রবিবার, ৭ জুলাই, ২০১৩ ০০:০০ টা
খোলা কলাম

জাতীয় রাজনীতির গাজীপুর এপিসোড

কাজী সিরাজ

জাতীয় রাজনীতির গাজীপুর এপিসোড

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা শেষ হয়েছে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে। নানা নাটকীয়তা এই প্রচারণাকে বেশ উপভোগ্য করে তুলেছিল। এ লেখা যখন পাঠকের হাতে পৌঁছবে (রবিবার সকালে) ততক্ষণে গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ফলাফল, যদি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হওয়ার গ্যারান্টি থাকে_ সবাই জেনে যাবেন। এ নির্বাচনে সরকার নানা খেলা খেলেছে। বিরোধী দলের অভিযোগ ছিল অনেক। তারা বলেছে, সরকার প্রশাসনকে নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করেছে। প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে দলীয় লোকজনকে। নির্বাচন কমিশনে এ ব্যাপারে বিরোধী দল অভিযোগ দিয়েছিল লিখিতভাবে। লীগ সরকারের নিযুক্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার কথা দিয়েছিলেন, বিষয়টা তিনি দেখবেন। জানা গেছে, তিনি দেখেননি। প্রচারণাকালে বিরোধী দল সমর্থিত প্রার্থী এম এ মান্নানের প্রচারণাকর্মীরা পদে পদে বাধার সম্মুখীন হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে, অকারণে তাদের জরিমানাও করা হয়েছে। কিন্তু অভিযোগের কোনো প্রতিকার হয়নি। অথচ সরকারি প্রার্থীর লোকজন প্রশাসনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে প্রতিনিয়ত আচরণবিধি ভেঙেছে। প্রশাসন, নির্বাচন কমিশনের লোকজন দেখেও তা দেখেনি। বিরোধী দলের নালিশকে পাত্তাই দেয়নি। নির্বাচনে অনিয়ম নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে বিএনপির জাতীয় পর্যায়ের নেতারাও দেন-দরবার করেছেন। তারা বলেছেন, সিইসি বা কমিশনের লোকজন তাদের অভিযোগ এক কান দিয়ে শুনেছেন, আরেক কান দিয়ে বের করে দিয়েছেন। বোঝা যায় সরকার কলকাঠি নেড়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে গাজীপুর নির্বাচন মনিটরিংয়ের জন্য নাকি একটি বিশেষ সেলও গঠন করা হয়েছিল। অনেক মন্ত্রী, অসংখ্য এমপি দাপাদাপি করেছেন গাজীপুরে। ডাণ্ডা পার্টির ধুলোঝড় তোলা অভিযানে মানুষের অন্তরাত্দা কেঁপেছে। এত কিছুর পরও জয়ের ব্যাপারে আশ্বস্ত হতে না পেরে বিরোধীদলীয় প্রার্থীর পিছে লাগিয়ে দেওয়া হয় এনবিআরকে। কর ফাঁকির অভিযোগে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়। স্পষ্টতই বোঝা যায়, বিরোধী দল সমর্থিত প্রার্থীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে তাকে ডেমেজ করার জন্যই কাজটি করা হয়। তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ যদি এনবিআরের