নেই।’ কিশোরদের শ্লোগান চলছে। আব্দুল মোনায়েম সাহেব ধীরে ধীরে পিছু হটছেন। দুরন্ত কিশোরদের সাথে দলে দলে মানুষ ভিড় জমাতে শুরু করলো। তাদের রক্ত যেনো টগবগ করে ফুটছে।