শুক্রবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

আদির ঘুড়ি

শামীম শিকদার

আদির ঘুড়ি

হক দাদা বিভিন্ন আকারের ঘুড়ি তৈরি করেন। তার হাত বেশ দক্ষ। ঘুড়ি তৈরিতে তার সুনাম রয়েছে কয়েক গ্রামজুড়ে। বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ এখানে আসে। দক্ষ হাতের ছোঁয়ায় চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করে নিয়ে যায় বাহারি ডিজাইনের ঘুড়ি। ছোটদের পাশাপাশি বড়রাও ভিড় করে ঘুড়ি নিতে। আগে দাদা বিনা পয়সায় ঘুড়ি তৈরি করে দিত। এখন চাহিদা বাড়ায় কিছু টাকা দিতে হয়। তবুও দাদার ব্যস্ততার শেষ নেই। সারা দিন কাজ করেও রাতের অর্ধেক সময় পর্যন্ত কাজ করতে হয় তাকে। দাদার বাড়ির আশপাশের লোকজন তার ব্যস্ততা দেখে এ কাজ ছেড়ে দিতে বলে। দাদার এক উত্তর, আমি টাকার জন্য কাজ করি না। ছেলেগুলোর একটু বিনোদনের দরকার আছে। দাদার মুখে এমন কথা শুনে প্রতিবেশীরা হাসে।

তাতে কি, মানুষকে আনন্দ দিয়ে অজানা সুখ পায় হক দাদা। কে কী বলল তা শোনার সময় একেবারেই নেই তার। পুরো কুরুলিয়া গ্রামে দাদা একাই সবার ঘুড়ি বানিয়ে দেয়। প্রতিটি পাড়ায় আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর ধুম পড়েছে। এতে প্রতিদিন বাড়ছে নতুন নতুন ক্রেতা। তার মধ্যে একজন আদি। প্রায় প্রতিদিনই তার নতুন ঘুড়ি চাই। আবার তাতে থাকতে হবে ভিন্ন ভিন্ন রং ও ডিজাইন। আদির পড়ার টেবিলে এখন ঘুড়ি। শুধু পড়ার টেবিল নয়, ঘরজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বাহারি রকমের ঘুড়ি। সবই হক দাদার তৈরি। এত ঘুড়ি থাকার পরও তার তৃপ্তি মিটে না। দু-একদিন পর পর তার প্রয়োজন হয় নতুন ডিজাইন করা ঘুড়ির। দাদা এক প্রকার বাধ্য হয়ে আদির চাহিদা পূরণ করে। তবে সে বাবা-মার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ঘুড়ি তৈরির কাগজ কিনে দেয় দাদাকে। দাদার বড় ছেলে মিজানের প্রথম সন্তান আদি। প্রথম নাতি হওয়ায় ভালোবাসাটাও অনেক বেশি। এক এক করে পূরণ করতে হয় একমাত্র নাতির বায়নাগুলো।

ঘুড়ি বানানোর আগে দাদাকে হক নামেই লোকজন চিনত। কিন্তু যখন ঘুড়ি বানানো শুরু করল, পরিচিত হলো লোকজনের সঙ্গে। হক থেকে সবার কাছে দাদা নামে পরিচিতি পেল আদির দাদা। গ্রামের ছোট-বড় প্রায় সবাই এখন আদির দাদাকে দাদা নামেই চিনে। নতুন নতুন নানা ডিজাইনের ঘুড়ির কারণে আদিও বেশ পরিচিত। ব্যতিক্রম বৈশিষ্ট্যের জন্য গ্রামের মানুষ তাকে ঘুড়িওয়ালা বলে ডাকে। প্রতিদিন বিকালে পাড়ার মাঠে সবাই নিজেস্ব ঘুড়ি নিয়ে আসে। কার ঘুড়ি কে কাটতে পারে তা নিয়ে হয় প্রতিযোগিতা। 

আদি কুরুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। এখন স্কুল ও কোচিং একেবারে বন্ধ। এই অবসর সময়ের আড্ডায় পাড়ার সবার সঙ্গে তার একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়েছে। তাকে সবাই খুব আদর করে; কারণ তাদের পুরো পাড়ার মধ্যে সে সবার ছোট। ছোট হলেও ঘুড়ি ওড়ানোতে তার হাত বেশ দক্ষ। একদিনে এ দক্ষতা হয়নি। সবাই যখন বিকালে আকাশে ঘুড়ি ওড়ায় সে তখন সকাল-বিকাল দুই বেলায়ই ঘুড়ি ওড়ায়। দূর থেকে দেখলেই বোঝা যায় আদির ঘুড়ি আকাশে ওড়ছে। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, বেগুনি নানা রঙের ঘুড়ি তার। দূর থেকেই সবার নজর কাড়ে আদির ঘুড়ি। এসব বাহারি ঘুড়ির আবার সুন্দর সুন্দর নামও রয়েছে। চারকোনা আকৃতির বাংলা ঘুড়ি, ড্রাগন, বক্স, মাছরাঙা, ঈগল, ডলফিন, অক্টোপাস, ব্যাঙ, সাপ, মৌচাক, কমরাঙা, প্যাঁচা, আগুন পাখি, ফিনিক্স, জেমিনি, চরকি লেজ, চিলঘুড়ি, তারাঘুড়িসহ আরও কত বাহারি নাম। সব নামই আদির মুখস্থ। কয়েক দিন পর পর দাদার কাছে বয়না ধরে বিভিন্ন নামের ঘুড়ি বানানোর জন্য। দাদাও না বলার পাত্র নয়। আদি যে রঙিন কাগজ এনে দেয় তা দিয়েই বানানো হয় ঘুড়ি। এ ঘুড়ি দিয়েই বিকালে মাঠে চলে লড়াই। কখনো আবার নাটাইয়ের সুতা ছিঁড়ে ঘুড়ি গিয়ে পড়ে অন্য কোনো পাড়ায়, আটকে থাকে গাছের ডালে। তখন চলে কে আগে সুতা ছেঁড়া ঘুড়িটি হাতে পাবে তার প্রতিযোগিতা।

আদির খুব কাছের বন্ধু অর্ণব। তারা দুজন সব সময় একসঙ্গেই থাকে। ঘুড়িও দুই বন্ধু মিলেই উড়ায়। সময় অসময় ঘুড়ি ওড়ানোর কারণে বেশ কয়েকবার আদিকে মায়ের বকুনি শোনতে হয়েছে। আজ সকালটাও এর ব্যতিক্রম যায়নি। তবে বাবা বাড়িতে থাকলে বকুনির স্থায়িত্বটা কিছুটা কমে। কে শোনে কার কথা। তার নেশা একটাই, ঘুড়ি ওড়ানো ও সংগ্রহে নতুন নতুন ঘুড়ি রাখা। তার অনেক পুরনো ঘুড়ি বন্ধু অর্ণবকে দিয়েও দিয়েছে। দুই বন্ধু সারা দিন ঘুড়ি ওড়ায়। সব সময় তাদের পাওয়া যায় পাড়ার বড় মাঠটিতে।  দেখা যায়, তারা হয়তো আকাশে ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে আছে নয়তো ঘুড়ির সুতা ধরে একে অপরের সঙ্গে গল্প করছে।  আদিকে যখনই বাইরে কেউ দেখে তখন একটু জোর গলায় বলে, কিরে ঘুড়িওয়ালা ঘুড়ি ওড়াতে মাঠে যাস না কি?

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর