রবিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৩ ০০:০০ টা
শ্রদ্ধাঞ্জলি

তিনি নেই, তিনি আছেন

আসিফ নজরুল

তিনি নেই, তিনি আছেন

আমার সঙ্গে কামরুল ইসলাম সিদ্দিক স্যারের ঘনিষ্ঠতা হওয়ার কথা নয়। তিনি প্রকৌশলী, আমি আইনের শিক্ষক। কিন্তু তার সঙ্গে যে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল সেটি তার বিশালত্বের কারণে। তিনি প্রথম আলোতে আন্তর্জাতিক নদী আইনের ওপর একটি লেখা দেখে আমাকে ফোন করেন। তিনি সাধারণ মানুষের কাছে হয়তো খুব বেশি পরিচিত ছিলেন না। কিন্তু যারা বাংলাদেশের গ্রামীণ অবকাঠামো সম্পর্কে খবর রাখত তারা জানত কী অসাধারণ মানুষ ছিলেন তিনি। এলজিইডির প্রকৌশল উপদেষ্টা এবং পরে এলজিইডির প্রতিষ্ঠাতা প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে তিনি বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেন। নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনাবিদ হিসেবে শুধু নয়, তা বাস্তবায়নে তার সাংগঠনিক ক্ষমতা, নেতৃস্থানীয় ভূমিকা ও নিরলস আন্তরিকতা ছিল অতুলনীয়। তিনি আমাকে ফোন করাতে অবাক হয়েছিলাম। আন্তর্জাতিক নদী আইন সম্পর্কে তার আগ্রহ আমাকে আরও অবাক করে। তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি আন্তর্জাতিক নদী ব্যবস্থাপনায় তিনি বহুদিন ধরেই কাজ করছেন। তিনি গ্লোব ওয়াটার পার্টনারশিপের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আন্তর্জাতিক নদী আইন বাংলাদেশের মতো ভাটির দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিশেষ করে ভারতের পানি আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে আমাদের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান অত্যন্ত জরুরি ছিল। তিনি এটি গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন। পরিচয়ের পর থেকেই তিনি নদী সম্পর্কে আমাকে যেভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন তা ছিল তার নিখাদ দেশপ্রেমের কারণে। তিনি স্টকহোমে বিশ্ব পানি সম্মেলনে আমাকে প্রায় একক প্রচেষ্টায় নিয়ে যান। আন্তর্জাতিক নদী আইনসম্পর্কিত বাংলাদেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তিনি যে কোনো আন্তর্জাতিক ফোরামে জোরালো বক্তব্য রাখতেন, আমাদেরও সর্বাত্দকভাবে উৎসাহিত করতেন। তার গভীর পাণ্ডিত্য এবং নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষমতার কারণে আন্তর্জাতিক পানি বিশেষজ্ঞরা তাকে যে শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখত তা উপলব্ধি করে আমরা নিজেরা সম্মানিতবোধ করতাম। নানা মত ও পথের মানুষকে তিনি একত্রিত করতে পারতেন। বাংলাদেশের বহু স্বনামধন্য মানুষ, যাদের কেউ কেউ ছিলেন তার চেয়েও বয়োজ্যেষ্ঠ, তারা তার সঙ্গে কাজ করতে গেলে স্বচ্ছন্দে তার নেতৃত্ব মেনে নিতেন। তিনি ২০০৩-২০০৪ মেয়াদে গ্লোবাল ওয়াটার পার্টনারশিপের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রথম চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। ভারত ও পাকিস্তানের বাঘা বাঘা পানি বিশেষজ্ঞ থাকার পরও তিনি এ প্রভাবশালী পদে আসতে পেরেছিলেন তার যোগ্যতা ও ব্যক্তিত্বের কারণে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ ওয়াটার পার্টনারশিপ এবং ন্যাশনাল ফোরাম ফর রুর্যাল ট্রান্সপোর্ট ডেভেলপমেন্টের প্রেসিডেন্টের নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করেন।

তার তত্ত্বাবধানে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল। সময়ের অভাবে তিনি সেই মহান কাজটি নিজ দায়িত্বে সম্পন্ন করতে পারেননি। তবে ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়ে অল্পদিনেই তিনি ঢাকা শহরের বিধ্বস্ত আইল্যান্ড, জীর্ণ ফুটপাত, অবৈজ্ঞানিক ট্রাক, দুর্বল সিগন্যাল ব্যবস্থা, অপ্রয়োজনীয় গোলচক্কর, নিয়ন বাতির স্বল্পতা_ এসব সমস্যা সমাধানে অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। কামরুল ইসলাম সিদ্দিক ছিলেন উদ্ভাবনী ক্ষমতাধর একজন কর্মবীর। তিনি কৃষি ক্ষেত্রে শুষ্ক মৌসুমে পানি সংরক্ষণ করে ইরি চাষের মাধ্যমে দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণে অংশগ্রহণমূলক পানি ব্যবস্থাপনার ধারণা জনপ্রিয় করে তোলেন। তিনি বাংলাদেশে রাবার ড্যাম স্থাপন এবং এ প্রযুক্তিকে জনপ্রিয় করেন। জেলা-উপজেলা-ইউনিয়নগুলোর বেস ম্যাপ প্রস্তুতির জন্য জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম চালু করে তথ্য মাধ্যমে বিপ্লব সাধন করেন। আদর্শ গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্পসহ গ্রামীণ রাস্তা, সেতু, সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা, প্রাথমিক বিদ্যালয়, সমাজ উন্নয়ন ও সমবায় ট্রেনিং সেন্টার নির্মাণ, জরুরি দুর্যোগ প্রশমন কর্মসূচির আওতায় প্রয়োজনীয় বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তার বহু কীর্তি সারা দেশের গ্রামে ও শহরে রয়েছে এবং তা বহুযুগ ধরে থাকবে। বর্তমানে নানা আন্তর্জাতিক আগ্রাসনের মুখে তার মতো করে দেশের স্বার্থে কথা বলার এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জনমত সংগঠিত করার বিরল ক্ষমতার অধিকারী লোকের অভাব আজ আমরা খুবই অনুভব করি। ৬৩ বছর বয়সে এমন কর্মবীর মানুষের মৃত্যু আমাদের কাছে অকালমৃত্যুই। অনেক কিছু দিয়েছেন তিনি দেশকে। আরও অনেক কিছু দেওয়ার ক্ষমতা ছিল তার। তার সম্পর্কে ভাবলে এটি মনে পড়ে। মনে পড়ে তার স্নেহময় পিতৃসুলভ হাসিমাখা মুখ। তার মৃত্যু শুধু দেশের জন্য নয়, আমার মতো তার বহু ভাবশিষ্যের জন্যও অপূরণীয় ক্ষতি।

লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

 

সর্বশেষ খবর