চারদিকে হাওড়, তার মধ্যেই অবস্থিত ছোট্ট একটি গ্রাম। গ্রামটির নাম গোবিন্দশ্রী।
গ্রামের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে একটি নদী।
বাড়ির সামনে থেকে নদীর ওপারের ভাসমান ঝোপটির ওপর অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আতিক। ঢোল কলমি আর কচুরিপানার সমন্বয়ে ঝোপের ওপর আনমনে বসে আছে মাছরাঙা এবং বক পাখিরা। সেই বক পাখিদের সঙ্গেই আতিকের পোষ মানা বকের ছানাটি উড়ে গিয়ে মাছ ধরতে যেত। কিন্তু আতিকের বকটিকে দেখে সহজেই বোঝা যেত যে কারও গৃহপালিত, কারণ তার ধূসর পালকের ওপর রঙের কারুকাজ দেখে যে কেউ মুগ্ধ হয়ে যাবে। আতিক তার দাদুর কাছ থেকে আষ্ট আনা পয়সা নিয়ে লাল রং কিনে এনে লাগিয়ে দিয়েছিল।
সেই কবে বকের ছানাটিকে নিয়ে এসেছিল আতিক তার নানার বাড়ি থেকে। তখন জ্যৈষ্ঠ মাস রাতের বেলা প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় হওয়ায় অনেক পাখির বাসা ভেঙে গেছে। এমনকি অনেক পাখি ওই দিন রাতে মারা গিয়েছিল। ভাগ্যক্রমে সেই বকের ছানাটি মরে নাই। রাতের বেলা ঝড় থেমে যাওয়ার পর বাড়ির সবাই যখন আম কুড়াতে ব্যস্ত হয়েছিল তাদের সঙ্গে আতিকও বের হয়েছিল। ঝড় বাদলের পর আম কুড়ানোর মজাই অন্যরকম তা আবার যদি মামার বাড়ি হয় আহ কী মজা।
আম কুড়ানোর সময় হঠাৎ আতিকের চোখে ভেসে উঠে পালক গজানোহীন অসহায় বকের ছানাটি। ছানাটিকে দেখে আতিকের খুব মায়া হয়। সে কোমল হাতে বকের ছানাটিকে তুলে সোজা তার নানুর কাছে নিয়ে এলো।
আতিকের নানু বকের ছানাটি দেখে শাসিয়ে বলে-
এই এটি এনেছ কেন সোজা রেখে আসো।
আতিক আমতা আমতা করে তার নানুকে বলতে শুরু করেছে-
এই ঝড় বাদলে ছানাটি তার বাসা থেকে পড়ে গিয়ে বেঁচে আছে কোনো রকমে। জানি না তার বাবা-মা বেঁচে আছে কি না। এমনকি তার ভাই-বোন। এখন তাকে ফেলে দেওয়া মানে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া, সে হোক না বকের ছানা, তারও একটি প্রাণ আছে। সেটা আমি কিছুতেই করতে পারব না নানু
তাহলে কী করবা?
আমি তাকে লালনপালন করব।
আতিকের নানু মুচকি হাসি দিয়ে বলছেন-
তোমাকেই তো আমরা লালনপালন করছি। কারণ তুমি ছোট মানুষ। তুমি আবার বকের ছানাকে লালনপালন করবে?
তুমি কি জানো বকেরা মানুষের চোখ খেয়ে ফেলে সুযোগ পেলেই।
আতিক একটু ভয় পেয়ে গেল। সে কৌতূহলী তার নানুকে জিজ্ঞেস করল-আমি জানি বকেরা মাছ, পোকামাকড়, তার সঙ্গে শামুক খেয়ে বেঁচে থাকে। কিন্তু মানুষের চোখ খায় সেটা তো আমি জানতাম না।
আর মানুষের চোখ কেমন করেই বা খাবে?
আতিকের নানু বলতে লাগলেন-শোনো বকের ছানাটিকে তুমি যখন পিঞ্জিরায় রেখে খানা দেওয়ার জন্য কাছে যাবে তখন সে তোমার চোখটিকে মাছ মনে করে ধারালো ঠোঁট দিয়ে আঘাত করতে পারে, তাই তুমি যখন সেটাকে পালন করবেই নিয়ত করেছ তখন সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, ঠিক আছে?
