শুক্রবার, ৯ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

মেঘবতী আর রোদফুলের গল্প

আশিক মুস্তাফা

মেঘবতী আর রোদফুলের গল্প

মেঘের মতো রং মেয়েটার। যেন বর্ষার বৃষ্টি ধোয়া মেঘ। ওই যে, বৃষ্টি হয়ে গেলে মেঘ যেমন দেখায়; ঝকঝকে তকতকে। তেমনই। তাই দিদান তাকে মেঘবতী বলেই ডাকে। বড্ড আদুরে মেয়ে। দিনের প্রথম রোদটা পড়ে মেঘবতীদের উঠোনে। তারপর ফুল হয়ে ফোটে। রোদের ফুল। বলবে, রোদের আবার ফুল হয়? বলি, হয় তো। একটু খেয়াল করলেই দেখবে। তবে রোদফুল কোনো গাছে ফোটে না। ফুটে টিনের চালে। লাউয়ের মাচায়। উঠোনে। আর মেঘবতীর মেঘরঙা গালে। মুখে। এই মেঘরঙা ছোট্টমোট্ট মেঘবতীকে সেদিন সকালের নতুন আলোয় ডেকে তোলেন দিদান। তারপর বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। খালি পায়ে হাঁটে দুজন। মেঘবতীদের বাড়ির পশ্চিমে ওই একটাই মাটির রাস্তা। আর সব পিছঢালা। দিনমান গাড়ি চলে সেসব পথে। বড় গাড়ি চলে যায় সাঁই করে। হর্ন দিয়ে। মাটি কাঁপিয়ে। দিদান বলে, দেখলি দাদু ভাই, বুকের উপর দিয়ে যেন চলে গেল গাড়িটা। মেঘবতী বুঝে না এসব ভারী কথা। তবে দিদানের মতো তারও এমন ধুলো আর পাথরের গুঁড়ো উড়িয়ে সাঁই করে চলে যাওয়া গাড়ির শব্দ ভালো লাগে না। ভালো লাগে না পিচঢালা পথও। তাই সে পথ রেখে তারা মাটির রাস্তা ধরে হাঁটে। কয়েকটা বাড়ি ছাড়িয়ে যেতেই পড়ে গনশার বিল। ধান কাটা হয়ে গেছে। সকালের সোনা রোদে শালিক হাঁটে পায়ে পায়ে। কেটে নেওয়া ধান গাছের গোড়া খুঁটে। পোকা মাকড় খায়। গাঙশালিকেরা উড়ন্ত পোকা ছোঁ মেরে ধরে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে এসব দেখে মেঘরঙা মেয়েটি। রোদ এসে পড়ে পথের ধারের ছোট্ট বেলি ফুলের গাছে। গাছের ছায়া পড়ে মেঘবতীর মুখে। আর অমনি তার আদুরে গালে ফুটে ওঠে রোদফুল। পাতার পোকর গলে যে রোদ এসে পড়ে তার গালে-মুখে সেটি ফুলের মতো ফুটে। বাতাস আলতো দুলিয়ে দেয় গাছের ডাল-পাতা। দুলতে থাকে রোদফুলও। এই দোল খাওয়া রোদ ফুলের দরদ গায়ে মেখে দিদানের সঙ্গে হাঁটতে থাকে মেঘবতী।

একটু এগুতেই তাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায় একঝাঁক কবুতর। মেঘবতী আনন্দে হাততালি দেয়। তাদের ওড়ার গতি বাড়ে। ঘাড় কাত করে উপরে তাকায়। মেঘের দিকে। সকালের নতুন রোদের ঝিলিক কবুতরের পাখায়। চক্কর কেটে উপরে উঠতে থাকে। উঠতেই থাকে। আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসে। তারপর যেন মেঘের সঙ্গে মিলিয়ে যায়। মেঘবতী কপালে হাত ঠেকিয়ে এইটুকুন দুটো মায়াবী চোখে আকাশে খুঁজতে থাকে। পায়রার ঝাঁক। তাকিয়েই থাকে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। দিদান আয় আয় ডাকে পায়রাদের। সেই ডাক বাতাস ভাসিয়ে নিয়ে যায় পায়রাদের কানে। দূরে, বহু দূরে দেখা যায় বিন্দু বিন্দু পায়রাদের। তারপর বড় হতে থাকে। কাছাকাছি এসে চক্কর দিয়ে ঘোরে। ডিগবাজি খেয়ে নামে বিলে। ধানখেতের আলে হাঁটে। থেকে থেকে ডাকে বাক-বাক-বাকুম-ম-ম্্। এখানে-ওখানে পড়ে থাকে ধানের ছড়া। ধানের বেঁটেখাটো গোড়া আর আগাছার ফাঁকে মুখ ডুবায়। মাথা তুলে এদিক সেদিক তাকায়। ফের ভাঙা ধানে মন দেয় পায়রার দল। তারাও মন দেয় হাঁটায়। একটু এগিয়ে যেতেই লাল মোহনদের বাড়ি। বাড়ির সামনে একদঙ্গল ছেলেমেয়ে। ভাত-তরকারি রান্না করে। পাতা-লতা দিয়ে। কলাপাতার থালা বাটি। পাশেই তুলসী গাছ। রোদ পড়ে গাছে। গাছের পোকর গলে মাটিতে। ফুটে উঠে রোদফুল। মেঘবতীকে ডাকে ছেলেমেয়েরা। ডাকে রোদফুল। কাছে যেতেই হেসে ওঠে। তারপর খাওয়ায় মন দেয়। ধুলোবালি আর পাতা-লতার খাবার। এরচেয়ে ভালো খাবার যে খেতে পারে না তারা। খাবেইবা কেমন করে। ‘দিন আনে দিন খায়’ পরিবার তাদের। ফুরফুরে একটা বাতাস আসে। উড়িয়ে নিয়ে যায় কলাপাতার থালা বাটি। রোদও আড়াল হয় মেঘের। ঘুম ভেঙে যায় মেঘবতীর। মা ডাকেন, ‘উঠে যা তুতুন। মেঘ করেছে। বৃষ্টি আসবে। গায়ে পানি পড়বে।’ মেঘ করলেই তুতুনের মায়ের ভয়। এই বুঝি বৃষ্টি এলো। এই বুঝি চালের ফুটো দিয়ে পানি পড়ে বিছানা ভাসিয়ে নিল! ছোট্টমোট্ট আদুরে মেয়েটি আড়মোড়া ভাঙে। হাতের পিঠ দিয়ে চোখ ডলে। বিছানা থেকে নেমে আসে দরজায়। তাকায় উঠোনের কোণে। বড় বেলগাছের তলায়। নেই রোদ। নেই রোদফুল। আঁধার করে মেঘ আসে। ঝুপঝাপ বৃষ্টি নামে। তার আফসোস-রোদফুলটা কেন আরেকটু থাকে না!

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর