সোমবার, ৯ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা

যোগ-বিয়োগের আলোছায়া

আবু তাহের

যোগ-বিয়োগের আলোছায়া

উপভোগ্য ও স্মরণীয় যত মানব চরিত্রের দেখা পেয়েছি সবই পেয়েছি ভ্রমণকালে। ব্যতিক্রম তিন কুদ্দুস। এদের মধ্যে একজনের নামের শুরুতে 'সৈয়দ'। এর বাড়ি কুমিল্লায়। ঢাকায় তার ওষুধের দোকান তিনটি। তিনি বসতেন শাজাহানপুরের দোকানে। ১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে তার দোকানের অদূরে রেলওয়ে মাঠে আমরা ব্যাডমিন্টন খেলতাম। খেলার আগে-পরে তার দোকানে কিছুক্ষণ আড্ডা দেওয়াটা আমাদের পেশা। কারণ আর কোথাও মাগনায় চা-ডালপুরি খাওয়ার সুযোগ নেই।

সৈয়দ আবদুল কুদ্দুসের মতো পরোপকারী মানুষ খুব কমই দেখেছি। কেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স তিনি; সাধারণ জ্ঞানও প্রচুর। দুঃখের বিষয় উচ্চারণ দোষমুক্ত নন। মাঝে-মধ্যে তিনি দার্শনিকসুলভ কথাবার্তা বলতেন। একবার বললেন, 'শোন আমার দামড়া ভাই সকল! জীবন চলে আলোছায়ার যোগ-বিয়োগে কিংবা বলতে পার, জীবন চলতেছে যোগ-বিয়োগের আলোছায়ায়। আলো দেইখা বেশি নাচবা না। অাঁধার দেইখা আইমিন ছায়া দেইখা ভেউ ভেউ কইরা বিলাপ করণেরও কাম নাই। তুমি হইলা পাইটার। পাইট অ্যান্ড পাইট টিল ইয়োর বিক্ট্রি।'

ব্যাচেলরদের 'দামড়া' সম্বোধন করে মজা পেতেন কুদ্দুস ভাই। দোকানের এককোণে কাচঘেরা খাসকামরা তার। সন্তোষ নামের এক তরুণ কর্মচারী ওই কামরার দরজায় পর্দা লাগানোর আয়োজন করছে। দুই প্রান্তে দুই পেরেকের সঙ্গে তার ফিট করা হয়েছে। তারটি ত্যাড়া দেখাচ্ছিল। আমরা সৈয়দ আবদুল কুদ্দুসকে সেই ত্রুটি ধরিয়ে দিই। তিনি বলেন, 'বাবা সন্তোষ! যে কাজই করবা ফারফেক্টলি করবা।' আমরা জানাই, 'পারফেক্টলি' বলাটাই শোভন,- 'ফারফেক্টলি' ভুল। তিনি বলেন, 'বুঝছি।' এরপর হাঁক দিয়ে সন্তোষকে বলেন, 'যা করতেছ ফারপেক্টলি কর।' আমি বললাম, কিছুটা ঠিক হয়েছে। তিনি বলেন, 'কিছুটা কইতেছ কেন! পুরাটাই হইছে।'

বললাম, আপনি 'প'-এর জায়গায় 'ফ' আর 'ফ'-এর জায়গায় 'প' বলে ফেলেছেন। কুদ্দুস ভাই বলেন, 'তোমারে লইয়া ভারি ফ্রবলেম! তুমি তো তোমার ভাবীর মতো!' আমরা জানতে চাইলাম, ভাবীর সঙ্গে সমস্যা কী। তিনি বলেন, 'তোমাদের ভাবী কথায় কথায় খালি আমার পল্ট ধরে।' কেন ধরে? তিনি জানান, 'আমি তো রিস্কারে রিস্কা কইতে পারি না। সে জন্য আমারে ব্যাঙ্গায়।' আমাদের প্রশ্ন, 'তাইলে রিস্কারে আপনি কী কন?' তিনি বলেন, 'রিস্কা কই।'

