সোমবার, ৯ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা
প্রসঙ্গক্রমে

এ দেশের বামদের অতীত ভুল বর্তমান ভুল, ভবিষ্যৎও ভুল

মোশাররফ হোসেন মুসা

আমরা বিতর্ককালে প্রতিপক্ষকে জব্দ করার জন্য বলি- 'যদির কথা নদীতে ফেলুন।' কিন্তু যদি যুক্ত সব বাক্যকেই নদীতে ফেলা যায় না। যেমন- আমাদের বেশি বয়সী নিকটাত্দীয়রা যখন বলেন- 'তিনি যদি যুবক বয়সে লেখাপড়ায় একটু মনোযোগী হতেন তাহলে এর চেয়েও ভালো চাকরি পেতেন।' আবার একইভাবে আরেকজন আত্দীয় যখন বলেন- 'তিনি যদি প্রথম জীবনে অমুক ব্যবসাটি অাঁকড়ে ধরতেন তাহলে শেষ বয়সে কষ্ট করে ভাড়া বাড়িতে থাকতে হতো না।' আমরা তখন তাদের কথাগুলো নিজেদের অভিজ্ঞতার স্বার্থেই মনোযোগ দিয়ে শুনি। এ দেশের বামপন্থি রাজনীতিকদের বেলায়ও একই উদাহরণ খাটে। তাদের অতীতের ব্যর্থতার ঘটনাগুলো সামনে আনা হলে প্রবীণ বামপন্থিরা সরাসরি ভুল স্বীকার না করে যদি দিয়ে নানা রকম বাক্য তৈরি করে ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করেন। তারা স্বীকার করুক বা না করুক, তারা যে অতীতে বহু ভুল করেছেন এটি এখন ইতিহাসসিদ্ধ বিষয়। তাদের বর্তমান ভুলগুলো সম্পর্কে আমরা কমবেশি অবগত আছি। তাদের অতীত ও বর্তমান কর্মকাণ্ডের বিচার করে অনুমান করা যায়, তারা ভবিষ্যতেও একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করবেন। জগদ্বিখ্যাত দার্শনিক কার্ল মার্কস বলেছেন- 'দার্শনিকরা এতদিন জগৎকে ব্যাখ্যা করেছেন নানাভাবে। এখন প্রয়োজন এটিকে পাল্টে ফেলা।' তাই সমাজ পরিবর্তনে বিশ্বাসী যুবকরা মার্কসীয় দর্শনে আকৃষ্ট হয়ে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে যোগ দেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তাদের ভুল রণকৌশলের কারণে সমাজের মঙ্গলের চেয়ে অমঙ্গল হয় বেশি। সাম্রাজ্যবাদ ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ প্রত্যেক জাতির স্বাধীনতা আন্দোলনে তাদের ব্যাপক ভূমিকা থাকে। কিন্তু আন্দোলনের সুফল ভোগ করে মধ্যপন্থিরা কিংবা প্রতিক্রিয়াশীলরা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তাদের নেতা-কর্মীরা জেল-জুলুম ভোগ করেও স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হন। পাকিস্তান আমলে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ও নেতৃত্ব উভয় ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের হাত ধরে যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে তার নেতৃত্ব দেয় আওয়ামী লীগ। একই ঘটনা পুনর্বার কেন ঘটছে, প্রশ্ন করা হলে প্রবীণ বামপন্থিরা 'যদি' দিয়ে যেসব বাক্য গঠন করেন তা হলো- 'এ দেশের কমিউনিস্টরা রাশিয়ায় গিয়ে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করে প্রথম ভুল করেন। যদি তারা ভারতে বসে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করতেন এবং যদি রাশিয়ার মুখাপেক্ষী না থেকে স্বনির্ভর অবস্থানে থেকে কর্মসূচি গ্রহণ করতেন তাহলে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস অন্যরকম হতো। যদি তারা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে প্রধান এজেন্ডা হিসেবে গ্রহণ করতেন তাহলে কংগ্রেস নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পেত না। চীন-রাশিয়ার দ্বন্দ্বকে আদর্শগত দ্বন্দ্ব মনে করা তাদের ভুল ছিল। যদি তারা সেটাকে দুই দেশের স্বার্থগত দ্বন্দ্ব মনে করে নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকতেন তাহলে কমিউনিস্ট পার্টি এভাবে বহু খণ্ডে বিভক্ত হতো না।' বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে না পারার কারণ প্রসঙ্গে তাদের বক্তব্য একই রকমের। তারা বলেন- 'জাতিদ্বন্দ্ব ও শ্রেণিদ্বন্দ্বকে গুলিয়ে ফেলা ঠিক হয়নি। যদি তারা '৭০ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতেন তাহলে আওয়ামী লীগ এককভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পেত না। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের বিরোধিতার নামে 'জাসদ' মার্কা রাজনীতিরও জন্ম ঘটত না। প্রতিবাদী যুবকরা তখন তাদের নেতৃত্বেই পরিচালিত হতেন। ফলে নিয়মতান্ত্রিক ধারাবাহিকতায় তারা '৮০ সালের আগেই ক্ষমতায় চলে যেতেন।