থেকেই থাকে, এতদিন তারা কোথায় ছিলেন? ভোট গ্রহণের তিন দিন আগে তাদের ঘুম ভাঙল? মানুষ কিন্তু ঠিকই বুঝে নিয়েছে এ 'কু'কর্মের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য। এনবিআরের চেয়ারম্যান নাসিরউদ্দিন লীগের খাস লোক। তার নিয়োগ রাজনৈতিক। তিনি শেখ হাসিনার প্রথম সরকার আমলে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের পরিচালক ছিলেন। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তাদের নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দায়িত্বশীল ব্যক্তির সভা করা এবং সরকারি প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার জন্য বলা গর্হিত অপরাধ। প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্মকর্তা কর্তৃক সরকারি দলের প্রার্থীর প্রশংসা এবং তাকে শুধু ভোট দেওয়ার জন্য নয়, তার পক্ষে কাজ করার জন্য বলা তো নির্বাচনী আচরণবিধি ভাঙাই। কিন্তু দলকানা নির্বাচন কমিশনের অন্ধত্ব ঘোচেনি। এর মধ্যেই গাজীপুর সিটি নির্বাচন। দুই দিন আগেই ফলাফল কী হবে, কে জিতবেন আর কে হারবেন তা বলে দিতে পারার মতো দৈবজ্ঞ আমি নই। তবে গত ১৫ জুন চার সিটি নির্বাচন, ১৯ জুন গাজীপুর জেলারই অন্তর্গত কালীগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচন এবং তার তিন দিন পর স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর এলাকা নোয়খালীর চাটখিল পৌরসভায় স্পিকারের নিজস্ব মেয়র প্রার্থীর ধারাবাহিক ও শোচনীয় পরাজয় জনগণের মধ্যে এমন একটা ধারণার জন্ম দেয় যে, গাজীপুরেও সরকারের নৌকাডুবি অবধারিত। যদিও গাজীপুর আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে খ্যাত। গত ১ জুলাই বাংলাদেশ প্রতিদিনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গাজীপুর নির্বাচন প্রসঙ্গে প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা গাজীপুর নির্বাচনের একটা পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, 'সারা দেশ এখন চেয়ে আছে গাজীপুরের দিকে। চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হওয়ায় দেশের অধিকাংশ মানুষ মনে হয় আগাম ধরেই নিয়েছে, আগামী সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের ভরাডুবি হবে। কতখানি ডুববে তারই হিসাব-নিকাশ হচ্ছে। হিসাব মেলানোর কাজটি সহজ ও স্বচ্ছ হবে গাজীপুরে যদি জনগণ যা ভাবছে বলে ঢাকায় বসে শুনছি এবং গণমাধ্যমে যা দেখছি, তাই হয়।' তার এ বক্তব্যের সঙ্গে আমিও সম্পূর্ণ একমত। মনে হয়, ফলাফল এমনই হবে, মানুষ যা ভাবছে তা, অর্থাৎ জনগণেরই জয় হবে। সাম্প্রতিক কয়েকটি সিটি ও পৌর নির্বাচনের মতো। লিখলাম তো বৃহস্পতিবার গভীর রাতে, শনিবার গভীর রাতে তা মিলল কী?

