রবিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৩ ০০:০০ টা

কেয়ারটেকারের নির্বাচনে কারা ক্ষমতায় আসবে?

মো. মাহবুবুল বাসেত

কেয়ারটেকারের নির্বাচনে কারা ক্ষমতায় আসবে?

দীর্ঘ ৩৬ বছরের পেশাগত অভিজ্ঞতার আলোকে অনায়াসেই বলা যায়, আমাদের নেতানেত্রীরা (ক) কিছু কাজ করেন, কিছু কথা বলেন- নিজের বুুঝে (খ) কিছু কাজ করেন, কিছু কথা বলেন- অন্যের বুঝে (গ) কিছু কাজ করেন, কিছু কথা বলেন- না বুঝে। তারা যা কিছু করছেন, যা কিছু বলছেন এর পরিণতি সম্পর্কে খুব ভালো করেই জানেন। কিন্তু এর পরও তা তারা করে চলেছেন এবং বলে চলেছেন। অনেকটা একটি জনপ্রিয় বাংলা গানের প্রথম লাইনের মতো- 'আমি জেনেশুনেই বিষ করেছি পান।' এই বিষের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ব্যক্তিজীবনে যেমন কমবেশি ঘটে তেমনি দল ও সরকারের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয় না।

প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক দুটি সিদ্ধান্ত কারও কারও কাছে 'রাজনৈতিক বিষপানের মতোই' মনে হচ্ছে। এর একটি হচ্ছে- সরকারের মেয়াদের মাঝামাঝি সময়ে এসে কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল। অন্যটি হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার (বিলম্বে শুরু) তিনি নিজের বুঝেই হোক বা অন্যের বুঝেই হোক কিংবা না বুঝেই হোক 'রাজনৈতিক বিষ পান' করেছেন। অতএব, এর খারাপ পরিণতির সম্মুখীনও তাকে হতে হবে। এ দুটি বিষয় তার মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে কিনা তা জানা না গেলেও এটা কিন্তু বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকার ও সংসদের মেয়াদ যতই শেষ হয়ে আসছে সবারই জানার আগ্রহ বাড়ছে- দেশে কি হচ্ছে, কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে অথবা না হলে কোন দল ক্ষমতায় আসবে ইত্যাদি নিয়ে।

বিষয়টির ব্যাপারে খুব বেশি গভীরে যাওয়ার বা বিচার-বিশ্লেষণের জন্য কোনো সংস্থার দারস্থ হওয়ার প্রয়োজন নেই। শেখ হাসিনা নিজে একজন ভালো লেখক। তার লেখার হাত খুবই শক্তিশালী এবং তিনি একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষকও বটে। নিচের তিনটি অতি সহজ ও সাধারণ বিশ্লেষণ অনুধাবন করে তিনি নিজেই চতুর্থ বিষয়ের বিশ্লেষণ করে বলতে পারবেন পরবর্তী সংসদ নির্বাচন কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে হলে কোন দল ক্ষমতায় আসবে। তবে পরপর তিনটি নির্বাচনের ফলাফল একই হয়েছে বলে যে চতুর্থ নির্বাচনের ফলাফলও একই হবে তা নয়। এর ব্যতিক্রমও তো হতে পারে।

ক। কেয়ারটেকার সরকার ১. বিচারপতি সাহাবউদ্দীন আহমদের সরকারকে বাংলাদেশের প্রথম নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকার বলা হয়, যদিও এটি সংবিধান বা আইনসম্মত কেয়ারটেকার সরকার নয়। আমাদের দেশে একটি দল আরেকটি দলকে বিশ্বাস করে না এবং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে না- এটা প্রমাণিত হওয়ার কারণেই বহু আন্দোলন-সংগ্রাম ও রক্তপাতের ফসল কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি।

বিচারপতি সাহাবউদ্দীন আহমদের নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ার পর ফলাফলে দেখা গেল আগের জাতীয় পার্টির সরকার আর ক্ষমতায় আসতে পারেনি, সরকারে এলো বিএনপি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ১. কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আগের সরকারি দল পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় আসতে পারে না।

(খ) কেয়ারটেকার সরকার : ২. বাংলাদেশে দ্বিতীয় নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকার বলা হয় বিচারপতি হাবিবুর রহমানের সরকারকে। এ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পর দেখা গেল আগের সরকারি দল বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারেনি, সরকারে এলো আওয়ামী লীগ।

রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ২. কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আগের সরকারি দল পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় আসতে পারে না।

(গ) কেয়ারটেকার সরকার ৩. দেশের তৃতীয় নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকার বলা হয় বিচারপতি লতিফুর রহমানের সরকারকে। এই সরকারের অধীনে নির্বাচনের পর ফলাফলে কি দেখা গেল? দেখা গেল নির্বাচনের আগের সরকারি দল আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় আসতে পারল না, ক্ষমতায় এলো বিএনপি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ৩. কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আগের সরকারি দল পরবর্তী সময়ে আর ক্ষমতায় আসতে পারে না।

(ঘ) কেয়ারটেকার সরকার ৪. বর্তমানে সংবিধানে নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকারের কোনো বিধান নেই। তবে চতুর্থ কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে কোন দল ক্ষমতায় আসবে তার রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী উত্তর অনায়াসেই শেখ হাসিনা দিতে পারবেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ৪ : সংবিধানে এখন কেয়ারটেকার সরকারের বিধান না থাকলেও আমরা ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সালে এর দাবিতে ১২ ঘণ্টা, ২৪ ঘণ্টা, ৩৬ ঘণ্টা, ৪৮ ঘণ্টা, ৭২ ঘণ্টা এমনকি ৯৬ ঘণ্টার হরতালও দেখেছি। দেখেছি গাড়ি ভাঙচুর, অগি্নসংযোগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ অসংখ্য মানুষের আহত-নিহত হওয়ার ঘটনা, তোপখানার রাজপথে জনতার মঞ্চ, বহু মা-বোনের বুক ফাটানো আহাজারি, স্বজন হারানোর নীরব কান্না। রেললাইনের স্লিপার উপড়ে ফেলা আর বগিতে আগুন লাগানোর ঘটনা এবং বাসে আগুন ধরিয়ে মানুষ পুড়ে মারার দৃশ্য। কিছু দিন থেকেই আবার একই দাবিতে শুনে আসছি ফাইনাল খেলা, গণঅভ্যুত্থানের শেষ ধাপ- মানুষকে রাজপথে নেমে আসার আহ্বান, ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম; পালানোর পথ খুঁজে না পাওয়ার হুঙ্কার এবং সর্বশেষে ২৫ অক্টোবর থেকে দেশ চলবে, বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশের কথা। কিন্তু বাস্তব ও প্রমাণিত সত্য হচ্ছে- সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থায় সংসদে সরকারি দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে এবং দেশব্যাপী সরকারি দলের সাংগঠনিক ভিত ও কাঠামো শক্তিশালী হলে রাজপথের আন্দোলন আর সংগ্রামে সরকারকে খুব একটা কাবু করা যায় না এবং কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হলো আর হলো না- এতে সরকারের খুব একটা যায় আসে না। আর শেখ হাসিনা তো নিজের মতো করেই সংবিধান সাজিয়ে রেখেছেন। গণতন্ত্র থাকলে 'নির্বাচিত উত্তরাধিকারী' না আসা পর্যন্ত তিনি তো তার পছন্দের মন্ত্রিসভাসহ স্বপদে বহাল থাকবেনই [সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৭(৩) ৫৮(৩)(৪)]। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কতদিন?

তবে কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল ও বিলম্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করার মধ্য দিয়ে যে বিষ তিনি পান করেছেন তার কি কোনো প্রতিক্রিয়া হবে না? অবশ্যই হবে। তাই অনুরোধ থাকবে, অনাগত দিনগুলোতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও অস্বস্তি বেড়ে গেলে মাঝে-মধ্যে গাইবেন : 'আমি জেনেশুনেই বিষ করেছি পান।' কিছুটা হলেও স্বস্তিবোধ করবেন। কারণ আপনার মধ্যে অনেক দুর্লভ গুণাবলী রয়েছে। এর মধ্যে অতি নগণ্য একটি হলো- বাকচাতুর্য বা বুদ্ধিমত্তা এবং রসবোধ বা রসিকতা (উইট অ্যান্ড হিউমার)। সংসদ কক্ষে বক্তৃতার মাঝে-মাঝে সংসদকে প্রাণবন্ত করে রাখার জন্য এ কৌশলের দৃশ্য আমরা দেখেছি। আমরা আপনার সাবলীল ও মিষ্টি কণ্ঠস্বরের সঙ্গেও পরিচিত। তার প্রমাণ দেখেছি সপ্তম জাতীয় সংসদের মেয়াদকালে সংসদ কক্ষে বক্তৃতার সময় অন্তত দুবার গেয়েছিলেন, গোলাম আলীর কণ্ঠের জনপ্রিয় উর্দু গানের প্রথম দুটি লাইন : 'চুপকে চুপকে রাতদিন/অাঁছু বাহানা ইয়াদ হায়।' আপনার কণ্ঠে উচ্চারিত ওই দুটি লাইনের কথা মনে পড়লে আজো আমরা যেমন উদ্বেলিত হই আবার আপনার নেতৃত্বে কেয়ারটেকার সরকারের দাবি আদায়ের আন্দোলনে দেশব্যাপী সেই 'ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি'র আলোকে ম্যাডামের বর্তমানের 'হুঙ্কারের কথা' চিন্তা করলে মন খারাপ হয়ে যায়। আর উর্দু ভাষার ওই দুটি লাইনের বাংলা কল্পনায় আনলে মন হয়ে ওঠে আরও বিষাদময়।

'চুপিচুপি দিবানিশি

অশ্রু ঝরানোর কথা

আজো ভুলিনি।'

এটি প্রেম-ভালোবাসা, বিরহ-বেদনার গান হলেও বাস্তব জেনেশুনে বিষ পান করলে জীবনে এমন বাস্তবতার সম্মুখীন তো হতেই হয়। 'চুপি চুপি দিবানিশি/অশ্রু ঝরানোর' পুনরাবৃত্তি কি ঠেকানো যায়?

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

ই-মেইল : [email protected]

 

 

সর্বশেষ খবর