চারিদিক নিস্তব্ধ। মেঘের অমাবস্যা রূপ। পাখিরা বাসায় ফেরার জন্য ছুটছে। শিকারের খুঁজতে বের হওয়া সিংহ ও তার ছানা তখনো শিকারে ব্যস্ত। হঠাৎ দূর পাহাড়ের ওপার থেকে তুমুল বেগে ছুটে আসে বাতাস। শনশন শব্দে কেঁপে ওঠে বন। সিংহ ছানা একটু দূরে দাঁড়িয়ে মায়ের শিকার করার কৌশল রপ্ত করছে। বাতাসের ভয়ঙ্কর শব্দে সে দৌড়ে আসে মায়ের কাছে। মা ছানাকে নিয়ে গুহার দিকে ছুটছে। এদিকে প্রচণ্ড ঝড় উড়িয়ে দিচ্ছে সবকিছু। গাছের ডালপালা ভেঙে পড়ছে!
ঝড়ের কবলে পড়ে ছানাটি ছিটকে যায় তার মায়ের কাছ থেকে। সিংহ তার ছানাকে খুঁজতে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ায়। কিন্তু কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। পাগলপ্রায় সিংহ ঝড় থেকে বাঁচতে একটি গাছের কোটরে গা-ঢাকা দেয়। ঝড় থামলে ছানাকে খুঁজে বের করে তবেই গুহায় ফিরবে। সে শুধু তার ছানার কথাই ভেবে যাচ্ছে। এইতো সেদিন আমার ছানাটা দুনিয়ার আলো দেখেছে। ওর জন্মের সময় সারা বনে উৎসবের আয়োজন করেছিল রাজা। কত আনন্দ ছিল ছানাকে ঘিরে। আর এখন প্রাণের সন্তানকে পাওয়া যাচ্ছে না! কাঁদতে থাকে মা সিংহ।
হঠাৎ একটা কী যেন তার কোটরের সামনে এসে ‘মাগো’ বলে চিৎকার করে ওঠে। সে উঁকি দিয়ে দেখে একটি ছাগল ছানা। হয়তো ঝড়ের কবলে পড়ে এখানে এসেছে। মা সিংহ ওই ছাগল ছানাকে কোটরে নিয়ে আসে। ছানাটি ব্যথায় কাঁদছে। সে সিংহকে দেখে আরও জোরে কাঁদতে থাকে। সিংহ বলে, ‘কেঁদো না বাছা। তুমি এখন সুরক্ষিত।’ছানাটি বলে, ‘তোমার কাছে আমি সুরক্ষিত? তুমি তো এখনই আমাকে খেয়ে ফেলবে।’
সিংহের চোখে জল চলে এলো। সে বলে, ‘আমি একজন মা। আমারও একটা সন্তান আছে। আমার ছানাও হারিয়ে গেছে। আমি বুঝি সন্তান হারিয়ে গেলে মায়ের কত কষ্ট হয়। ভয় পেয়ো না, আমি তোমাকে খাবো না। ঝড় থামুক, তোমাকে তোমার মায়ের কাছে পৌঁঁছে দেবো।
ছানা বলে, সত্যি?
সত্যি সত্যি সত্যি। সিংহ ছানাটিকে আদর করে দেয় আর নিজের ছানার কথা ভাবতে থাকে।
কিছুক্ষণ পর ঝড় থামে। সিংহ ছাগল ছানার আবাসস্থলের ঠিকানা জেনে নেয় ছানার কাছ থেকে। সে উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। মাঝেমধ্যে এদিক-সেদিক তাকায় নিজের ছানার জন্য। পথে অনেকের সঙ্গে দেখা হয়। জিজ্ঞেস করে তার ছানার কথা। কিন্তু কেউ দেখেনি।
পথিমধ্যে বাঘের সঙ্গে দেখা হলে বাঘ বলে, ‘তুমি কি পাগল হয়ে গেছ সিংহ? কাছে শিকার রেখে না খেয়ে ওকে নিয়ে যাচ্ছ কোথায়?
সিংহ বলে, ‘ওকে বাড়ি পৌঁছে দিতে।’ বাঘ হাসতে থাকে। সিংহ এগিয়ে চলে ছাগলের বাড়ির দিকে।
বনের শেষে একটি ছোট্ট পুরনো বাড়িতেই ছাগল ছানাকে নিয়ে উপস্থিত সিংহ। সিংহকে দেখে কেউ বের হয় না। সবাই শঙ্কিত। মা ছাগল তার ছানাকে দেখে দৌড়ে আসে। সিংহকে কুর্নিশ জানিয়ে ছানাকে জড়িয়ে ধরে। ছানাও মাকে পেয়ে আনন্দিত। মা ছাগল বলে, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। এই উপকারের কথা ভুলতে পারব না।
সিংহ বলে, ‘আমিও একজন মা। আমার ছানা এই ঝড়ে হারিয়ে গেছে। আমি যেমন আমার ছানার জন্য ব্যাকুল তুমিও তাই ছিলে। তাই ওকে ফিরিয়ে দিয়ে গেলাম।’ ছাগল বলে, ‘আপনার ছানা! আমি কলাবাগানে একটি সিংহ ছানাকে কাঁদদে দেখেছি। কিন্তু ভয়ে ধারে-কাছে যাইনি। চলুন আমার সঙ্গে।’ দেখুন আপনার ছানা কি না। মা সিংহ দৌড়ে যায়। দেখে তার ছানাই পড়ে আছে। জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নেয় মা। ছানাকে পেয়ে সেও অনেক খুশি। ছাগলকে ধন্যবাদ জানায় সে। সিংহ বলে, ‘ঝড় এসে সবকিছু তছনছ করে দেয়। কিন্তু আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব সব ঝড় সামলে উঠার শক্তি জোগায়। ভালো থেকো তোমরা। আর কখনো তোমাদের ওপর অত্যাচার করবে না কেউ। কথা দিয়ে গেলাম।’