রবিবার, ১ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা

নিত্যদিনের কড়চা

তুষার কণা খোন্দকার

নিত্যদিনের কড়চা

টুকরো চিত্র-১

কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের এক নেতা যিনি যুদ্ধাপরাধের দায়ে জেলবন্দী তিনি তার নিজ দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া নিয়ে বিক্ষুব্ধ মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, 'লেজে কুকুর নাড়াচ্ছে'। এমন একটি মন্তব্য তিনি কাকে উদ্দেশ করে কেন বলেছিলেন আশা করি আপনাদের সেটি মনে আছে। এতদিন সেই নেতার মন্তব্যকে কটুভাষী মানুষের তিক্ত কথা হিসেবে কেউ তেমন আমলে নেয়নি কিংবা কেউ তার কথার পুনরাবৃত্তি করার প্রয়োজন বোধ করেনি। কয়েক দিন আগে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মারা গেলেন। তার মৃত্যু সংবাদ দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রচার হওয়ার পরে সন্ধ্যায় দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে সান্ত্বনা দিতে গুলশান কার্যালয়ে ছুটে গিয়েছিলেন এবং তিনি বাড়িটিতে ঢুকতে না পেরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে গিয়েছেন। সেদিন প্রধানমন্ত্রীকে বাড়ির বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে বেগম জিয়ার কার্যালয়ের দরজা না খোলার সিদ্ধান্ত কে নিয়েছিলেন সে কথা দেশবাসী এখনো জানে না। জনাব শিমুল বিশ্বাস গণমাধ্যমকে জানালেন, বিএনপি নেত্রী ছেলের মৃত্যুশোকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এবং তাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পারিয়ে রাখা হয়েছে। শিমুল বিশ্বাসের দেওয়া এই তথ্য বিএনপি নেত্রীর বাড়িতে সে সময় উপস্থিত কোনো সিনিয়র নেতা সমর্থন করেননি। তবুও তর্কের খাতিরে শিমুল বিশ্বাসের দেওয়া তথ্য আমরা সত্য বলে মেনে নিয়ে প্রশ্ন করছি, নেত্রী কি বাসার গেটে তালা লাগিয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন? বাড়ির মূল ফটকের চাবি কি বিএনপি নেত্রীর জিম্মায় ছিল? তাকে ঘুম থেকে না জাগিয়ে কি বাসার তালা খোলা সম্ভব ছিল না? বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ ছিলেন এবং তিনি সজ্ঞান অবস্থায় নাই থাকতে পারেন। কিন্তু বিএনপি হাইকমান্ডের সদস্যরা যারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন তারা প্রধানমন্ত্রীকে বাড়ির ভিতর নিয়ে যেতে পারলেন না কেন? তারা কি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সৌজন্য দেখানোর তাগিদ বোধ করেননি নাকি তারা তাদের দলের পক্ষ থেকে নিজ বুদ্ধি বিবেচনায় কাউকে সৌজন্য দেখানোর অধিকার রাখেন না?

জনাব মওদুদ আহমদ বলেছেন প্রধানমন্ত্রীকে দরজা থেকে ফিরিয়ে দেওয়া অন্যায় হয়েছে। অর্থাৎ, কাজটি অন্যায় হয়েছে, তবে আমি সেই অন্যায়ের ভাগিদার নই। তাহলে এমন অন্যায় কে করল? সে প্রশ্নের জবাব কি বিএনপি হাইকমান্ড জনগণকে জানাতে পারবেন কিংবা তারা এই অপকর্মের প্রতিকার করার ক্ষমতা রাখেন? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সব প্রশ্নের মুখে বিএনপি হাইকমান্ড লা-জবাব থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি হাইকমান্ডের অসহায়ত্ব দেখে মানুষের মনে করুণা জাগবে এটাই স্বাভাবিক। সেই সঙ্গে দেশবাসীর মনে প্রশ্ন জেগেছে, যে নেতারা তাদের দলীয় কার্যালয়ের তালা খুলে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে ভিতরে নিয়ে বসতে দেওয়ার অধিকার রাখেন না তারা কীভাবে সেই দলের নেতা বলে নিজেদের দাবি করতে পারেন! এখন মনে হচ্ছে, বিএনপি নেতারা জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনার কোশেশ বন্ধ করে নিজেদের দলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম শুরু করতে পারেন। নিজেদের দলে নেতা হিসেবে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জয়ী হতে না পারলে তাদের উচিত রাজনীতি ছেড়ে দেওয়া অথবা দল বদল করে এমন দলে যাওয়া যেখানে লেজে কুকুর নাড়াবে না বরং কুকুর লেজ নাড়াবে।

টুকরো চিত্র-২

দেশের স্বল্পকালীন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী পুত্রশোকাতুর বেগম খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে তাকে সান্ত্বনা জানাতে গিয়েছিলেন। সেখানে সাংবাদিকরা দেশের প্রধানমন্ত্রীর গুলশান কার্যালয়ে আসা এবং বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে তার মন্তব্য জানতে চেয়েছিলেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জনাব চৌধুরী বললেন, 'ওরা বলল, বাড়ির চাবি সরকারের কাছে। সরকার যদি বাড়ির গেটে তালা লাগিয়ে দিয়ে থাকে তাহলে এরা দরজা খুলবে কীভাবে?' আমার প্রশ্ন, সরকার যদি শেখ হাসিনার প্রবেশ আটকানোর জন্য বেগম খালেদা জিয়ার বাড়িতে তালা লাগিয়ে দিয়ে থাকে তাহলে সরকারের লোকজন কি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর জন্য বিশেষ সম্মান দেখিয়ে বাড়ির দরজা খুলে দিয়েছিল? তা না হলে, জনাব চৌধুরী বেগম খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে ঢুকলেন কীভাবে? তার কথা শুনে মনে হচ্ছিল সরকারি লোকজনের চোখে দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চেয়ে অনেক বছর আগে দেশের খণ্ডকালীন রাষ্ট্রপতির মানমর্যাদা অনেক বেশি। খণ্ডকালীন বলছি কারণ জনাব চৌধুরী রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার মেয়াদ পুরা করেননি। তিনি কেন তার মেয়াদ পুরা করেননি সে কথা দেশবাসীকে আজও জানাননি। নাকি জনাব চৌধুরী নিজেও সেটি জানেন না? বিএনপি দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এলে জনাব বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে বেশ ঘটা করে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিয়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্রপতি হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন না করতে তিনি দৃশ্যমান কোনো কারণ ছাড়াই তৎকালীন দল বিএনপির প্রভাবশালী অংশের রুদ্ররোষে পড়লেন। তারা বলল, জনাব চৌধুরী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করলে তাকে অভিশংসন করা হবে। বিএনপি তাকে অভিশংসন করার ভয় দেখাল আর তাতেই আতঙ্কিত হয়ে জনাব চৌধুরী পদত্যাগ করে পালিয়ে গেলেন। জনাব চৌধুরী কী জানেন না পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য সংখ্যা থাকলেই একজন রাষ্ট্রপতিকে গায়ের জোরে অভিশংসন করা যায় না। কোনো রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করতে হলে প্রথমে প্রমাণ করতে হয় তিনি শারীরিক অথবা মানসিকভাবে অসুস্থ, কিংবা তার গুরুতর নৈতিক স্খলন ঘটেছে। জনাব চৌধুরীর সৎ সাহস থাকলে তিনি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলতে পারতেন, আমি আমার পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করব না, তোমরা আমাকে অভিশংসন কর। বাস্তবে তিনি তার দলকেও কিছু বললেন না কিংবা তিনি তার পদত্যাগের কারণ সম্পর্কে জনগণকেও কিছু জানানোর সাহস দেখালেন না। তার নিজ দল বিএনপির লোকজনের দাবির মুখে তিনি রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করে সুড় সুড় করে চলে গিয়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদের মর্যাদা ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছিলেন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করে জনাব বদরুদ্দোজা চৌধুরী তার নতুন দল বিকল্পধারা গঠন করলেন। তিনি যখন তার নতুন দলের সমাবেশ করতে গিয়েছিলেন তখন ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা তাকে মারধর করে গায়ের জামা ছিঁড়ে দিয়েছিল। ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের এমন উচ্ছৃঙ্খল আচরণে জনাব চৌধুরী হয়তো কিছু মনে করেননি কিন্তু আমরা যারা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আত্দমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই তারা মানসিকভাবে সেদিন ভয়ানক লাঞ্ছিত হয়েছিলাম।

