রবিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৩ ০০:০০ টা
খোলা কলাম

একদলীয় নির্বাচন বনাম অসহযোগ আন্দোলন!

কাজী সিরাজ

একদলীয় নির্বাচন বনাম অসহযোগ আন্দোলন!

এই লেখা তৈরির সময় থেকে পাঠকের হাতে যাওয়ার আগে মাঝে একটা দিন থাকবে- শনিবার। এক দিনে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমূল কোনো পরিবর্তন কী হয়ে যাবে? অবশ্য হলে তো এক ঘণ্টায়ও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে শাসক লীগ এবং প্রধান বিরোধী দলের পরস্পরবিরোধী কঠোর অবস্থান দেখে রাতারাতি আশাব্যঞ্জক একটা কিছু হয়ে যাবে বলে মনে হয় না। সংলাপে বসে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছার জন্য লীগ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়েছেন প্রায় ১০ দিন যায় যায়। মির্জা ফখরুল সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে ফোনে কথাও বলেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সায় দেননি লীগ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও দলের সাধারণ সম্পাদক। আলাপ-আলোচনার কথা উভয় পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল অনেক দিন ধরেই। উদ্যোগটা বিরোধী দলকেই নিতে হলো। অথচ দায়িত্বটা ছিল সরকারি দলের। তারা নানাজন নানাভাবে গলাবাজিই করেছেন, কিন্তু গায়ে লাগাননি কিছু। দলীয় বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ধমক খেয়ে ও চাটুকারের চাকরিটা প্রায় যায় যায় অবস্থায় মাহবুব-উল আলম হানিফ নামক আওয়ামী লীগের হঠাৎ গজানো যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের মুখ বন্ধ থাকলেও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, অ্যাডভোকেট কামরুল প্রমুখ কিছু ব্যক্তির কথাবার্তা বিরোধী দলের গায়ে জ্বালা ধরানোর মতোই ছিল; কিন্তু তারা বিরূপ কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে সঠিক জবাব দিয়েছে সংকট সমাধানের জন্য পত্রালাপ ও ফোনালাপ করে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, উদ্ভূত সংকট নিরসনে সরকারপক্ষ আন্তরিক হলে ইতোমধ্যেই মহাসচিব পর্যায়ে আলোচনার ব্যাপারে শাসক লীগের পক্ষ থেকে অনুকূল সাড়া পাওয়া যেত। গত চার দিন ধরে শোনা যাচ্ছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে ফোন করবেন, কথা বলবেন সংকট সমাধানের পথ নিয়ে। ২৫ অক্টোবর সকাল থেকে শাসক লীগের পক্ষ থেকে বার বার প্রচার করা হচ্ছিল, 'একটু পরেই' প্রধানমন্ত্রী ফোন করবেন বিরোধীদলীয় নেতার কাছে। পর্যবেক্ষকদের ধারণা ছিল, বিকালের জনসভা থেকে বিরোধীদলীয় নেতা যাতে কঠোর কোনো কর্মসূচি না দিয়ে আলোচনায় বসেন সে কথাই বলবেন তিনি। কিন্তু সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর সে সময় হয়নি। শুক্রবার ছুটির দিন বলে কী প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কোনো কর্মকর্তা ছিলেন না ফোন ধরিয়ে দেওয়ার জন্য? তা কী করে হয়? প্রধানমন্ত্রীর বাসাও অফিস। তার আবার শুক্রবার শনিবার কী? তবে কী প্রধানমন্ত্রীর সব টেলিফোন খারাপ? নাকি বলা হবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভার আগে প্রধানমন্ত্রী যাতে বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে কথা বলতে না পারেন এবং বিরোধী দল প্রধানমন্ত্রী কথা বলবেন বলেও বলেননি, এই অভিযোগ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোন সংযোগে বিএনপি-জামায়াতের লোকরা স্যাবোটাজ করেছে! আসল কথা যেটা বোঝা যায়, লীগ সরকার ও শাসক লীগের হর্তাকর্তারা বিরোধী দলকে আন্ডার ইস্টিমেট করেছেন এবং তাদের কোনো রকম পাত্তা না দিয়ে নিজেদের সাজানো ব্যবস্থা অনুযায়ী আগামী (দশম) জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে ফেলা যাবে বলে ভাবছেন। তাদের হয়তো আরও ধারণা ছিল এক দিনের প্রিপারেশনে লীগ সরকারের সৃষ্ট আতঙ্কজনক পরিস্থিতির মধ্যে ২৫ অক্টোবর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় লোক সমাগম হবে না। তাতে বিরোধীদলীয় নেতাসহ তার মিত্ররা হতাশ হবেন এবং মনঃস্তাত্তি্বক চাপে পড়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার মতো কোনো কর্মসূচি দিতে সাহস করবেন না। সে জন্যই বিরোধীদলীয় নেতাকে প্রধানমন্ত্রী ফোন করার তেমন তাগিদ অনুভব করেননি। কিন্তু ২৫ তারিখ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশ ছিল জনসমুদ্র।

