বৃহস্পতিবার, ১৬ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা

একটি মৃত্যু

তসলিমা নাসরিন

একটি মৃত্যু

কত ছেলেকে রাস্তায় পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। কত ছেলে মার খেয়ে খেয়ে বেঁচে থাকে। তাদের খবর ক'জন রাখে! কত মেয়েকে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়। কত মেয়েকে প্রতিদিন স্বামীর অত্যাচার সইতে হয়।

সেদিন সিলেটের এক গ্রামে একটা বাচ্চা ছেলেকে আধমরা ফেলে রাখলে আমরা খবর পেতাম না। রাজনের মৃত্যুর খবর আমরা পেয়েছি ফেসবুকে খবরটা ছড়িয়ে দেওয়ার পর, সঙ্গে ভিডিও-ও ছিল। তা না হলে রাজন মরে পড়ে থাকলেও কার কী যেতো আসতো! মানুষ তো মানুষ মানুষকে পেটাচ্ছে, ঢিল ছুড়ছে, হয়রানি করছে, এসব দেখে অভ্যস্ত, এসব নৃশংসতা দেখে সবাই যে যার মতো বাড়ি চলে যায়, সংসার করে।

ফুটপাতের মৃতদেহ ডিঙিয়ে সকালে আপিসের দিকে হাঁটে। কারও সময় নেই থমকে দাঁড়িয়ে থাকার, অথবা প্রতিবাদ করার। মানুষ দল বেঁধে দেখে যখন কোনও মেয়েকে পাথর ছুড়ে হত্যা করা হয়। মানুষ হাততালি দেয় যখন কাউকে উলঙ্গ করে গ্রাম জুড়ে হাঁটানো হয়। এ কি মানুষের আজকের স্বভাব? আদিকালে মানুষকে শূলে চড়ানো, ফাঁসিকাষ্ঠে চড়ানো, ক্রুশবিদ্ধ করা- সবই জনতার সামনে হতো। জনতা হাততালি দিত, হাসতো, ঘৃণা ছুড়ে দিতো অত্যাচারিত নির্যাতিত অসহায় মানুষগুলোকে লক্ষ্য করে। এ আমাদের মানুষজাতির ইতিহাস।

হঠাৎ করে দু'দিন আগের একটি মৃত্যু নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ কান্নাকাটি করছে। বাংলাদেশের এক গ্রামে রাজন নামের একটা গরিব ছেলেকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে কিছু লোক। পেটানোর দৃশ্য অনেকে দেখেছে। দেখেছে আর হেসেছে। পিটিয়ে মেরে ফেলার ভিডিও ওরা ফেসবুকেও দিয়েছে। এই যে মানুষের সামনে দিনের বেলায় একটা ছেলেকে মেরে ফেলা হলো, কেউ কি বাঁচাতে এসেছে রাজনকে? কেউ আসেনি।

আমি কিন্তু এ কথা বলতে চাইছি না যে 'রাজনকে গরিব করেছে এই সমাজ, দোষটা রাষ্ট্রের। চুরি না হয় করেছে রাজন, তাই বলে মেরে ফেলতে হবে?' আমি শুধু বলতে চাই, মানুষ নামক জাতটার জন্য বর্বরতা নৃশংসতা নিষ্ঠুরতা হিংস্রতা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। দুর্বলকে মেরে ফেলে মানুষের মতো কাজই করেছে ওরা। সবল-মানুষ দুর্বল-মানুষকে মারে। ধনী-মানুষ গরিব-মানুষকে মারে। পুরুষ-মানুষ মেয়ে-মানুষকে মারে। নানা কায়দায় মানুষ মানুষকে মারে। প্রতিদিন মারে। কেবল রক্ত গড়ালেই আর শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হলেই কি মৃত্যু ঘটে? অনেকে মার খেতে খেতে মৃতবৎ বেঁচে থাকে।

গোটা জগত জুড়ে মারামারি চলছে।

কিছু কিছু মানুষ মারামারি ঠেকাতে রূপকথার আশ্রয় নেয়, ঈশ্বরের ভয় দেখিয়ে মানুষকে শান্ত করে। কিছু কিছু মানুষ আইন বানিয়েছে, শাস্তির ভয় দেখিয়ে মানুষের রক্তপিপাসা কমায়। কিছু শুভবুদ্ধির মানুষ ইস্কুল খুলেছে, মানুষকে খুনি না হওয়ার পরামর্শ দেয়। আজ যদি মানুষ জানে ঈশ্বর, ভগবান বলে কিছু নেই, যদি জানে দেশে কোনও শাস্তির আইন নেই, মানুষ হত্যা করতে তারা আজই ঝাঁপিয়ে পড়বে। রক্তে ভেসে যাবে পৃথিবী। আমি বলতে চাইছি, মানুষ মূলত বর্বর, মূলত ভয়ংকর দানব। মানুষ অত্যন্ত নৃশংস বীভৎস প্রজাতি।

