বৃহস্পতিবার, ২২ জানুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা

অলীক ফোনকল এবং আমাদের গ্লানি

তুষার কণা খোন্দকার

অলীক ফোনকল এবং আমাদের গ্লানি

হোক প্রতিবেশী, তবুও ভিন দেশ ভারতের একটি রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সভাপতি অমিত শাহর নাম এ দেশের সাধারণ মানুষ কয়েক দিন আগেও জানত বলে মনে হয় না। দেশের সাধারণ মানুষ অনেক দেশের রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর নাম জানে; কিন্তু অন্য দেশের ছোট বড় কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাদের নাম-পরিচয় জানার তাগিদ বোধ করে না। গত ৫ জানুয়ারি বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার দলের গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান নেওয়ার পর এ বাড়িটিকে ঘিরে অনেক নাটক মঞ্চস্থ হয়ে গেল। সেসব নাটকের একটি দৃশ্যের নায়ক প্রতিবেশী দেশের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ। বিএনপির দাবি, সেদিন শেখ হাসিনার পুলিশের ছোড়া পিপার স্প্রের ঝাঁজ বেগম জিয়ার নিঃশ্বাসের সঙ্গে তার ফুসফুসে ঢুকে তাকে অসুস্থ করে তুলেছে। ম্যাডাম জিয়ার শরীর-স্বাস্থ্যের কাহিল অবস্থায় প্রতিবেশী দেশের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ উদ্বিগ্ন হয়ে তাকে ফোন করে তার স্বাস্থ্যের খবর নিয়েছেন। বিএনপির মুখপাত্র মারুফ কামাল বললেন, অমিত শাহ ফোন করে ম্যাডামের শরীর-স্বাস্থ্যের তত্ত্বতালাশ নিয়েছেন। বিষয়টি এখানে এসে থেমে গেলে আমরা কৌতূহলী নাও হতে পারতাম। কিন্তু মুশকিল হলো, দেশের মানুষের সামনে বিএনপির দেওয়া এমন তথ্য দিল্লিতে বসে অমিত শাহ মুখের ঝাপটায় উড়িয়ে দিয়ে বললেন, 'সব বানোয়াট। আমি কাউকে ফোন করিনি।' অমিত শাহ বাংলাদেশের একটি টিভি চ্যানেলের ফোনকলের জবাবে এমন তথ্য বানোয়াট বলে অস্বীকার করার পরও মারুফ কামাল এবং বিএনপিদলীয় নেতারা ম্যাডামের স্বাস্থ্য নিয়ে অমিত শাহের উদ্বেগ দেশবাসীকে বিশ্বাস করানোর জন্য যেমন প্রাণপাত চেষ্টা করলেন সেটি অবিশ্বাস্য। দেশে এখন মৃত্যু আর ধ্বংসের নারকীয় মহোৎসব। এমন পরিস্থিতিতে দেশের ১৬ কোটি মানুষ চরম উদ্বেগের মধ্যে দিন পার করছে। বেগম জিয়া ১৬ কোটি মানুষের উদ্বেগ আমলে না নিয়ে বিজেপি নেতা অমিত শাহর উদ্বেগকে যেভাবে গুরুত্ব দিলেন তাতে অমিত শাহ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে দেশবাসীর কৌতূহল জাগা খুব স্বাভাবিক।

অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহর শৈশব-কৈশোর-যৌবনের আদ্যোপান্ত জেনে নেওয়া কোনো কঠিন কাজ নয়। ভারতের মতো দেশের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সভাপতিকে নিয়ে ওয়েব পেজের অভাব নেই। ওয়েব পেজে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, অমিত শাহ আশৈশব ভারতের হিন্দু মৌলবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় সমাজ সেবক সংঘের সদস্য। ১৯২৫ সালে জন্ম নেওয়া ভারতের রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ আর দশটা রাজনৈতিক দলের মতো সহজ সাধারণ কোনো দল নয়। রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ জন্মলগ্ন থেকে নিখাদ হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাসী এবং তারা হিন্দু অধ্যুষিত, হিন্দু শাসিত অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন দেখেছিল। রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ তাদের সেই স্বপ্ন বুকে লালন করে বলেই এ বছরও তারা 'ঘর ওয়াপসি' কর্মসূচির মধ্য দিয়ে মুসলমান ও খ্রিস্টান পরিবারগুলোকে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত করেছে। রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘকে চেনার জন্য চমৎকার একটি বিষয় পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। মহাত্দা গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসে রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘের সৃষ্ট এবং লালিত একজন দেশসেবক। ১৯৪৮ সালে নাথুরাম গডসে স্বাধীন ভারতের জাতির পিতা শান্তিবাদী গান্ধীকে বুকে গুলি করে হত্যা করেছিল। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহর পরিচিতি পেতে গিয়ে ঘটনাটি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হচ্ছে কারণ বিশ্বজুড়ে শান্তিবাদী মানুষগুলোর বুকে ভয়ের কাঁপন জাগিয়ে বিজেপি এবার গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসের জন্মদিন পালন করেছে। বলেছে, নাথুরাম গডসে জাতীয় বীর!

গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তার আবাল্য সহযোগী গুজরাটের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের রাজত্বকালে ২০০২ সালে গুজরাটে মুসলিম নিধনের মহোৎসব হয়েছিল। ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অমিত শাহ বজরঙ্গি দলের হত্যাকারীদের মুসলিম নিধনের জন্য তিনদিনের অবাধ লাইসেন্স দিয়েছিলেন। গুজরাটের মুসলমান নিধনে মোদি ও অমিত শাহ যে প্রত্যক্ষ মদদ দিয়েছিলেন সে বিষয়ে সাংবাদিক আশিষ খেতান তার তথ্যানুসন্ধানী প্রতিবেদনে স্পষ্ট তুলে ধরেছিলেন। পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা সঞ্জীব ভাট কমিশনের সামনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর হিংস্র ভূমিকার কথা সবিস্তারে বর্ণনা করেছিলেন। এমন একজন গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী নেতাকে উদারমনা হিন্দুরা দিল্লির মসনদে সহজে স্বাগত জানাতে পারেনি। অথচ বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়া অমিত শাহর অতীত ভুলে গিয়ে তারই সহমর্মিতা পাওয়ার জন্য এমন ব্যাকুল হয়ে পড়লেন?

দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সদয় অবগতির জন্য অমিত শাহ সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য তুলে ধরছি। গুজরাটের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন অমিত শাহর বিশ্বাসভাজন পুলিশ অফিসার ধনঞ্জয় বানজারা তার মদদ নিয়ে সোল্লাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যেতেন। ধনঞ্জয় বানজারার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রথম শিকার সোহরাবুদ্দিন শেখ ও তার স্ত্রী কাউসার বাঈ। দুর্ভাগা কাউসার বাঈ স্বামীর হত্যাকাণ্ড দেখে ফেলায় কাউসার বাঈকে একজন নারী বলে ছাড় না দিয়ে নির্দ্বিধায় তাকে হত্যা করে অমিত শাহর বিশ্বাসভাজন পুলিশ কর্মকর্তা ধনঞ্জয় বানজারা। গুজরাটের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের প্রশ্রয় পাওয়া পুলিশ কর্মকর্তা ধনঞ্জয় একের পর এক যাদের হত্যা করছিলেন তাদের একজন ১৯ বছর বয়সী কলেজছাত্রী ইশরাত জাহান। তার সঙ্গে আরও মারা গেলেন জিশান জোহার, জাভেদ গোলাম শেখ এবং আমজাদ আলী রানা। হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘের কর্মী আজকের বিজেপি নেতা অমিত শাহর মদদপুষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা ধনঞ্জয়ের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার মাটিতে পড়ে থাকা মৃত ইশরাত জাহান এবং অন্যদের বয়সের দিকে চেয়ে দেখার পরও বেগম জিয়া কি অমিত শাহের একটি ফোনকলের আশায় দিন গুনতে চান?

ভারতের বিচার বিভাগ বেগম খালেদা জিয়ার মতো এতখানি উদার নয়। ভারতের আদালত পুলিশ অফিসার ধনঞ্জয়কে দোষী সাব্যস্ত করে তাকে জেলে পাঠিয়েছিলেন। ২০১০ সালে ভারতের আদালত অমিত শাহকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য দোষী সাব্যস্ত করায় তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। আদালতের আদেশে গ্রেফতার হয়ে তিনি জেলও খেটেছেন। অমিত শাহ আর কখনো গুজরাট ফিরে যাবেন না- এই মুচলেকা দিয়ে মানুষ খুনের দায় নিয়ে তিনি গুজরাট ছেড়েছিলেন। কিন্তু রাজনীতির মারপ্যাঁচ শুভবুদ্ধির হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়ে কত কিই না ঘটিয়ে ফেলে। ভারতের নির্বাচনে অথর্ব কংগ্রেসের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী ছিল কিন্তু সাম্প্রদায়িক শক্তি বিজেপির এমন অবিশ্বাস্য বিজয় ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবাসীর কাম্য ছিল না। কিন্তু ভোটের বাক্স ঘাটকে আঘাট আঘাটকে ঘাট করে দিয়েছে। কাজেই আজকের ভারতে আদালতের সিদ্ধান্ত উল্টে গিয়ে দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। অমিত শাহ গুজরাটে ফিরে গিয়ে লোকসভা নির্বাচনে জিতে আদালতের সিদ্ধান্ত পাল্টে দিয়েছেন। এখনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ভারতবাসী স্বপ্ন দেখে, হিন্দু মৌলবাদী দল ধর্মান্ধ রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘের উগ্র হিন্দুত্ববাদী শাসনের অবসান হয়ে ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি ফিরে আসবে। ভারতে মুসলমান ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষকে ধরে কেউ ধর্মান্তরিত করে হিন্দু বানাবে না। আমরা যারা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্ন দেখি তারা শুভ চেতনার ভারতবাসীর স্বপ্ন পূরণের জন্য অন্তর থেকে কামনা করছি। আশা করছি বেগম খালেদা জিয়াও আমাদের প্রার্থনার সঙ্গে আন্তরিকভাবে কণ্ঠ মেলাবেন।

ভারতীয় জনতা পার্টির সভাপতি অমিত শাহ বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বয়সের তুলনায় নেহাতই বালক। অমিত শাহর জন্ম ১৯৬৪ সালে। পদপদবির দিক থেকেও অমিত শাহ বেগম জিয়ার অনেক পেছনে। বেগম খালেদা জিয়া স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। অমিত শাহ তেমন পদমর্যাদার কেউ নন। তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সহযোগী হিসেবে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সভাপতি। বেগম জিয়া দাবি করলেন অমিত শাহ তাকে ফোন করে তার স্বাস্থ্যের খবর নিয়েছেন। অথচ অমিত শাহ খালেদা জিয়ার দাবি হাতের ঝটকায় উড়িয়ে দিয়ে বললেন, 'সব বকোয়াজ সব বানোয়াট।' ধরণী দ্বিধা হও! স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের এ লজ্জা রাখার জায়গা নেই।

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

 

 

সর্বশেষ খবর