আমার মনে হয়, ২৫ অক্টোবর থেকে লীগ সরকার বিরোধী দলের কাছে হারতে শুরু করেছে। ১৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ও নতুন বোতলে পুরনো মদ ঢালার মতো সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দেওয়ার পর সমঝোতার নামে বিরোধী দলকে ভয় পাইয়ে ওই প্রস্তাব গ্রহণ করতে বাধ্য করার জন্য ঢাকা শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য সব ধরনের সভা-সমাবেশ, মিছিল-বিক্ষোভ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে বলা হয়। বিরোধী দলকে সভার অনুমতি দেওয়া নিয়ে টালবাহানা করা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিরোধী দলের কাছে আত্দসমর্পণ করেছে সরকার। বিরোধী দল এ ব্যাপারে অটল ছিল। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, বগুড়া, সিলেটসহ দেশের অধিকাংশ অঞ্চলেই সভা-সমাবেশ-বিক্ষোভ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। ২৫ তারিখ কোথাও সভা-সমাবেশের অনুমতি দিতে সরকার বাধ্য হয়েছে, কোথাও সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেছে বিরোধী দল। ঢাকায় সমাবেশ করার জন্য ১৩টি শর্ত দেওয়া হয়েছিল। এ ধরনের জনসভায় এরকম নিষেধাজ্ঞা মেনে চলা কঠিন। সর্বত্র তা-ই দেখা গেছে। বোঝা যাচ্ছে জনগণের শক্তির ভারসাম্য এখন বিরোধী দলের দিকেই বেশি। সরকার তাই পিছু হটেছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বিরোধী দলকে সমাবেশ করার অনুমতি না দিলে তারা সমাবেশ করতই। তখন সমাবেশ হয়তো একটা হতো না, খণ্ড খণ্ড মিছিল-সমাবেশ হতো সারা ঢাকা শহরে। অতীত অভিজ্ঞতা বলে গণতান্ত্রিক আন্দোলন স্বৈরশাসকদের খল-আচরণে কখনো কখনো এমন মাত্রা পায় যে, শুধু রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরাই নয়, সাধারণ জনগণও অর্থাৎ নাগরিক সাধারণও তখন হয়ে যায় প্রতিবাদ-প্রতিরোধের একেকটি উত্তপ্ত বুলেট। পরিস্থিতি এখন সেদিকেই যাচ্ছে বলে মনে হয়।

