মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৩ ০০:০০ টা
দিবস

প্রতিবন্ধীদের জন্য চাই প্রতিবন্ধকতামুক্ত সমাজ

অধ্যাপক ডা. এম তসলিম উদ্দিন

প্রতিবন্ধকতা মানুষের জীবনের ভিন্ন আরেকটি রূপ। জীবনের কোনো না কোনো সময় সব মানুষই দীর্ঘস্থায়ী বা স্বল্পস্থায়ী প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়ে থাকেন। কিন্তু নিজের অদম্য চেষ্টা ও সক্ষমতা প্রয়োগ করে তাদের বেশির ভাগই তা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন। তারপরও সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ থেকেই যায়, যারা কেবল প্রতিবন্ধকতার কারণেই সমাজের পর্যাপ্ত সহায়তা না পেয়ে গড়ে ওঠেন। উপরন্তু সমাজই তাদের কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঠেলে দেয় অনিশ্চয়তার দিকে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, প্রতিবন্ধীদের প্রতি সমাজের দায়িত্ব অপরিসীম। প্রতিবন্ধীরা সাধারণত তিন ধরনের বিশেষ প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে থাকেন; ক) অর্থনৈতিক, খ) স্বাস্থ্যগত ও গ) সামাজিক।

অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো দুই ভাগে বর্ণনা করা যায়। প্রথমত প্রতিবন্ধকতার কারণে নিম্নআয় ও দারিদ্র্য এবং দ্বিতীয়টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পরিবারের সামাজিক অবস্থানের কারণে, অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোকে কাটিয়ে উঠতে না পারা। সমাজে যেন এটিই স্বতঃসিদ্ধ, প্রতিবন্ধীরা চরম দারিদ্র্যে দিনযাপন করবেন, কর্মহীন থাকবেন, অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত হবেন এবং একজন সুস্থ মানুষের তুলনায় কর্মে অপটু হবেন। তবে এসবের মাত্রা ব্যক্তির সুযোগ-সুবিধা, শৈশব এবং অন্যান্য উপযোগিতা অনুযায়ী ভিন্নতর হতে পারে। অবস্থাসম্পন্ন পরিবারে বেড়ে ওঠা প্রতিবন্ধী শিশু, দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুর চেয়ে বহুগুণে সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। এটি একটি ছোট্ট উদাহরণ, এতদ্ব্যতীত এমন অনেক পার্থক্য আছে, যা সহজে উল্লেখ করা যায়। সবচেয়ে ক্ষতিকর এবং অপূরণীয় হচ্ছে_ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রতি পরিবার ও সমাজের নানা পর্যায়ের সদস্যদের আচরণ। নিয়োগকর্তা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সমস্যা জেনেও তার যে কোনো ছোটখাটো অক্ষমতার জন্য প্রতিবন্ধকতাকেই দায়ী করে থাকেন। কর্মজগতে এ সমস্যা ক্রমশই প্রকটতর হচ্ছে, কেননা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয় যে, তিনি কি পারেন না। কিন্তু এটি কখনো এভাবে বিবেচনা করা হয় না যে, এত প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে তিনি কি কি করতে পারছেন? সমাজের এহেন আচরণ আর নানাবিধ সমস্যা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে আরও বেশি প্রতিবন্ধকতার জালে আবদ্ধ করে ফেলে। বিশেষ করে কর্মক্ষেত্র তার জন্য হয়ে যায় একটি অলঙ্ঘনীয় দুর্গের মতো।

স্বাস্থ্যজনিত যেসব অক্ষমতা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে সমাজের মধ্যে থেকেও তাকে একঘরে করে ফেলে, সমাজ কখনো তা মূল্যায়ন করতে চায় না। অথচ অসুস্থতা, ব্যথা-বেদনা, ক্লান্তি এবং দুর্বলতা এসব কারণে একজন সাধারণ মানুষও সমাজের নানা কর্মে অংশগ্রহণ, স্বাধীনভাবে চলাচল ও যে কোনো কাজে পূর্ণ অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি শারীরিক বা মানসিকভাবে কতখানি সক্ষম সেটি বিবেচনা ছাড়াই তাকে কাজের জন্য অযোগ্য মনে করা হয়ে থাকে। তাতে যদি সমাজ কোনো প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিতও হয়, সেটি বিশেষ বিবেচ্য নয়। সামাজিক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে অবকাঠামোগত বিষয়টিও তুলে আনা প্রয়োজন। কোনো বিল্ডিং, শপিংমল, বাজার, স্টেশন থেকে শুরু করে এমন অবকাঠামো খুব কমই আছে, যেখানে একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সহজে প্রবেশ করতে পারেন কিংবা পেঁৗছে তার প্রয়োজনীয় তথ্য বা সেবা নিতে পারেন।

বেশির ভাগ সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল এমনকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজের মতো বিশেষায়িত সর্বোচ্চ রেফারাল হাসপাতালের সব অবকাঠামোতে হুইল চেয়ার আরোহী প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সহজে প্রবেশ করার মতো 'র্যাম্প' বা ঢালু পথ নেই। বিমানবন্দর, ট্রেন বা বাস স্টেশনের কথা তো বলাই বাহুল্য। স্কুল, অফিস বা কর্মক্ষেত্র, বাজার, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র একটিও কি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রতি সহানুভূতিশীল বিবেচনায় সামান্যতম সুযোগ রেখে নির্মিত হয়েছে? সিঁড়ি কর্দমাক্ত, অতি সরু ও ঢালু পথ, ফুটপাত, উচ্চ সিঁড়িযুক্ত জনাকীর্ণ বাস, বিশ্রাম নেওয়ার জায়গাগুলোতে স্থানস্বল্পতা- সব কিছুতেই যেন একের পর এক বাধা। রিকশা ব্যতীত যে শহুরে জীবন কল্পনা করা যায় না, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে তারাও নিতে চায় না, তার হুইল চেয়ারটিকেও নয়। কিছু একটু বলে দেওয়া, পথ দেখিয়ে দেওয়া, সদুপদেশ দেওয়া, একটু সতর্ক করা, হাত ধরে এগিয়ে দেওয়া, ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে নেওয়া- সব কিছুই যেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য নিষিদ্ধ। ভাবখানা এমন, যেন কেউ কিছু দেখতে পায় না, কিছু বুঝতে পারছে না। সেবা গ্রহণ, সহায়তা ও মানিয়ে চলার ক্ষেত্রে একের পর এক বাধা তার অক্ষমতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। প্রতিবন্ধীদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, কাজের সুযোগ এবং সামাজিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা 'সহস্রাব্দ উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা' অর্জনের প্রধানতম শর্ত। সমাজে যথাযথ অংশগ্রহণ এবং পূর্ণ সুযোগ-সুবিধা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য প্রতিবন্ধীদের প্রতি আমাদের সহায়তার হাতকে প্রসারিত করতে হবে। যখন সব প্রতিবন্ধকতার দেয়াল ভেঙে যাবে এবং প্রতিবন্ধীরা অন্যদের মতোই সক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন, কেবল তখনই সমাজ পূর্ণ সফলতার দাবি করতে পারে।

প্রতিবন্ধকতাকে জয় করা, সমাজের ক্রমোন্নতির একটি অন্যতম নিয়ামক। স্বাস্থ্যকর্মী, সমাজকর্মী, রাজনৈতিক দল, এনজিও, প্রতিষ্ঠান এবং দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে দায়বদ্ধ সরকারকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এ জন্য কাজ করতে হবে। প্রতিবন্ধীরা আমাদেরই ভাই, বোন কিংবা সন্তান। এ কারণে একটি সুন্দর সুযোগ-সুবিধা সংবলিত সহযোগিতাময় পরিবেশ- তারা আমাদের কাছে দাবি করতে পারে। এ কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৩ ডিসেম্বর ২০১৩ সালের থিমের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরা বলতে পারি, 'বাঁধ ভেঙে দাও, দ্বার খুলে দাও : সবার অংশগ্রহণে এগিয়ে যাক সমাজের উন্নয়ন।'

লেখক : এমবিবিএস, এফসিপিএস, ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ও সভাপতি, বাংলাদেশ ডিজ্যাবিলিটি স্টাডি গ্রুপ।

ই-মেইল :[email protected]

 

 

 

সর্বশেষ খবর