হাতেগোনা কিছু শুভবুদ্ধির মানুষ সাধারণ মানুষকে পরামর্শ দেয় স্বভাব চরিত্র বদলাতে, নৃশংসতা বন্ধ করতে। এ অনেকটা সাপকে ছোবল না দেওয়ার পরামর্শ দেওয়ার মতো।

কেউ কেউ বলছে রাজন চুরি করেছিল, কেউ বলছে রাজনকে কামরুল নামের এক লোক যৌন নির্যাতন করতে চেয়েছিল, কিন্তু রাজন রাজি হয়নি বলে চুরির অপবাদ দিয়ে ওকে মেরেছে। কামরুল কয়েক লাখ টাকা পুলিশকে ঘুষ দিয়ে পালিয়ে যায় সৌদি আরবে। সৌদি আরবে তাকে ধরা হয়েছে। ধরা হয়েছে সম্ভবত মিডিয়া সরব ছিল বলে। তা না হলে ক'জন পালিয়ে যাওয়া ধর্ষক বা খুনিকে এভাবে ধরা হয়!

একবার আমি সচক্ষে দেখেছিলাম বাসের এক পকেটমারকে কী করে পিটিয়েছিল বাসের সব যাত্রী। কারও পকেট থেকে দু'টাকা চুরি করেছিল গরিব পকেটমার ছেলেটি। খবরটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাসের কিছু যাত্রী ঝাঁপিয়ে পড়লো ছেলেটার ওপর। বাসের বাকি যাত্রীরা কী কারণে ছেলেটাকে মারছে সবাই না জেনেই আক্রমণে অংশ নেয়। কী ভীষণ আক্রোশ। পারলে ছেলেটাকে মেরে ফেলে। অন্যকে মারায় যে এত আনন্দ তা না দেখলে বিশ্বাস হতো না। মেরে ছেলেটার হাড়গোড় ভেঙেছিল। রক্ত বেরোচ্ছিল নাক কান মুখ দিয়ে। তারপরও ওরা থামেনি। থামানোর চেষ্টা করে দেখেছি আমিও মার খাচ্ছি। পৃথিবীর আর কোনও প্রাণী নিজেদের এভাবে অত্যাচার করে বলে আমার জানা নেই। মানুষই সম্ভবত একমাত্র প্রজাতি যে অন্য প্রজাতিকে শুধু নয়, নিজ প্রজাতিকেও নির্যাতন করে।

রাজনকে মারার ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছিল বলে রাজনের হত্যাকারীর বিরুদ্ধে আন্দোলন তীব্র হয়। যদি প্রতিটি অত্যাচারের, নির্যাতনের, ধর্ষণের, হত্যার ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করা হয়! মানুষ কি সরব হবে রাজনের মৃত্যুতে যেরকম সরব হয়েছে? এই প্রশ্নটি আমি ফেসবুকেই করেছিলাম। উত্তর যা এলো, তা দেখে আমি থ। মানুষ বলছে, ধর্ষণের ভিডিও পোস্ট করলে ধর্ষিতার প্রতি মায়া হওয়া আর ধর্ষকের বিরুদ্ধে রুখে ওঠার বদলে বরং এই ধর্ষণটাকে তারা উপভোগ করবে। পর্ন ছবিগুলো অনেকটা ধর্ষণের মতোই। আজকাল বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয় যে ভায়োলেন্স আছে, রেপ আছে, চিৎকার আছে।

কদিন পর রাজনকে মানুষ ভুলে যাবে। তার খুনির কোনও বিচার হয়েছে কী না কেউ খবরও নেবে না। নতুন রাজনরা মরবে। মানুষ হয়তো জানবেও না। খুনিরা আর অত্যাচারীরা পার পেয়ে যাবে। গরিব মরলে বেশিরভাগ সময় মানুষ কোনও প্রতিবাদ করে না। গরিবের অপঘাতে মৃত্যুকে অস্বাভাবিক বলে কারও মনে হয় না। হঠাৎ হঠাৎ ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটে। রাজন হত্যার বিচার চাওয়াটা ব্যতিক্রম। বেশিরভাগ হত্যার বিচার চায় না কেউ।

মানুষকে মানুষ হলেই চলবে না। শুভবুদ্ধির মানুষ হতে হবে। তা না হলে মানুষ নামক প্রজাতি শুধু নিজেদের মধ্যে মারামারি করে একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা

 

সর্বশেষ খবর