সংকট এখন কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে এক জায়গায়। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন (দশম সংসদ) কোন সরকারের অধীনে হবে- শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সর্বদলীয় সরকারের অধীনে, নাকি বিরোধী দল নেতা বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্তাবিত নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে? এ ক্ষেত্রে যৌক্তিকতার বিষয় বিবেচনায় রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ডক্টর বদরুদ্দীন উমরের বিশ্লেষণ যথার্থ বলে মনে হয়। তিনি বলেছেন, 'গত ১৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় রেডিও ও টেলিভিশনের মাধ্যমে এক বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের উদ্দেশ্যে সমঝোতা প্রস্তাবের নামে রাজনৈতিক প্রহসন করেছেন। কেউ কেউ মনে করেছিলেন, শেখ হাসিনা তার এই বক্তৃতায় এমন কিছু প্রস্তাব করবেন যার ফলে পরিস্থিতির মধ্যে পরিবর্তন ঘটবে এবং প্রকৃত সমঝোতার শর্ত তৈরি হবে। কিন্তু সে রকম কিছু হয়নি। আসলে হওয়ার কথাও ছিল না, কারণ আওয়ামী লীগ নেতা প্রতিদিন যে সব বক্তব্য সভা-সমিতি, দলীয় বৈঠক ইত্যাদিতে দিয়ে যাচ্ছেন, তার থেকে এটা মনে করার কোনো কারণ ছিল না যে, হঠাৎ করে তিনি এমন কোনো প্রস্তাব উপস্থিত করবেন, যা তাদের নির্বাচনী রাজনীতিতে সৃষ্ট সংকট দূর করতে সহায়ক হবে। শাসক শ্রেণীর সংকট, আওয়ামী লীগের দলীয় সংকট এবং সর্বোপরি শেখ হাসিনার জমিদারি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সৃষ্ট যেনতেন প্রকারে ক্ষমতা অাঁকড়ে থাকার চেষ্টা থেকে উদ্ভূত সংকট যুক্ত হয়ে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যার ফলে এদের পক্ষে বিদ্যমান সংকট থেকে বের হয়ে আসার কোনো পথনির্দেশ করা সম্ভব নয়।' (দৈনিক যুগান্তর, ২০ অক্টোবর ১৩)।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বর্তমান সংকট লীগ সরকার ও শাসক লীগের সৃষ্ট সংকট। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী থেকেই এই গভীর সংকট উদ্ভূত। একটি মীমাংসিত বিষয়ে ব্যবচ্ছেদ ঘটিয়ে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল একটি সর্বদলীয় সিদ্ধান্ত। একদলীয় সিদ্ধান্তে তা বাতিল করা যায় না। সংসদে দানবীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে শাসক লীগ তাই করেছে। বিষয়টি তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে ছিল না, কোনো দল, গোষ্ঠী বা ব্যক্তি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের জন্য কখনো দাবিও করেনি। বলা হয় উচ্চ আদালতের রায়ের ভিত্তিতে তা করা হয়েছে। কিন্তু উচ্চ আদালত সংসদের সম্মতিতে চরম বাস্তবতা বিবেচনায় আরও দুটি সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে বলেও রায়ে উল্লেখ করেছেন। তা আমলেই নেওয়া হয়নি। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে রায়ের দোহাই দেওয়া হচ্ছে, পঞ্চদশ সংশোধনী গ্রহণের সময় সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকসহ অন্য বিচারপতিরা তখন পর্যন্ত মূল রায়ে স্বাক্ষরই করেননি। এই জট পাকিয়েছে সরকার, খুলতে হলে সরকারকেই বেশি আন্তরিক হতে হবে। সরকার কেন এই জট পাকিয়েছে তা এখন আর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। পর্যবেক্ষকরা এটাই মনে করেন, সরকারের অবস্থা ভালো নয়, তাদের জনসমর্থন এখন নিয়ত নিম্নগামী। সম্প্রতি প্রকাশিত এক নির্ভরযোগ্য জনমত জরিপে দেখা গেছে, একা বিএনপির প্রতিই ৫০.০৩ ভাগ ভোটারের সমর্থন রয়েছে; পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন ৩৬.০৬ জনের। এ কারণেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণে রেখে ক্ষমতা কব্জায় রাখতে চান তারা। সরকারের অপকর্মের যে সব অভিযোগ বিরোধী দল করছে, সে জন্য ভবিষ্যতে জেল-জরিমানাসহ নানা প্রকার নিগ্রহ থেকে আত্দরক্ষার বিষয়ও আছে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব সংবিধানসম্মতও নয়। আপদকালীন বা যুদ্ধাবস্থায়ই কেবল সর্বদলীয় সরকার গঠন করা যায়। জোট সরকার বা কোয়ালিশন সরকার হয় জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে বিজয়ের পর। শাসক দল এবং তাদের পক্ষে কিছু লোক বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্তাবকেও অসাংবিধানিক বলছেন। কিন্তু তার ৫+৫+১ ফর্মুলার নির্বাচনী সরকারকে সংবিধান পরিপন্থী আখ্যা দেওয়ায় সংবিধান বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, বেগম খালেদা জিয়া ২০ জন সাবেক উপদেষ্টা থেকে ১০ জনকে সংসদ ভাঙার আগে নির্বাচিত করার যে প্রস্তাব দিয়েছেন তা সংবিধানসম্মত। সংসদ ভাঙার অর্থাৎ আগামী ২৪ জানুয়ারি-২০১৪-এর আগে সংসদ বিলুপ্ত হওয়া পর্যন্ত সে সুযোগ পাওয়া যাবে। সংবিধানের ৬৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা কোনো সময়ে স্পিকারের কাছে স্বাক্ষরযুক্ত 'পত্রযোগে' পদত্যাগ করতে পারেন। আর ১২৩ অনুচ্ছেদে বলা আছে; 'সংসদ ভেঙে যাওয়া ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদের কোনো সদস্যপদ শূন্য হইলে পদটি শূন্য হইবার ৯০ দিনের মধ্যে উক্ত শূন্য পদ পূর্ণ করিবার জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।' বিএনপি চেয়ারপারসন তাই সংসদ ভেঙে যাওয়ার আগে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের ২০ জন উপদেষ্টা থেকে মনোনীতদের নির্বাচিত করে আনতে বলেছেন। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সংবিধানের ৫৬(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে পারেন। তাতে বলা হয়েছে, 'সংসদ ভেঙে যাওয়া এবং সংসদ সদস্যদের অব্যবহিত পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী নিয়োগের প্রয়োজন দেখা দিলে সংসদ ভাঙিয়া যাইবার অব্যবহিত পূর্বে যাহারা সাংসদ ছিলেন এই দফার উদ্দেশ্য সাধনকল্পে তাহারা সদস্যরূপে বহাল রহিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।' প্রেসিডেন্ট, স্পিকার ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের নির্বাচন তিনটি আলাদা আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এই তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথাই সংবিধানে পৃথকভাবে উল্লেখ আছে। এ কারণেই খালেদা জিয়া বলেছেন, তাদের মতোই একটা নির্বাচন করা যায়। এ জন্য সংসদ নতুন করে একটা আইন করতে পারে। এখানে বিষয়টি হচ্ছে সরকারের আন্তরিকতার। সংকট নিরসনের জন্য তারা নির্দলীয় ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচনকালীন একটা সরকার করতে আগ্রহী কিনা। বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্তাব অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন না করে একটি আইন প্রণয়নের মাধ্যমেই তা করা সম্ভব। আইন করতে না চাইলে সংবিধানে ষষ্ঠদশ সংশোধনী ছাড়া নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই।