টুকরো চিত্র-৩

জনাব বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং তার সমমনা অনেকে এখন সর্বদলীয় সরকার গঠনের দাবি তুলছেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা যখন সর্বদলীয় সরকার গঠন করে তার অধীনে নির্বাচন করার আহ্বান জানিয়েছিলেন তখন জনাব চৌধুরী এবং তার সমমনা রাজনীতিক এবং বুদ্ধিজীবীরা সে প্রস্তাবটি নাকচ করে দিলেন কেন? তখন তারা সরকারের প্রস্তাব মেনে নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিলে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় পাঁচ শতাধিক মানুষের প্রাণহানি এবং শতাধিক স্কুলঘর পুড়ে ভস্ম হতো না। নির্বাচনের পরে এক বছর পার হয়ে গেলে তারা এখন সর্বদলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার খায়েশ প্রকাশ করছেন। সেই সঙ্গে দেশে নতুন নির্বাচন আয়োজনের দাবি আদায়ের জন্য তাদের ডাকা অবরোধ-হরতাল কর্মসূচির আগুনে আরও পঞ্চাশজন মানুষের প্রাণপ্রদীপ নিভে গেছে। জানের সঙ্গে কী পরিমাণ মাল গেছে সে হিসাব করার শক্তিও আমরা হারাতে বসেছি। এখন মনে হচ্ছে, রাজনীতিকরা ষোল কোটি মানুষকে উলুবনের চেয়ে তুচ্ছজ্ঞান করছেন। তারা ভাবছেন, আমাদের জানমাল, রুটি-রুজির উপায় সব তারা খেয়াল খুশিমাফিক পায়ে পিষে গদিতে চড়ার সিঁড়ি গড়বেন আর আমরা শুধু বেঘোরে মরতেই থাকব। কিন্তু এ অবস্থা কি অনন্তকাল চলতে পারে?

বিএনপি-জামায়াত চক্র এবং তাদের জনবিচ্ছিন্ন খুচরা সঙ্গীরা গণআন্দোলন শব্দের অপব্যবহার করে যেভাবে নরহত্যায় মেতে উঠেছেন তাতে 'গণআন্দোলন' শব্দটি প্রকৃত অর্থ হারাতে বসেছে। ভবিষ্যতে গণআন্দোলন শব্দ নিজস্ব অর্থ হারিয়ে বাংলা অভিধানে সহিংসতা অর্থে ব্যবহার হলে আমাদের অবাক হওয়ার কারণ থাকবে না। আরবি ভাষায় রাজাকার শব্দের নিশ্চয়ই একটি ভালো অর্থ আছে। কিন্তু সেই অর্থ বাংলায় কোনোদিন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ একাত্তর সালে অনাচারী রাজাকার গোষ্ঠী রাজাকার শব্দটিকে মূর্তিমান ঘৃণায় রূপান্তর করে ফেলেছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন ইত্যাদি ঐতিহাসিক ঘটনার জন্য আমরা এখনো গর্বিত। বর্তমানে কিছু ক্ষমতালোভী অনাচারী দেশে গণআন্দোলনের নামে যেভাবে হত্যা এবং সম্পদ ধ্বংসের নেশায় মেতে উঠেছে তাতে ভবিষ্যতে গণআন্দোলন শব্দটি শুনে মানুষ ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। হরতাল, অবরোধ, গণআন্দোলন ইত্যাদি শব্দ জনমনে এখন মূর্তিমান আতঙ্ক। আশঙ্কা হচ্ছে, পরিস্থিতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাজনীতি শব্দটিও হয়তো বাংলা অভিধানে অক্ষত অর্থে টিকে থাকতে পারবে না। রাজনীতি শব্দটি ঘৃণা শব্দের সমার্থক হয়ে গেলে সেটি পেশাদার রাজনীতিবিদদের জন্য সুফল বয়ে আনবে না।

লেখক : কথাসাহিত্যিক

 

 

সর্বশেষ খবর