ভুল উচ্চারণ বিয়োগ করার চেষ্টা করতে করতেই ১৯৮৮ সালে ইহজ্জীবন সাঙ্গ করেছেন সৈয়দ আবদুল কুদ্দুস। মৃত্যুর দিনচারেক আগে হাসপাতালে তাকে দেখতে গেছি। তিনি তার রোগার্ত বাম হাত বাড়িয়ে সহাস্যে আমার ডান হাত ধরে বলেন, 'হাউ ইজ লাইফ?' মরণাপন্ন ব্যক্তি সুস্থ এক ব্যক্তির কুশল জানতে চাইছে। কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তিনি বলেন, 'লাইফরে লাইপ কই নাই দেখছ? এক্কেরে পারফেক্ট উচ্চারণ।'

জাতীয় প্রেসক্লাবের ম্যানেজার ছিলেন আরেক আবদুল কুদ্দুস। সাংবাদিকতায় তখন আমার নবিসী চলছে। আমরা পাঁচ নবিস রোজ যাই ক্লাবে; সেখান থেকে জিপ চেপে হাজির হই তেজগাঁয় কর্মস্থলে। এক বিকালে আবদুল কুদ্দুস আমার কাছে জানতে চান, আমার বাড়ি অমুক জেলায় কিনা। অমুক স্কুলে পড়তাম কিনা, আমার বন্ধু অমুক কিনা। 'হ্যাঁ' সূচক জবাব দিয়ে আমি বলি, 'আপনি জানেন কীভাবে!' কুদ্দুস বলেন, 'আপনার বন্ধুর বাড়িতে থাকতাম আমি।' আমার প্রশ্ন, 'লজিং থাকতেন?' তিনি বলেন, 'জী না। ওই বাড়িতে চাকরপোলা ছিলাম। 'আমারে লেখাপড়া শিখাইছে আরজু ভাই।'

আরজু ভাই মানে বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার হাবিবুর রহমান। এর ছোট ভাই মাহমুদুর রহমান বেলায়েত (মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও প্রাক্তন এমপি) আমার বাল্যবন্ধু। তাদের বাড়িতে আমার ঘন ঘন যাতায়াত ছিল কৈশোরে। গৃহকর্মী কুদ্দুসের তা মনে আছে। কুদ্দুসের জীবন থেকে নিরক্ষরতা বিয়োগ করে আলোর সংযোগ ঘটিয়েছেন আরজু ভাই। বিষয়টি কৃতজ্ঞচিত্তে আজও স্বীকার করেন ম্যানেজার কুদ্দুস। আমার কাছে নিজেকে এভাবে প্রকাশ না করলেও কুদ্দুসের কিছু যেত আসত না। মনে হলো, আধুনিকতার প্রথাগুলো নিজ জীবনে যোগ করার দিকে তার কোনো আগ্রহ নেই। প্রথা হচ্ছে, যে তোমায় হাঁটতে শেখাল তাকে ল্যাং মেরে ফেলে দাও। যে মই বেয়ে ধাপে ধাপে পৌঁছে গেছ শিখরে, সেই মইটাকে চুরমার করে নিজেকে হিরণ্ময় প্রতিভার জ্যোতিতে ভাস্বর কর।

এবার বলা যায়, পাবনার ছেলে আবদুল কুদ্দুসের কথা। সে টগবগে তরুণ। বিএ পাস করে চাকরি খুঁজছে। যেতে চায় আবুধাবি। এই ফাঁকে নিজেকে যোগ করেছে মামার মুদি দোকানে, মাতব্বরি করছে। দোকানের বাঁধা কাস্টমার আমি। মাছ আর আনাচ তরকারি কিনতে যাওয়ার আগে কুদ্দুসের হাতে তেল-ডাল-চিনি ইত্যাদির তালিকা দিই। সে রেডি করে রাখে। ফেরার পথে রিকশায় বসা আমার অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে মুদি মাল যোগ করে দেয় কুদ্দুস। মাছের বেপারি এক সন্ধ্যায় আমাকে তিনটা একশ টাকার নোট ধরিয়ে দেয়। স্কচটেপ দিয়ে তিনটি করে জোড়া প্রতিটি নোটে। এ নোট কেউই নেয় না। পাল্টিয়ে নেব উপায় নেই। কোন্ বেপারি দিল, মনে নেই। এভাবে দেড় মাস গেল।