২৫ অক্টোবরের জনসভায় বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট, তিনি যদি ভয়ভীতি বা কোনো চাপের কাছে নতিস্বীকার না করেন, শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবেন না। তিনি বলেছেন, এ ব্যাপারে সংবিধানের কথা বলে লাভ নেই। কথাটা বোধহয় তিনি এ জন্যই বলেছেন যে, আওয়ামী লীগ তো তাদের দলীয় স্বার্থে দলীয় এমপিদের ভোটে সংবিধান থেকে সংসদে ব্রুট মেজরিটির জোরে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছে। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে তিনি ২৭, ২৮, ২৯ অক্টোবর দেশব্যাপী সর্বাত্দক হরতাল ডেকেছেন। ২৭ তারিখ থেকে তিনি লীগ সরকারকে অবৈধ বলছেন। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন এর পেছনে যুক্তি আছে। ২৪ জানুয়ারি-২০১৪'র পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হলে ২৭ অক্টোবর নির্বাচনকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার কথা। সরকার যদি সংবিধানের ১২৩ (৩) (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচনে আন্তরিক হয় তাহলে এর ব্যত্যয় ঘটাতে পারেন না। সরকার যদি সংবিধানের ১২৩ (৩) (খ) অনুচ্ছেদের আশ্রয় গ্রহণের জন্য গায়ের জোরে হলেও ডিসেম্বর বা জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত ক্ষমতা প্রলম্বিত করে সংসদের ভেতরে বা বাইরে অস্বাভাবিক কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি করে অস্বাভাবিক কারণে সংসদ ভাঙার ব্যবস্থা করে ও তার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে একটি একদলীয় নির্বাচন করার ফন্দি অাঁটে, তা হলে বলতে পারে মেয়াদ অবসানকল্পে স্বাভাবিক নিয়মে তো সংসদ বিলুপ্ত হচ্ছে না, তাই ২৭ তারিখ থেকে সরকার অবৈধ হবে কেন? এটা সরকারকে করতে হবে গায়ের জোরে। বেগম জিয়া কি এ কথা বুঝছেন না? নিশ্চয়ই বুঝছেন। ২৪ জানুয়ারি ২০১৪-এর আগের ৯০ দিন বা পরের ৯০ দিনের মধ্যে একদলীয় নির্বাচনী কৌশল ঠেকানোর জন্য বিরোধীদলীয় নেতা তার ঘোষিত কর্মসূচিতে ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারি কর্মচারীদের প্রতি তিনি ২৭ তারিখ থেকে দলীয় লোকের মতো আচরণ না করে জনগণ ও গণতন্ত্রের পক্ষে থাকতে বলেছেন। নারী-পুরুষ, আবাল বৃদ্ধ বনিতাকে তিনি প্রয়োজনে রাজপথে নামার ডাক দিয়েছেন। বোঝা যাচ্ছে সর্বাত্দক আন্দোলনের চিন্তা করছেন তিনি। হরতালের চেয়ে কঠোর কর্মসূচি তো হচ্ছে সরকারের সঙ্গে পরিপূর্ণ অসহযোগ ও সরকারের বিরুদ্ধে অবরোধ। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টি তা-ই করেছিল। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, দেশ এবং জাতি এখন একদিকে শাসক লীগের একদলীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি ও অপরদিকে বিরোধী দলের শেষ রাউন্ডের খেলা অবরোধ-অসহযোগ আন্দোলনের ক্রান্তিলগ্নে। এর পরিণতি আমরা জানি। ইতোমধ্যে ২৫ অক্টোবর এক দিনেই সহিংসতায় মারা গেছেন ৮ জন। মানুষ হত্যা-হানাহানি চায় না। তারা চান শান্তি, স্বস্তি। শান্তি, স্বস্তির আশ্বাস বা সন্ধান কোথাও পেলে মানুষ সেখানেই আশ্রয় নেবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

 

সর্বশেষ খবর