বর্তমানে বামপন্থিরা একদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধিতা করছে এবং অন্যদিকে সরকারের কাছে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার দাবিও জানাচ্ছে। বর্তমানের জঙ্গিবাদ উত্থান প্রসঙ্গে তাদের মূল্যায়ন হলো- 'মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার জন্য জঙ্গিবাদকে উসকে দিচ্ছে। মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি হয়ে গেলে ধর্মীয় উন্মাদনার বিষয়টি আর থাকবে না।' গণতন্ত্রে নির্বাচন হলো অপরিহার্য অনুষঙ্গ। যেহেতু তারা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়া বিশ্বাস করে না, সে কারণে নির্বাচনকে আন্দোলনের কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। তারা ২০১৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেও তথাকথিত কৌশলের কারণে আসন্ন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা এ বিষয়ে যুক্তি দেখান, লেনিনও সোভিয়েত (স্থানীয় সরকার) সমূহে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তবে তা ছিল বিপ্লবের মাধ্যমে জাতীয় ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে জনগণকে সম্পৃক্ত করা।

তারা মাওয়ের যুগে গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাওর উদাহরণও দেন। তারা ভুলে যান যে, সামন্ত যুগ আর নেই। বর্তমানে একটি শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছে। তা ছাড়া ৩০ ভাগ লোক শহর এলাকায় বসবাস করছে এবং গ্রামগুলোও আগের চেহারায় নেই। বর্তমানে ব্যাপক জনসম্পৃক্ততার প্রধান উপায় হলো নির্বাচন। এ অবস্থায় গণঅভ্যুত্থান তথা ক্ষুদ্র রেজিমেন্টেড গোষ্ঠী দ্বারা ক্ষমতা দখল অলীক স্বপ্ন ছাড়া কিছু নয়। সে জন্য ১০-১৫ বছর পর বর্তমান সম্পর্কে তাদের মূল্যায়ন হবে- 'শর্তসাপেক্ষে হলেও ২০১৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা উচিত ছিল।

নির্বাচন বর্জন করায় মৌলবাদী রাজনীতিই লাভবান হয়েছে। যদি সর্বস্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য একটি ডিজাইন গ্রহণ করে আন্দোলন শুরু করা হতো তাহলে মৌলবাদীরা নেতৃত্বে চলে আসার সুযোগ পেত না।' তারা অনুতপ্ত হয়ে আরও বলবেন- 'আমাদের মনে রাখা উচিত ছিল, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন একই সঙ্গে সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনও।'"

লেখক : গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক।

ই-মেইল :  [email protected]

 

 

সর্বশেষ খবর