ওলট-পালট করার চেষ্টা সরকার শেষ পর্যন্ত করেছে। তারা শেষ কার্ড খেলেছে 'এরশাদ কার্ড'। কিন্তু এনবিআর কার্ড, এরশাদ কার্ড_ এ ধরনের খারাপ কার্ডে প্রতিপক্ষকে হারানো মুশকিল, হাতে লুকিয়ে রেখে একটু চিন্তায় ফেলানো যায়। যখন শো করা হয় তখন স্পষ্ট হয় যে, জেতার জন্য যে 'মূল্যমানের' কার্ড প্রয়োজন, এসব কার্ডের তেমন কোনো মূল্য নেই। বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত হু. মু. এরশাদের অবস্থান ছিল এক রকম। হঠাৎ বদলে যায় বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। জানা যায়, সাবেক বাসদ ছাত্রলীগ নেতা জিয়া উদ্দিন বাবলু এ ব্যাপারে মূল অনুঘটকের কাজ করেন। তিনি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ইউনিয়ন ব্যাংক অফিসে নিয়ে যান এবং আরও কিছু লোকের মাধ্যমে এরশাদ সাহেবকে ফাঁদে ফেলেন। তার বিরুদ্ধে বেশ কয়টি মামলা আছে। বাড়াবাড়ি করতে চাইলেই নাকি তাকে জেলের ভয় দেখানো হয়। বুড়ো বয়সে কে আর জেলে যেতে চায়। তার ওপর যদি প্রাপ্তিযোগের আশ্বাস থাকে তো সে লোভ সবাই কী সামলাতে পারে? তবে তাকে দিয়ে সাংবাদিকদের মাধ্যমে লীগ প্রার্থী আজমত উল্লাহ খানের প্রতি সমর্থন ঘোষণায় সরকারের কোনো লাভ হয়নি। এরশাদের হুকুমে এখন আর তৃণমূল সংগঠন চলে না, গাজীপুর তার প্রমাণ দিল। জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক এরশাদকে অগ্রাহ্য করেই বিরোধী দল সমর্থিত প্রার্থীকে আনুষ্ঠানিক সমর্থন জানায় সংবাদ সম্মেলন করে। এরশাদ কেন শেষ বেলায় এমন করেছেন তা তারা বোঝেন। এরশাদ সাহেব ইউনিয়ন ব্যাংক অফিসে বিবৃতি প্রদান ছাড়া আর কিছু করেননি। জেলা বা থানা নেতাদের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। সরাসরি কোনো সাংগঠনিক নির্দেশও দেননি। বরং তৃণমূলের নেতাকর্মীরা তাদের নেতাকে দিয়ে সরকার এ কাজটি করিয়েছে, এ জন্য আরও ক্ষিপ্ত হয়েছে। সাড়ে চার বছরের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যে তারা অপমানিত, ক্ষুব্ধ। তারা আরও বেশি করে শেষ সময়টা কাজে লাগিয়েছে। গত ৫ মে যে হেফাজতে ইসলামের 'ঘাড় মটকিয়েছে' সরকার, গাজীপুরে সেই হেফাজতের লোকজনের মনে হয়, ক'দিন পুকুরে গিয়ে পা ধোয়া লাগেনি। আওয়ামী হাতের স্পর্শেই ধোয়া-মোছার কাজ সেরে গেছে রূপকের ঢংয়ে বললে এমনই বলতে হয়। কিন্তু তাতে সাড়া মেলেনি। শেষে কয়েকজন ইমাম-মুয়াজ্জিনকে হেফাজত সাজিয়ে কাজ সারার চেষ্টা করেছে। অথচ হেফাজত তাদের পক্ষে দাঁড়াতে চাইলেও তো ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী আওয়ামী লীগের তা গ্রহণ করার কথা নয়। হেফাজত বিরোধী দলকেই হেফাজত করেছে, ৫ মে 'অপারেশন ফ্ল্যাশ আউটের' উদ্যোক্তাদের নয়। জামায়াতে ইসলামীও কী নিষ্ক্রিয় ছিল? তাহলে বিএনপি+জাতীয় পার্টি+জামায়াতে ইসলামী+হেফাজতে ইসলাম+সরকারবিরোধী গণরোষ= কী দাঁড়ায়? এটাই তো গাজীপুরের ভোটের অংক। গাজীপুর সিটি নির্বাচনের অতি সহজ-সরল অংকের মুখস্থ ফলাফল যদি পাল্টে দেওয়া হয়, তাহলে তো 'উত্তরপত্র' পাল্টে দিতে হবে। সরকারের মধ্যে একটা মারকুটে ক্ষুদ্র অংশ আছে বলে শোনা যায়, শুরু থেকে যারা গাজীপুর দখলে বদ্ধপরিকর ছিল। তাদের যুক্তি, তাদের তো সবই গেছে। চার সিটি নির্বাচন আগামী জাতীয় নির্বাচনে তাদের জন্য 'বিদায় ঘণ্টা' বাজিয়ে দিয়েছে। যা হারানোর তাদের তা হারিয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। আর কিছু হারানোর ভয় নেই। তাই গাজীপুর যেনতেন প্রকারে যদি দখলও করে নেওয়া হয়, বদনাম ছাড়া আর কী হবে? বদনাম তো আছেই। না হয় কী চার সিটি নির্বাচনে এমন ফলাফল হয়! জাতীয় রাজনীতির প্রভাবেই তো তা হয়েছে। নেতা-কর্মী-সমর্থক-শুভানুধ্যায়ী_ সবারই মন ভেঙে গেছে। দলের সর্বত্র হতাশা। গাজীপুর দখল করে বদনামের বিনিময়ে হলেও যদি হতাশা কাটানো যায়, তাতে মন্দ কী? এই 'হতাশা কাটানোর ডকট্রিন' বাস্তবায়ন করতে গেলে পরিণতি কী হবে? এক কথায় বলা যায় ভয়াবহ এবং বলা যায়, ঈদের পর সরকারবিরোধী আন্দোলনের জন্য মানুষ বসে থাকবে না। শনিবার গভীর রাত থেকেই প্রথম গর্জে উঠবে গাজীপুর, যেমন গর্জে ছিল একাত্তরে_ তারপর সারা দেশ।

এটা সত্য যে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গাজীপুর সিটি নির্বাচন লীগ সরকারের জন্য উভয় সংকট। শুরু থেকেই পর্যবেক্ষকরা বলে আসছেন যে, হার-জিত কোনোটাতেই সরকারের লাভ নেই, উভয়টাতেই ক্ষতি। নিরপেক্ষ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে সম্প্রতি অন্যান্য স্থানের মতো রাজনীতির বানে গাজীপুরেও সরকারের নৌকা ডুববে। যদি গাজীপুর দখলের খারাপ নিয়ত না থাকে সরকারের।

দুই.

গাজীপুর সিটি নির্বাচনকে জাতীয় রাজনীতির 'গাজীপুর এপিসোড' ধরে নেওয়া যায়। এর আগে অতি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত অন্য নির্বাচনগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন এপিসোড পর্যবেক্ষণ করেছে জাতি। প্রত্যেক নির্বাচনের ক্ষেত্রেই বলা হয়েছে, জাতীয় রাজনীতির প্রভাবেই লীগ প্রার্থীরা ডুবেছে। কথাটা আমিও মানি। কিন্তু রাজনীতিটা কী? এ ব্যাপারে সুচিন্তিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ খুব একটা দেখা যায়নি। শাসক দল আওয়ামী লীগের খারাপ রাজনীতিকে এবং আওয়ামী লীগের দুর্বৃত্তায়নকে হারিয়ে যদি বিএনপির আদর্শবাদী গণতান্ত্রিক রাজনীতি এবং সৎ ও আদর্শবাদী, দুর্বৃত্তায়নমুক্ত সাধুজনদের রাজনীতির জয় হতো তাহলে ভালো লাগত। জাতীয় রাজনীতি (মূল স্রোত) এখন আদর্শবাদনির্ভর নয়, প্রকৃত রাজনীতিবিদদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিতও নয়। অরাজনৈতিক ব্যবসায়ী, অবসরপ্রাপ্ত আমলা, কালো টাকার মালিক ও অস্ত্রবাজ গডফাদাররাই রাজনীতির মাঠে এখন ছড়ি ঘোরায়। তারপরও আশার একটা জায়গা ছিল যে, ভালো, সৎ ও আদর্শবাদী রাজনীতিবিদ ও গণমুখী দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক রাজনীতি দিয়ে খারাপ রাজনীতি, রাজনীতির ময়দান দখলকারী খলনায়কদের ফ্ল্যাশ আউট করার জন্য রাজনৈতিক দলে সংস্কারের আওয়াজ উঠেছিল। সংস্কারবাদীরা আপাতত ব্যর্থ হয়েছেন, কিন্তু কোনো মহৎ উদ্যোগ কখনো একেবারেই হারিয়ে যায় না। সিটি নির্বাচনে আমরা এই যে জাতীয় রাজনীতির প্রভাবের কথা বলছি সে রাজনীতি দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের জন্য কিন্তু সুখকর ও প্রেরণাদায়ক নয়। বিএনপি নেতারা এবং তাদের সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীরা উল্লসিত এই ভেবে যে, তাদের প্রার্থীরা অনেক জায়গায় জিতে গেছেন। বিজয়ীরা বিএনপির লোক সত্য, কিন্তু ভোটে কী বিএনপি জিতেছে? জাতীয় নির্বাচনেও যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে, তাতেও কী বিএনপি জিতবে? আমি মনে করি, না, বিএনপি জেতেনি। ভবিষ্যতেও দল বিএনপির লোক হয়তো জিতবে, শহীদ জিয়ার প্রতিষ্ঠিত বিএনপির রাজনীতি ও আদর্শ জিতবে না। আমি চাই, জিতলে বিএনপিই জিতুক, জিতুক তার আদর্শ; অন্য কোনো আদর্শ নয়। লীগ সরকারের পদে পদে ব্যর্থতা, লুণ্ঠনপ্রিয়তা, কেরিয়ার রাজনীতিবিদ ও শেখ মুজিবুর রহমানের প্রকৃত অনুসারীদের অবমূল্যায়ন ও হাইব্রিড নেতাদের হাতে দল ও সরকারের নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব তুলে দেওয়ার ফলে আওয়ামী লীগ আর ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী-মুজিবের আওয়ামী লীগ নেই। এটা ধারণ করেছে এক ধরনের 'শংকর' রূপ। তাদের ভ্রান্তনীতির কারণেই (বিএনপিরও অবদান আছে) দেশে আজ চরম দক্ষিণপন্থি মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিপজ্জনক উত্থান হয়েছে। এদের মোকাবিলার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক কৌশল প্রয়োগে ভুল, ব্যর্থতা ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির ফলে ওই শক্তি আজ সংগঠিত ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তারা দেশকে পাকিস্তান বানাতে চায় বলে লীগের বাকাওয়াজ ওদেরই পক্ষে যাচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষতার সঠিক ব্যাখ্যা ও প্রয়োগে ব্যর্থতা ও উগ্রতা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের তাদের প্রতি দুর্বল করে দিচ্ছে। এরা ভারতপন্থি হওয়ার চেয়ে পাকিস্তানপন্থি হওয়াকে বেহতের মনে করেন। অথচ যাদের পাকিস্তানপন্থি বলে গালিগালাজ করা হয়, তারা বাংলাদেশকে পাকিস্তান নয়, বানাতে চায় তালেবানি রাষ্ট্র। এটা বেশি বিপজ্জনক, আরও ভয়ঙ্কর। এই শক্তি কৌশলে এগুচ্ছে। আওয়ামী লীগের মুখোমুখি ফ্রন্টলাইনে এরা খেলছে না, 'খেলাচ্ছে' বিএনপিকে দিয়ে। নির্বাচনে এরা বিএনপিকে শক্তি দিচ্ছে, নানা প্রকার সহযোগিতা দিচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের 'রণনীতি' ও রণকৌশলের ভুলে বিএনপির পক্ষে এদের নারী-পুরুষ কর্মীদের সংগঠিত কাজ, অক্লান্ত পরিশ্রম এবং এদের প্রভাবিত জাতীয় রাজনীতি বিভিন্ন স্থানে বিএনপি প্রার্থীদের বিজয়ী করছে। এই শক্তি আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেবে না। বিএনপিকেও যদি সমর্থন না দেয় তাহলে খারাপ আওয়ামী লীগ আর খারাপ বিএনপির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় খারাপ আওয়ামী লীগই ভালো করার কথা। কেননা, ভোটের খেলা তারা ভালো বোঝে। কিন্তু মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি কৌশলগত কারণে বিএনপির পক্ষেই থাকবে। ফলে লোক জিতবে বিএনপির, রাজনীতি জিতবে ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের। বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব মৌলবাদ প্রভাবিত বলেই স্পষ্টতর প্রতীয়মান হয়। ফলে জাতীয় রাজনীতির যে ওয়েবের কথা বলা হচ্ছে তা অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সর্বনাশের কারণ হতে পারে। বিএনপিরও এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়া উচিত। দেশ, জাতি, জনগণের চেয়ে ক্ষমতা বড় হতে পারে না। যে সব সিটিতে বিএনপি নেতারা জয় পেয়েছেন, জামায়াত, হেফাজতকে অগ্রাহ্য করে কী তারা কিছু করতে পারবেন? জাতীয় ক্ষেত্রেও তাই হবে। বিএনপি তার স্বকীয়তা হারাবে, রাজনীতি-আদর্শ কাগজ-কলমে যা আছে তাও হারাবে। এখন ক্ষমতার সুগন্ধ নাকে লাগছে বলে অনেকের ভালো লাগছে, আওয়ামী লীগকে গদিচ্যুত করার জন্য ওদের সঙ্গে নির্বাচনী ঐক্যের কথা বলে লোকজনকে ছেলে ভোলানো গল্প শোনাচ্ছেন কিন্তু শুধু ক্ষমতার জন্য জামায়াত হেফাজতের পদলেহনের সুদূরপ্রসারী পরিণাম যখন তাদেরও টুঁটি চেপে ধরবে তখন নিজেদের রক্ষার সময়ও তারা পাবেন কিনা সন্দেহ। জাতি ভোট বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বেই। সুরভিত দেশপ্রেমিক, জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক মূল ধারার রাজনীতিকে গ্রাস করবে তালেবানি রাজনীতি। প্রকৃত আওয়ামী লীগার ও শহীদ জিয়ার প্রকৃত অনুসারীদেরও জাতির স্বার্থে এই ভয়াবহ বিপদের কথা ভেবে দলের ভেতরেই গর্জে উঠতে হবে। আদর্শচ্যুত ক্ষমতার কাঙাল, ব্যর্থ, অযোগ্য ও লুণ্ঠনপ্রিয়দের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনা করতে হবে, চালাতে হবে শুদ্ধি অভিযান। না পারলে প্রধান দুই দলের প্রকৃত দেশপ্রেমিক, জাতীয়তাবাদী সৎ গণতন্ত্রীদের জাতির সামনে তৃতীয় বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি উপস্থাপনের উদ্যোগ নিতে হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যে জাতীয় রাজনীতির প্রভাবের কথা বলা হচ্ছে একদিকে সেই দুর্নীতি, হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, অত্যাচার, জুলুম, অপরদিকে ধর্মপ্রিয়তা নয়, ধর্মান্ধ তালেবানি রাজনীতির মোকাবিলার কথা ভাবতে হবে, ওড়াতে হবে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত প্রিয় স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের উজ্জ্বল পতাকা।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

ই-মেইল : [email protected]

 

 

সর্বশেষ খবর