সিদ্ধান্ত নিলাম, কুদ্দুসের ক্যাশের নোটগুলোর সঙ্গে অচল তিনখানা নোট যোগ করে দেব। ওকে গিয়ে বললাম, এসব কী দিলে কুদ্দুস। ওর সামনে মেলে ধরি অচল নোট। সে বিস্মিত হয়ে বলে, 'আমি দিয়েছি!' বললাম, 'অবশ্যই।' কোন্দিন সে দিয়েছে জানতে চাইলে বলি, 'গতকাল'। সে বলে, 'স্যরি!' ক্যাশ বাক্স থেকে কড়কড়ে তিনটা নোট বের করে আমার হাতে দিল কুদ্দুস। এরপর তালিকা অনুযায়ী পিয়াজ-লবণ-ময়দা-সাবান এসব ব্যাগে ভর্তি করে বলে, 'ঠিক আছে?' মাথা নেড়ে বুঝাই 'ঠিক আছে।' লেনদেন সমাপ্ত। কিন্তু কুদ্দুস যোগ করে, 'একটা কথা বলব স্যার?' আবারও মাথা নেড়ে সম্মতি জানাই। পাবনার আবদুল কুদ্দুস মিষ্টি হাসির সংযোগে বলল, 'কাল কিন্তু আপনি বাজারে আসেননি স্যার।'

স্বল্প কথায় কিছু শুনিয়ে কাউকে স্তম্ভিত করে দেওয়াকে আমার অঞ্চলে বলে 'আড়ম্বুশ করা।' কুদ্দুসের হাতে আড়ম্বুশ হয়ে ভাবি, নোটগুলো ফেরত দিয়ে দিই। কিন্তু সে বলে, কোনো সমস্যা না স্যার। অচল নোট দিয়ে কেউ আপনাকে ঠকাতে পারবে না।' এরপর যোগ করে, 'আমি আছি না! আমাকে দেবেন। পাল্টে একদম ফ্রেশ নোট দেব আপনাকে।' ফের আড়ম্বুশ হলাম।

আড়ম্বুশবিষয়ক ঘটনার বিবরণ শুনেছিলাম এক্সপ্রেস ট্রেন 'সুবর্ণ'র ভিতর। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরছি। পাশের আসনের যাত্রী ওসমান শরীফ জানান, তাদের এলাকায় স্তম্ভিত হওয়াকে বলে 'পট্টাশ' হওয়া। একবার ওসমানের বাড়িতে চুরি হয়েছিল। চোরেরা বাড়ির অনেক মালপত্র চুরি করলেও তার পিতামহীর সিন্দুকে রাখা ৩৫ হাজার টাকায় হাত দেয়নি। অথচ তার পিতার অনুমান, 'জমি বিক্রির টাকা আম্মার সিন্দুকে আছে নিশ্চিত হয়েই চোরেরা হানা দিয়েছে।'

সিন্দুকের সব মাল চুরি গেছে। টাকাভর্তি চটের ব্যাগটি অক্ষত। ব্যাগে সাঁটানো এক টুকরা কাগজে লেখা- 'বেজন্মার ব্যাটা বেজন্মা। তোদের শরীরে দয়ামায়া বলতে কোনো পদার্থ নেই? দীর্ঘ পনের দিনের সাধনায় স্কিম তৈরি করে তোদের ঘরে ঢুকলাম। তোরা সব জাল নোট রাখলি! তোদের হাত কেটে পায়ে, পা কেটে হাতে ফিট করে দেওয়া উচিত।'

