বুধবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৩ ০০:০০ টা

দেশ বাঁচাতে জনগণকে ঘুরে দাঁড়াতেই হবে

ডক্টর কর্নেল অলি আহমদ বীরবিক্রম (অব.) এমপি

দেশ বাঁচাতে জনগণকে ঘুরে দাঁড়াতেই হবে

১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। বাঙালি জাতি যে আত্দত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, তা পৃথিবীর ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, দীর্ঘ ৪২ বছর পরও আমরা রাজনীতিবিদরা বাংলাদেশের মানুষের জানমাল এবং সমাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছি। যত্রতত্র গুম, খুন, রাহাজানি, অপহরণ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অন্যের জায়গা দখল, সামাজিক অবিচার, অনাচার একটি নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এর মূল কারণ হলো আমাদের লোভ-লালসা এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অভিপ্রায়। প্রতি পাঁচ বছর শেষে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে বহু প্রাণ আমরা হারিয়েছি।

তার পরও আমাদের বোধোদয় হচ্ছে না। মনে হয়, মনুষ্যতা সম্পূর্ণভাবে লোভ পেয়েছে। অনেকে ভালো-মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাদের কাছে হারাম-হালালের পার্থক্য নেই। যখন যা ইচ্ছা তা-ই করে যাচ্ছে। দেশের মানুষের ভালো-মন্দ বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। তাহলে প্রশ্ন, মানুষের ভরসাস্থল কোথায়?

রাজনীতিবিদদের দুর্বলতার কারণে সমাজ বহু দলে বিভক্ত। ফলে অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা (নিজের কাজ বাদ দিয়ে) কিছু পাওয়ার আশায় রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকছে। অথচ পৃথিবীর প্রতিটি দেশে প্রতিটি মানুষ তার নিজ নিজ পেশা এবং কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এর জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্ব সরকারের। এর অন্যতম মূল কারণ হচ্ছে রাজনীতিবিদরা কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতায় থাকার জন্য বা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন। তাদের অনেকের মধ্যে এক ধরনের লোভ-লালসা কাজ করে, যেমন রাজনীতি না করেও অনেকে উপদেষ্টা হতে চান, রাষ্ট্রদূত হতে চান, সুযোগ পেলে রাষ্ট্রপতির পদটাও দখল করতে চান।

সরকারি, আধা-সরকারি এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নিয়োগ-পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে বিগত কয়েক বছর ব্যাপকহারে সরকারের নিয়ন্ত্রিত প্রত্যেকটি সরকারি, আধা-সরকারি এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যাপকহারে রাজনৈতিক সমর্থকদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আমার মতে, এ প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য যতদিন আমরা কঠোর আইন প্রণয়ন করে রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল বা আছে, এ ধরনের ব্যক্তিদের নিয়োগ বন্ধ করতে না পারব, ততদিন পর্যন্ত রাজনীতিবিদদের মধ্যে ঐক্য হবে না। দেশে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরে আসবে না। সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবে, উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে, সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি হবে না। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে অন্তরায় সৃষ্টি হবে। সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগ-পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নিয়োগ পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে।

মুরগি চুরি করলে তিন মাস জেল, গরু চুরি করলে ছয় মাস জেল, কিন্তু দুর্নীতিবাজদের কোনো শাস্তি নেই। সৎ মানুষদের হয়রানি করা হয়। এর মূল কারণ হচ্ছে দুদককে আমরা স্বাধীন, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতামূলকভাবে কাজ করার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমি মনে করি, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ যে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা ক্ষমতার অপব্যবহার করলে, তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান এবং ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দুদকের থাকা উচিত। শুধু রাষ্ট্রপতি স্বপদে অধিষ্ঠিত থাকা অবস্থায় এই আইনের আওতার বাইরে থাকবে। কিন্তু বিদ্যমান আইনে অনেক ধরনের বৈষম্য রয়েছে। সমাজে একে অপরের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চার্জশিট দাখিল করার আগে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা নিশ্চিত হন, অভিযোগটি সত্য না মিথ্যা। নিশ্চিত হওয়ার পর চার্জশিট দাখিল করেন। মিথ্যা মামলা যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে বাদীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের ব্যবস্থা না থাকায় সমাজে প্রতিদিন অত্যাচার বৃদ্ধি পাচ্ছে। আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে। মিথ্যা মামলাকারীদের এবং মিথ্যা সংবাদ প্রচারকারীদের বিরুদ্ধেও শাস্তির বিধান রাখতে হবে।

