শুক্রবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

জন্মদিনের উপহার

জয়শ্রী দাস

জন্মদিনের উপহার

করোনাকালে শিক্ষার্থীদের আনাগোনা নেই, ক্যাম্পাসের চারদিকে সুনসান। পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ড. রফিক আনোয়ার ও ড. রেহনুমা আনোয়ারের ২৪ বছরের সংসার গড়ে উঠেছে ক্যাম্পাসের একটি বাড়ির দোতলায়। বাড়িটির নাম ফুল রেনু। ড. রফিক পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হলেও শিশু-কিশোরদের জন্য লেখালেখি করেন। তারা নিঃসন্তান দম্পতি। ২৪ বছরে তাদের কোলজুড়ে সন্তান আসেনি। বাড়িটির পেছনের দিকে বড় বড় সেগুনগাছ, আর ঘুটঘুটে অন্ধকার। গাছের পরে একটি দেয়াল, যেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানায়। পূর্ণিমার আলোতে উজ্জ্বল চারিধার, কাছেপিঠে কোথাও হঠাৎ শিয়াল ডেকে উঠল। রাত প্রায় বারোটা। এই শীতের মধ্যে দোতালার জানালা খুলে ড. রফিক লিখেছেন। তিনি অন্ধকারের দিকে তাকালে বিভিন্ন গল্পের আইডিয়া খুঁজে পান। হঠাৎ করেই বাড়ির বাইরে জঙ্গল থেকে একটি শিশুর কান্নার শব্দ আসে। তিনি দৌঁড়ে নিচে নামেন। নামার শব্দে তার স্ত্রীও উঠে যান। টর্চ লাইট নিয়ে পাহারাদারসহ বাড়ির পেছনে উপস্থিত হন। সবার মুখের ভাষা হারিয়ে যায়। পাতলা পলিথিনের ব্যাগের মধ্যে ছোট্ট একটি দেব শিশু দেখতে পায় সবাই।

ড. রফিক শিশুদের ভীষণ ভালোবাসেন, তিনি কাঁদতে কাঁদতে শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। সাথে সাথে সবাই মিলে কাছের হাসপাতালে শিশুটিকে ভর্তি করে। তারপর থানায় খবর দেয়।

বেশ কিছুদিন আইনি জটিলতার শেষে নিঃসন্তান দম্পতি ড. রফিক আর রেহনুমা শিশুটির মা বাবা হন। তারা ছেলে শিশুটির আদর করে নাম রাখেন ফাল্গুন। ফাল্গুন বড় হচ্ছে। মা-বাবা তাকে বুকে আগলে রাখেন। ফাগুন আকাশ দেখে ছবি আঁকে, বাতাসের শব্দে গানের ছন্দ খুঁজে বেড়ায়, ফুলের রেণু গায়ে মাখে ফাগুন নেচে নেচে ঘুরে বেড়ায় ফুলের বাগানে। মা-বাবার স্বপ্নজুড়ে ফাগুন। মা বলেন ডাক্তার হবে, বাবা বলে লেখক। আদরে আদরে ফাগুনকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখে দুজন।

আজ ফাগুনের সপ্তম জন্মদিন। সকালের আলো ফুটতেই ঘুম থেকে উঠে ফাগুন। মা ফুল দিয়ে ঘর সাজিয়ে দিচ্ছে, আর বাবা বেলুন দিয়ে। কি আনন্দ কি আনন্দ বলে শেষ করা যাবে না। এ আনন্দে ফাগুনের খুব মন রঙের প্রজাপতির সাথে খেলতে চাচ্ছে। ফাগুন দরজা খোলে। সে অবাক হয়ে যায়। দরজার সামনে প্যাকেট করা বক্স।

সেটি তুলে নিয়ে ফাগুন মায়ের হাতে দেয়। মা-বাবার দুজনের মুখেই কালো। মা খুবই মিহি স্বরে বলেন, ‘বাবা তোমাকে একটু কথা বলার ছিল।’

-আচ্ছা মা, পরে বল। আগে বক্সটা খোলো না।

বক্সটার মধ্যে দামি কিছু চকলেট, গল্পের বই, আর একটি চিঠি। হাতে নিয়ে ফাগুন নিজেই চিঠিটা পড়া শুরু করল,

প্রিয় বাবা,

আমি ও আমার বন্ধু এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম। অনার্স পড়ার সময় আমার বাড়ি থেকে বিয়ে ঠিক হয়। কিন্তু আমি তোমার বাবাকে খুব ভালোবাসি। তাই তোমার নানা-নানুর অমতে তোমার বাবাকে বিয়ে করে ফেলি। আমাদের সংসার জীবন ভালই চলছিল। বিশ্ববিদ্যালয় পেছনে ছোট ঘরভাড়া নিয়ে থাকতাম। দুজন টিউশনি করে চলছিলাম। হঠাৎ তুমি চলে এলে আমার মাঝে। এরমধ্যে শুরু হয় করোনাকাল। আমাদের টিউশন বন্ধ হয়ে যায়। আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমার বা তোমার বাবার পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ দেখতে আসে না। খাবার নেই, ঘরভাড়া দিতে পারি না। বন্ধুদের কেউ কেউ সাহায্য করতে লাগল। অভাবের মধ্যে তোমার জন্ম হয়। ভয়ানক অভাব। এখন যারা তোমার বাবা-মা। তারা আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ছিলেন। দুজনই শিশুদের খুব পছন্দ করেন। তাই আমি আর তোমার বাবা দু’জন মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম। এই দুর্দিনে স্যার আর ম্যাডামের কাছে তোমাকে রেখে যাবো। তুমি দুধে ভাতে সুখে থাকবে। তাই করলাম। কিন্তু প্রতিদিন এই বাড়ির আশপাশে ঘুরতাম। এখন আমি বড় চাকরি করি। তোমার বাবাও ভালো চাকরি করেন। এরপরও তোমাকে এত ভালো দুটো মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার ইচ্ছে আমাদের হয় না। তুমি ভালো থেকো, ভালো মানুষ হও। পারলে আমাদের দু’জনকে ক্ষমা করো দিও।

ইতি

তোমার হতভাগ্য মা।

চিঠি পড়া শেষে ছোট্ট ফাগুন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ড. রফিক ও ড. রেহনুমার দিকে। ফাগুনকে জড়িয়ে ধরেন ড. রেহনুমা ও আনোয়ার। ফাগুন বড় হচ্ছে। প্রতিবছর তার জন্মদিন আসে, এমনি করে কেউ একজন উপহার হিসেবে কিছু রেখে যায়।

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর