শনিবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা
সাংবাদিকতা

বার্ন ইউনিটে দগ্ধ মানুষের আর্তনাদ আমরা আর লিখতে পারছি না

আতাউর রহমান, কাজী আনিছ, সাজ্জাদ মাহমুদ খান, আলী আজম ও হাবিব রহমান

আপনারা পাঠক-দর্শক যারা পত্রিকা-টিভিতে দগ্ধ মানুষদের নিয়ে সংবাদ পড়েন বা দেখেন, আমরা নিশ্চিত, কষ্টে-বেদনায় আপনাদের মন বিষিয়ে ওঠে। কেউ কেউ কাঁদেনও। তাহলে আমরা প্রতিবেদকরা যখন স্বচক্ষে এসব মানুষের ঝলসানো মুখ দেখে, কান্না-আর্তনাদ শুনে তথ্য সংগ্রহ করি তখন আমাদের মনের অবস্থাটা কী রকম হয়? ভাবা যায়?

আমরা সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখেছি দগ্ধ শিশু সাফিরের বুকফাটা কান্নায় চোখ ভিজে এসেছিল অনেক সংবাদকর্মীর। রিকশাচালক অমূল্য চন্দ্র বর্মণের স্বজনদের অসহায় আর্তনাদ এখনো আমাদের চোখের সামনে ভাসে। আমাদের পীড়া দেয়। ক্লাস করতে যাওয়ার সময় পুড়ে যাওয়া ইডেন কলেজের ছাত্রী সাথী ও বিথীর আতঙ্কে আতঙ্কিত হয়েছি আমরা। এ তালিকায় আছে মিনারা, রূপা, রহিমা বেগম, রহিম বাদশা, মনোয়ারা, জেসমিন, বৃদ্ধ তছিরন নেছারা। তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে। মানুষ পুড়ছে, বার্ন ইউনিটে আসছে আর আমরা ছুটে গিয়ে খবর সংগ্রহ করার বদলে হয়ে পড়ছি আবেগাপ্লুুত-আতঙ্কিত। কখনোবা এ অপরাজনীতির বিরুদ্ধে হয়ে উঠছি ক্ষুব্ধ-বিক্ষুব্ধ। কত দেখা যায়? কত মেনে নেওয়া যায়? আর কত লেখা যায়? সংবাদ সংগ্রহের বদলে মনের মধ্যে আসে একটাই প্রশ্ন- এ নিরপরাধ জনগণকে পুড়িয়ে কি দেশে 'গণতন্ত্র' আনা যায়?

আসলে যেখানেই খবর সেখানেই ছুটে যাওয়াই আমাদের কাজ। আমাদের মূলনীতিই হচ্ছে আবেগ-অনুভূতির ঊধের্্ব উঠে নির্মোহভাবে তথ্য সংগ্রহ করা। কিন্তু গত কয়েক বছরে রাজনৈতিক আগুনে পোড়া মানুষদের আর্তনাদ আর কান্নার সাক্ষী ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে গিয়ে দেখা গেছে এ মূলনীতি অনুসরণ করা অত্যন্ত কষ্টকর। সব কিছুর পর আমরাও তো মানুষ। মানুষ হয়ে এমন পোড়া মানুষ দেখে মন কাঁদে। নিরপরাধ দগ্ধ মানুষগুলোর ছটফট দেখে আমাদের হৃদয়ও ছটফট করে। তাদের শরীরের দগদগে কাঁচা ক্ষত দেখে আমাদের মনেও ক্ষতের সৃষ্টি হয়। আমাদেরও তো মানসিক দৃঢ়তার একটা সীমা আছে। তা অতিক্রম করলে যেকোনো কাজেই আর কোনো সূত্র মেলানোই ভার। এসব কিছুর কারণে আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমরা আর বার্ন ইউনিট কাভার করতে চাই না। এ বীভৎসতা নিয়ে আমরা আর লিখতে পারছি না। কত অমূল্যের দীর্ঘশ্বাস যে মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছে তার হিসাব কী রাখেন অবরোধকারীরা? পাশে বসে থাকা স্বজনদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অাঁধারি চিন্তায় বার্ন ইউনিটে ভারি হচ্ছে তার হিসাব কি রাখেন রাজনীতির নামে নাশকতাকারীরা? এ অবরোধেই তরুণ ট্রাকচালক মুরাদ মোল্লা মাকে ফোনে বলেছিলেন, অবরোধ শুরু হচ্ছে, কাল সকালেই বাড়ি চলে আসব। কিন্তু মুরাদ মায়ের কোলে ফিরতে পারেনি। অবরোধের আগুনে ট্রাকের ভেতরে ঘুমন্ত অবস্থায় দগ্ধ হন তিনি। ঠাঁই মেলে বার্ন ইউনিটে। পাঁচ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে হেরে যান মুরাদ। এই মুরাদের মায়ের প্রতীক্ষার ভারটা কি বোঝেন ক্ষমতার স্বপ্নের ঘোরে থাকা আমাদের রাজনীতিকরা। এর শেষ কোথায়- তা কেউ বলতে পারছে না।

আরও দুঃখজনক হচ্ছে, ইতিমধ্যে পেট্রলবোমার দায় প্রধান দুই রাজনৈতিক দল একে অন্যের দিকে ছুড়তে শুরু করেছেন। এটা নতুন নয়। এমনকি জঙ্গিবাদের মতো স্পর্শকতার ইস্যুতেও তারা স্বার্থবাদী বক্তব্য প্রচার করতে পিছ-পা হন না। গুগলে জঙ্গিবাদ বিষয়ে জানতে সার্চ দিলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি আর জামায়াত নেতাদের পাগলের প্রলাপ উঠে আসে। সব কিছুতেই তারা দায় চাপানোর মাধ্যমে দায়মুক্তি খোঁজেন! কিন্তু সময় এসেছে প্রশ্ন ছোড়ার- আর কত?

কিন্তু সবার বোঝা উচিত, বার্ন ইউনিটে দামি পারফিউমের গন্ধ ছড়ায় না। সেখানের লাল ওয়ার্ড, নীল ওয়ার্ড, গ্রিন ওয়ার্ড থেকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) কাচেঘেরা দরজার ফাঁক গলিয়ে গন্ধ বের হয়। তা মানুষ পোড়া উৎকট গন্ধ। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের মানুষই তারা। সেই মানুষদের পোড়া মুখ, পোড়া শরীর দেখলে আমাদের অতিপ্রিয় বাবা-মা, ছোট্ট ভাইবোনের সোনামুখখানি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তখন বার্ন ইউনিট কাভার করার মতো মানসিক শক্তিটা আর ধরে রাখতে পারি না। আমার পোড়া মায়ের, বাবার, ভাইয়ের, বোনের মুখখানি বিশ্বের আয়নায় দেখাতে চাই না। ঝলমলে এক বাংলাদেশকে তুলে ধরতে চাই সবার সামনে। তাই আকুতি, এমন বীভৎসতা বন্ধ করুন, বন্ধ করুন এ নিয়ে রাজনীতিও।

আমরা আর এসব লিখতে চাই না। রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার দগ্ধ মানুষ এবং তাদের বিছানার পাশে বসে থাকা স্বজনদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আহাজারি বাতাস ভারি করে। সে তথ্য লিখতে লিখতে আমাদের চোখ ভিজে যায়, প্রাণ কাঁদে, বুক ফেটে যায়, তার খবর রাখে কে? এ নিষ্ঠুর নৃশংসতা দেখার মানসিক শক্তি আর নেই।

আমরা চাই না নিরপরাধ প্রিয়জনের ঝলসানো মুখখানি দেখতে। যারা বোমা মারেন, গাড়িতে আগুন দেন, পেট্রলবোমায় ঝলসে দেন মানুষের শরীর। তাদের কাছে জিজ্ঞাসা, আরে ভাই তোমরাও তো নিশ্চয় মানুষ। তোমাদেরও বাবা-মা, ভাইবোন আছে। আচ্ছা পেট্রলবোমাটি ছোড়ার সময় তাদের কথা কি মনে পড়ে তোমাদের? হয়তো বোমা মেরে দ্রুতই ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যাও তোমরা। অনুরোধ করছি, একবার চুপিচুপি হলেও ঘুরে যাও বার্ন ইউনিট। দেখ, তোমাদের বীভৎসতার শিকার মানুষগুলো কীভাবে ছটফট করছে! প্রত্যাশা, বন্ধ হোক এই সহিংসতা, সেই সঙ্গে বন্ধ হোক আমাদের এই 'কষ্টকর' সংবাদ সংগ্রহের কাজটাও।

লেখকেরা : সমকাল, প্রথম আলো, আলোকিত বাংলাদেশ, বাংলাদেশ প্রতিদিন ও আমাদের সময় পত্রিকার অপরাধবিষয়ক প্রতিবেদক।

সর্বশেষ খবর