ফাতিহা একটি ছোট্ট গ্রামে বাস করে। তার বাড়ির সীমানা ঘেঁষে গ্রামের রাস্তা চলে গেছে। বাড়ি বরাবর রাস্তার ওপাশে একটি ছোট খেত। খেতটি তাদেরই। দাদু মাঝে মধ্যে সেখানে শাকসবজির চাষ করেন। তবে এখন খেতে কোনো শাকসবজি নেই। খেতটি সবুজ ঘাসে ঢাকা। খেতের চারপাশে কিছু ছোট ছোট গাছ। খেতের এক কোণে, রাস্তার কাছাকাছি একটি ডালপালা ছড়ানো বড় আমগাছ দাঁড়িয়ে আছে। ফাতিহা মাঝে মাঝে গাছটির নিচে গিয়ে বসে। আমগাছটি তার বন্ধুর মতোই। সে আমগাছের সঙ্গে কথা বলে। নানান রকম প্রশ্ন করে। আমগাছ কোনো প্রশ্নের জবাব দেয় না। কিন্তু ফাতিহা নিজেই নিজের প্রশ্নের জবাব দেয়। কখনো কখনো নিজের কথায় নিজেই হেসে দেয়। কখনো কখনো খুব খুশি হয়। খুশিতে হাততালি দেয়।
ফাতিহার সঙ্গে যখন তার বন্ধুরা থাকে, সঙ্গে অনেক খেলনা নিয়ে যায়। আমগাছের ছায়ায় বসে সবাই মিলে খেলা করে।
আমগাছটির ডালে ডালে অনেক পাখি বাসা করেছে? সারাক্ষণ পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত থাকে চারপাশ। পাখির কিচিরমিচির ফাতিহার ভালো লাগে। সে মাঝে মাঝে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে পাখির ওড়াউড়ি দেখে। খুশিতে তার মন ভরে যায়।
এভাবে প্রতিদিন, ফাতিহা তার বন্ধু আমগাছের সঙ্গে দেখা করে। কিন্তু একদিন যখন ফাতিহা বাগানে আমগাছের কাছে গেল, সে এমন কিছু দেখল যা আগে কখনো খেয়াল করেনি। সে দেখল, আমগাছটির কিছু ডালপালা ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে। গাছের নতুন বের হওয়া পাতাও হলদে হয়ে যাচ্ছে। সে আর এক মুহূর্তও দেরি করল না। দৌড়ে বাড়ি গিয়ে তার দাদুকে নিয়ে এলো। তারপর আমগাছটিকে দেখিয়ে এসব পরিবর্তনের কথাও বলল। ফাতিহার দাদু গাছ আর গাছে চারপাশের পরিবেশ ভালো করে দেখলেন। তারপর দাদু ফাতিহাকে বললেন, দেখ দাদুভাই, আমগাছের চারপাশে প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিন ব্যাগ ছাড়াও অসংখ্য আবর্জনা স্তূপ হয়ে আছে। এসব প্লাস্টিকের বোতল আর পলিথিন সহজে পচে না। উপরন্তু এগুলোর কারণে গাছ মাটি থেকে সম্ভবত প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও ম্যাগনেশিয়াম নামক খনিজ লবণ গ্রহণ করতে পারছে না। তাই দিন দিন এরকম শুকিয়ে যাচ্ছে। আর পাতাও হলদে ও বাদামি হয়ে ঝরে যাচ্ছে। এখনই গাছের চারপাশের এসব আবর্জনা ও দূষক পদার্থ সরিয়ে ফেলতে হবে। তুমি এখানেই থাক। আমি বাড়ি থেকে আসছি।
দাদু বাড়ি গিয়ে কিছুক্ষণ পরই ফিরে এলেন। সঙ্গে নিয়ে এলেন কোদাল, ঝুড়ি, পাটের বস্তা ও একটা বড় বালতি। দাদু প্রথমে প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিন ব্যাগ ও অপচনশীল জিনিসগুলো কুড়িয়ে বস্তায় ভরলেন। ফাতিহাও দাদুর দেখাদেখি বোতল আর পলিব্যাগ কুড়িয়ে বস্তায় ঢুকাল।
এরপর দাদু কোদাল দিয়ে ঝুড়িতে আবর্জনা তুলে খেতের অন্য কোণের একটা ছোট গর্তে ফেলে মাটি দিয়ে ঢেকে দিলেন। তারপর কোদাল দিয়ে কুপিয়ে গাছের চারপাশের মাটি আলগা করে দিলেন। আর বাড়ি থেকে গিয়ে কিছু গোবর সার এনে গাছের চারপাশে গোড়ায় ছড়িয়ে দিলেন। পানি দেওয়ার জন্য শক্ত মাটি তুলে এনে গাছের চারপাশে একটা সরু বৃত্তাকার বাঁধ দিয়ে দিলেন। সবশেষে বালতি দিয়ে পুকুর থেকে পানি এনে সেই বাঁধের মধ্যে ঢেলে দিলেন। গাছের গোড়ার আলগা করা মাটি আস্তে আস্তে সেই পানি শুঁষে নিল।
দাদু কাজ শেষ করে ফাতিহাকে নিয়ে সবুজ ঘাসে বসলেন। তারপর বললেন, দাদুভাই আজকের মতো আমাদের কাজ শেষ। এভাবে নিয়মিত গাছের গোড়ায় পানি দিতে হবে। আর প্লাস্টিকের বোতল, পলিব্যাগ কিংবা আবর্জনা যেন না জমে সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। কারণ পরিবেশ দূষণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গাছপালার মৃত্যুর কারণ। কিন্তু অনুকূল পরিবেশ ও পুষ্টি পেলে গাছটি সব সময় সতেজ থাকবে।
ফাতিহা এরপর থেকে নিয়মিত গাছে পানি দিচ্ছে। আর খেয়াল রাখছে যেন চারপাশ পরিষ্কার থাকে। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর আমগাছটি আবার সতেজ হয়ে উঠল। ফাতিহা যেন বন্ধু আমগাছটির প্রতিটি পাতা ও ডালে খুশির ঝিলিক দেখতে পেল। বাতাসে দুলেদুলে আমগাছটি যেন তার বন্ধুর চমৎকার উদ্যোগের জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছে। এমন পরোপকারী বন্ধুকে কি ধন্যবাদ না দিয়ে থাকা যায়!
ফাতিহা আবার একদিন দাদুকে ডেকে এনে গাছটি দেখাল। আর জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ দিল। দাদু ফাতিহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আর বললেন, আমাদের বেঁচে থাকার জন্য, আরও সহজ করে বললে শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য অক্সিজেন দরকার। গাছ থেকে আমরা সেই অক্সিজেন পাই। গাছ আমাদের পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই বেশি বেশি গাছ লাগাতে হবে। আর গাছকে বাঁচিয়ে রাখতে আমাদের পরিবেশকেও দূষণমুক্ত রাখতে হবে। প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার সীমিত করতে হবে। প্রয়োজনে আমাদের পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহার করতে হবে, যেগুলো আমাদের পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখবে।
নিশ্চয় দাদু। ফাতিহা দাদুকে জড়িয়ে ধরেই বলে উঠল। শুনে দাদু খুশি হলেন। আনন্দে দাদুর চোখ দুটো চকচক করে উঠল।