আতিক মাথা ঝুঁকিয়ে খুশি হয়ে বলল- আচ্ছা।
অতঃপর বাড়িতে গিয়ে শুরু হলো বক লালনপালন করার যুদ্ধ।
আতিক সপ্তম শ্রেণিতে গ্রামের একটি স্কুলে পড়ে। আতিকের বাড়ির চারপাশে এখন নতুন পানি ভরপুর, তাই তার বকের ছানাটির জন্য মাছ সংগ্রহ করতে তেমন কষ্ট হয় না। আতিক তার আব্বুর বানানো ট্যালা জালটি নিয়ে স্কুলে যাওয়ার আগ মুহূর্তে গোসল করার সময় দুটি খেও দিলেই বক ছানার সকালের নাশতা হয়ে যায়। এমনকি দু-একটি মাছ বেশি হলে তার আম্মুকে বলে যায় দুপুরে খাওয়ানোর জন্য।
তারপর বিকাল বেলা স্কুল থেকে ফিরে খেলার সময় মাছ ধরে নিয়ে আসে বকের ছানাটির জন্য। এভাবে আস্তে আস্তে বড় হতে লাগল বক পাখিটি।
ছানাটি এখন আতিককে দেখলেই ট্যাঁ ট্যাঁ করে ডাকতে শুরু করে এমনকি তার গজানো পালক নেড়ে অভিবাদন জানায়।
আতিকের খুব ভালো লাগে সে এখন একটি বক ছানার মালিক। স্কুলের সবাই তার ছানাটির সম্বন্ধে অবগত আছে। সে এখন নিয়মিত ছানাটিকে বের করে উঠানের মধ্যে হাঁটা এবং উড়তে সাহায্য সহযোগিতা করে।
ছানাটি আস্তে আস্তে উড়তে পারে। সে এখন ঘরের চালা থেকে টুই তার সঙ্গে উঠানের পেয়ারা গাছটির ওপর উঠে পড়ে। আতিক ডাক দিতে বিলম্ব না করে উড়ে এসে হাতের মধ্যে বসে। বকের এই পোষ মানা দেখে বাড়ির সবাই মুগ্ধ। কারণ বক পাখিদের সহজে কেউ পালন করে না, পোষ মানানো তো দূরের কথা।
বর্ষাকালে বাড়ির চারপাশে তৈরি পানি এমনকি মাছের কমতি নেই, তাই আতিক বকের ছানাটিকে বাড়ির আঙিনায় পানির কিনারে নিয়ে দাঁড় করিয়ে প্রথমে কিছু মরা পুঁটি মাছ পানির ওপর ফেলে রেখে বকটিকে শিকার করা শেখানোর জন্য। আস্তে আস্তে সে শিকার ধরতে শিখেছে উড়তেও শিখেছে।
এক দিন ছানাটি নদীর ওপাড়ে মাছ ধরা অন্য বকগুলোর কাছে উড়ে গিয়ে বসে পড়ল, আতিক চিন্তায় পড়ে গেল। আর মনে মনে ভাবতে লাগল সে আর ফিরবে না বোধহয়।
কিন্তু না আতিকের ধারণা পাল্টিয়ে বকের ছানাটি ঠিক তার পিঞ্জিরায় ফিরে এলো। ছানাটি প্রতিদিন এভাবে মাছ শিকার করে ফিরে আসে।
আর চলে গেলেই বা কী কারণ, সে এখন বড় হয়েছে, উড়তে শিখেছে, খাবার সংগ্রহ করতে পারে। তাকে বন্দি করে রাখা অনুচিত। তবু যদি সে সারা দিন মাছ ধরে এখানে ফিরে আসে তাতে কোনো অসুবিধা নেই।
এখন আশ্বিন মাস নদী ও হাওড়ের পানি কমতে শুরু করেছে। বকটির প্রতি আতিকের বিশ্বাস এবং ভালোবাসার কোনো কমতি নেই। এক দিন সকাল বেলা বকটি পিঞ্জিরা থেকে শিকার ধরার জন্য বের হয়ে গেল আতিকের স্কুলে যাওয়ার সময়। কিন্তু এই দিন আতিক স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখে বকের ছানাটি এখনো ফিরেনি।
আস্তে আস্তে বিকাল ঘনিয়ে আসছে, আতিকের চিন্তা বেড়েই উঠেছে। বাড়ির চারপাশে ডিঙি নৌকাটি নিয়ে খুঁজতে বের হয়েছে কিন্তু কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, সব পাখি নীড়ে ফিরে গেল। আতিকের মা বাড়ির কিনারে দাঁড়িয়ে জোর গলায় আতিককে ডেকে বলছে-এবার বাড়ি আসো।
আতিক চোখের জল মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরে এলো। তার আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল আর বলতে লাগল-কী হয়েছে বকটির? সে কি কোনো বকের সঙ্গে উড়ে চলে গিয়েছে? না কেউ তাকে ধরে নিয়ে খেয়ে ফেলেছে?
এত বছর পর সেই বক পাখিটার হারিয়ে যাওয়ার রহস্য অজানায় রয়ে গেল...