বর্তমানে এ সংকট আরও গভীর এবং প্রকট আকার ধারণ করেছে। সুতরাং সব রাজনৈতিক দলের উচিত সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন পদ্ধতি নিশ্চিত করা। তাহলে হরতাল, অবরোধ এবং মিটিং-মিছিল অনেকাংশে হ্রাস পাবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপারেও আমাদের নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের কয়েক মাস আগে থেকে কিছু ফায়দা লোটা বা অবৈধভাবে টাকা রোজগারের জন্য নতুন নতুন রাজনৈতিক দল আত্দপ্রকাশ করে। অনেকগুলো রাজনৈতিক দল, স্বামী-স্ত্রী এবং পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ ধরনের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দেশের জনগণের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। বাংলাদেশের মতো এতগুলো রাজনৈতিক দল পৃথিবীর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন-পদ্ধতি নির্ধারণ করার পর, রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপারেও আমাদের নতুনভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে। এতে বলা থাকবে, নিবন্ধিত প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং নূ্যনতম সংসদে একটি আসন না পেলে তাদের নিবন্ধন বাতিল হবে। এতে সাইনবোর্ডধারী রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যবসা বন্ধ হবে। সামগ্রিকভাবে দেশে সুস্থ রাজনীতি ফিরে আসবে।

অবশ্যই আমরা একে অপরের সমালোচনা করব। সেই সমালোচনা হবে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ হচ্ছে কিনা, মানুষ ন্যায়বিচার পাচ্ছে কিনা, উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা এবং অর্থনীতি নিয়ে। রাজনৈতিক সমালোচনা হবে গঠনমূলক এবং জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত সমস্যাগুলো নিয়ে, ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, মিথ্যাচার নয়। গণতন্ত্রকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য আলোচনা ও সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই।

আমাদের মিথ্যাচার, একে অপরের বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং ব্যক্তিগত আক্রমণ থেকে বিরত থাকতে হবে। সংসদের বাইরে-ভেতরে যে বা যারা এ ধরনের আচরণ করবে, তাদের বিরুদ্ধেও কি ব্যবস্থা নেওয়া যায় তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে। ফ্রি-স্টাইলে মন্দভাষা ব্যবহার বন্ধ করার জন্য বিধিনিষেধ থাকা উচিত। অতীতকে নিয়ে আমরা বেশি ব্যস্ত থাকলে দেশের ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে। গ্রামের ভাষায় বলে 'গরিবের বউ সবার ভাবি'। আমাদের দেশেও তা বর্তমানে হচ্ছে। আমরা আমাদের ঘর সামলাতে ব্যর্থ হয়েছি বলে অন্যান্য দেশের পণ্ডিতরা আমাদের নিয়েই ব্যস্ত। জাতি হিসেবে এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক এবং লজ্জাজনক। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে দেশের শতকরা ৮০-৮৫ ভাগ লোক আলোচনায় মুখর। এর অর্থ হচ্ছে গণতন্ত্র সঠিক পথে এগোচ্ছে না।

১৮ দলীয় ঐক্যজোটকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে বাইরে রেখে নির্বাচন হলে হয়তো দেশের শতকরা ৮০% মানুষ ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হবে না। ভোট প্রদান করা থেকে বিরত থাকবে। কারণ এবার জনগণ তাঁবেদার, বেইমান, মুনাফেক এবং মিথ্যাবাদীদের চিহ্নিত করেছে। সত্যকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। সবাইকে মনে রাখতে হবে, দেশের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটারকে বাইরে রেখে কখনো গণতন্ত্র টেকানো সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশকে রক্ষা করার জন্য, জনগণকে একবার নয় একবার ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। অন্যথায় এ জাতির কপালে দুঃখ আছে।

লেখক : সংসদ সদস্য ও চেয়ারম্যান, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি।

 

 

সর্বশেষ খবর