'দাদিজান এ চিরকুট পড়ে পট্টাশ হয়ে গেলেন' জানান ওসমান শরীফ, 'জমিটা কিনেছিলেন আমার ছোট ফুফাজান। পঁয়ত্রিশ হাজার টাকার জালনোট যে তিনিই তার শাশুড়িকে গছিয়েছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।' পরে কী হলো? ওসমান শরীফের পিতার সঙ্গে যোগ হলেন তার তিন চাচা। চার ভাই তাদের হারামখোর ভগ্নিপতিকে বিয়োগ করে দিলেন। ওসমানের ভাষায়, ঐতিহাসিক বিয়োগ। মাঘের প্রচণ্ড শীতে ছোট ফুফাজানকে রাতভর পুকুরের পানিতে গলাসমান শরীর ডুবিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখার পর মুক্তি দেওয়া হয়। প্রভাতে ছোটকাকা ঘোষণা করেন, 'যা'! সোজা তোগো বাড়িত যা। আর যদি এ বাড়িতে আসিস তাহলে...।'

যে ভাষায় কর্কশ কণ্ঠে ছোটকাকা হুমকি দিলেন তাতে ওসমান শরীফের মনে হলো, ছোট ফুফা তার শ্বশুরালয়ে এলে সুমুন্দিরা তাদের ভগ্নিপতির মুণ্ড কেটে পৃষ্ঠদেশে ফিট করে দেবেন। কিন্তু ফিট যা করার ফুফা-ই করলেন। একদিন পর ওসমানদের বাড়ি ঘেরাও করে পুলিশ এবং তল্লাশি চালিয়ে, 'গোপন সূত্রে পাওয়া' সংবাদের সত্যতা পায়। দারোগা বলেন, জালনোটের কারবার! আমার এলাকায় এসব চলবে না। গ্যাঙ্গে আর কেডা কেডা আছে কইয়া ফালান। নইলে থানায় নিয়া এমন ডলা দিমু সিঙ্গাপুর দিনাজপুর কুয়ালালামপুর গোলাইয়া ফেলবেন।

কঠিন কেস্। থানার এক দালাল এসে ওসমানের পিতাকে বলে, 'মলম লাগান। কেস্ হাওয়া করে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।' পিতা জানতে চান, মলম মানে? চোখ মেরে দালাল বলে, 'জাল যত আসল তত।' অর্থাৎ ৩৫ হাজার টাকা দিতে হবে উৎকোচ।

'জাল যত আসল তত' খুবই তাৎপর্যবহ বাক্য। এ বাক্যের তিনগুণ দীর্ঘ একটি বাক্য পুরনো একটি কাহিনীর শেষে জুড়ে দিয়ে মানুষের চিন্তা-চেতনায় প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দেন সাহিত্যিক তারাপদ রায় (জন্ম টাঙ্গাইল জেলায়, ভারতীয় সরকারি আমলা, মারা যান কলকাতায়)।

রাজা যাচ্ছেন শিকারে। ধোপা ঢুকছে রাজবাড়ি। বলল, 'শিকারে যাবেন না হুজুর। জড়তুফান আসছে।' মেঘমুক্ত আকাশ দেখে রাজা বলেন, 'ভাগ্!'

কিন্তু দুই প্রহর পরে প্রচণ্ড ঝড়। রাজা ভাবেন, বাহ! ধোপা তো আগাম বলতে জানে। ওকে আবহাওয়া দফতরের মন্ত্রী করতে হয়। ধোপা বলে, 'এতে আমার কোনো কৃতিত্ব নেই। যেদিন ঝড় হবে সেদিন ভোর থেকেই আমার গাধার লেজ খাড়া হয়ে যায়। ওটা দেখেই আমি ভবিষ্যদ্বাণী করি।' রাজা বললেন, 'তাহলে তোমার গাধাকেই মন্ত্রী নিয়োগ করলাম। ব্যস্, গাধা হয়ে গেল আবহাওয়া মন্ত্রী। তারাপদ রায় যোগ করলেন, 'সেই যে উচ্চপদে গাধারা বসতে শুরু করল সেই ট্র্যাডিশন এখনো চলছে।'

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

সর্বশেষ খবর