বৃহস্পতিবার, ১৬ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা

জাতীয় ফল কাঁঠালের দুর্দিন

শাইখ সিরাজ

জাতীয় ফল কাঁঠালের দুর্দিন

সব দিক থেকেই চরম দুর্দিনে পড়েছে আমাদের জাতীয় ফল। মানুষকে আর টানছে না সুমিষ্ট পুষ্টিকর ফল কাঁঠাল। রোজার মাসে এই প্রথমবারের মতো দেশের অধিকাংশ এলাকার বাজারে কাঁঠালের চাহিদা নেই। বাগান মালিক ও চাষিরা শত শত কাঁঠাল বাজারে এনে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। অনেকেই পরিবহন ব্যয় না ওঠার কারণে বাজারের আশপাশে ড্রেনে অথবা খাদে গড়িয়ে দিচ্ছেন পুষ্টিকর সুমিষ্ট কাঁঠাল। প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, কাঁঠাল ফল হিসেবে গরম। অনেকের পক্ষে হজম করা কঠিন। কেউ কেউ এক বসায় একটি কাঁঠাল অনায়াসে সাবাড় করে দিতে পারেন। তারা অবশ্য কোনো সমস্যার কথা বলেন না। তবে কাঁঠালের মিষ্টতা, সুগন্ধ ও পুষ্টি নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু রোজার মাসের কারণে কাঁঠালের তেমন চাহিদা নেই। কাঁঠাল নিয়ে বাগান মালিক, চাষি ও ব্যবসায়ীরা রীতিমতো হাহাকার করছেন। প্রতি বছর কাঁঠালকে ঘিরে গ্রাম পর্যায়ে যে পরিমাণ অর্থের কৃষিবাণিজ্য হয়, এবার তার চার ভাগের এক ভাগও হয়েছে বলে মনে হয় না। চলতি সপ্তাহে চ্যানেল আইতে আমার 'হৃদয়ে মাটি ও মানুষ' অনুষ্ঠানে কাঁঠালের দুর্দশা নিয়ে প্রতিবেদন তুলে ধরেছি। তারপর আমার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অসংখ্য মানুষের মন্তব্য পেয়েছি। যা হোক প্রচারিত প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু আগে তুলে ধরা যাক।

ময়মনসিংহের ভালুকার ভিতর দিয়ে টাঙ্গাইলে যাওয়ার পথে দুই ধারে চোখে পড়ে অসংখ্য কাঁঠালবাগান। গাছে থরে থরে সাজানো কাঁঠাল। সেখানকার কাঁঠালসমৃদ্ধ গ্রাম মেদুয়ারিতে গিয়ে দেখলাম, বাগান মালিকরা গাছ থেকে পরিণত ও পুষ্ট কাঁঠাল নামাচ্ছেন না। কারণ বাজারে কাঁঠালের দাম কম। কৃষক নুরুল ইসলামের বাগানে কাঁঠাল ধরেছে কমপক্ষে হাজারখানেক। অন্য বছরে এর অর্ধেক পরিমাণ কাঁঠাল থেকে যে মূল্য পেতেন এবার সে মূল্যও আশা করতে পারছেন না তিনি। ওই এলাকার রাস্তার ধারে কাঁঠালের অসংখ্য ছোট-বড় স্তূপ। কিন্তু বেচাকেনার তোড়জোড় নেই। নেই পাইকারের হাঁকডাক। মেদুয়ারি গ্রামেরই আরেক বড় কৃষক জহিরুল ইসলাম। এ বছর তার ১০০টি গাছে কাঁঠাল ধরেছে। ফলন এসেছে ভালো। কিন্তু তিনিও এবার গাছ থেকে কাঁঠাল পাড়েননি। বললেন, গত বছরও কমপক্ষে ৩০-৪০ হাজার টাকার কাঁঠাল বিক্রি করেছেন অথচ এবার কেউ দামই বলছে না। যদিও কাঁঠাল উৎপাদনের পেছনে বাগান মালিক বা চাষিদের তেমন খরচ নেই। তার পরও কাঁঠালের বাণিজ্যের ওপরই অনেকটা নির্ভরতা তাদের। টাঙ্গাইলের গারো বাজারে শত শত ভ্যানে, সাইকেলে কাঁঠাল আর কাঁঠাল। কিন্তু কাঁঠাল কেনার জন্য ব্যবসায়ী বা ব্যাপারীর সমাগম নেই। অবিক্রীত পড়ে আছে হাজার হাজার কাঁঠাল। সাধারণত ফলের মৌসুমে গারো বাজার, মধুপুর বা ঘাটাইলের বাজারগুলো অসংখ্য ব্যবসায়ীর পদচারণায় মুখর থাকে। খুঁজে খুঁজে ব্যবসায়ী ও পাইকারের সঙ্গে কথা বললাম। তারা বলছেন, রমজানের কারণেই কাঁঠালের প্রতি আগ্রহ নেই ভোক্তাদের। এবার বাজারে একটি কাঁঠাল ৫ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে না। ৫০টি কাঁঠাল ১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে এমন নজিরও রয়েছে। একইভাবে ঢাকার বাজারে এবার ১০টি কাঁঠাল ১০০ টাকায়ও পাওয়া গেছে। এর পাশাপাশি ঢাকার বাজারেও পাইকারের ঘরে শত শত কাঁঠাল পচে নষ্ট হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। অথচ আমি গত বছর ইংল্যান্ডের বার্মিংহামের বাঙালিপাড়ার দোকানগুলোয় গিয়ে কাঁঠালের দাম দেখে অবাক হয়েছি। সেখানে কাঁঠাল বিক্রি হয় পাউন্ডের মাপে। প্রতি পাউন্ড কাঁঠালের দাম ৬০ ইউরো। চিন্তা করা যায়? বাংলাদেশি টাকায় প্রায় সাড়ে ৫ হাজার। অথচ বাংলাদেশে ওই আকারের কাঁঠাল এবার ৫ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে না। মুক্তবাজার আর বিশ্বায়নের যুগে এই মূল্যপার্থক্য ও গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্যের বাজার অবমূল্যায়ন সত্যিই হতাশাজনক।

গত কয়েক বছরে মধুপুর গড় এলাকায় কাঁঠালবাগান ব্যাপক সম্প্রসারণ হয়েছে। যখন কৃষকের বাড়িতে যে দু-একটি কাঁঠাল গাছ থাকত তা দিয়েই মিটত পারিবারিক চাহিদা। বাজারে কিছু কাঁঠাল উঠত। যাদের বাড়িতে কাঁঠাল গাছ নেই, তারা তা সংগ্রহ করত বাজার থেকে। আর এখন বাড়িতে বাড়িতে রয়েছে কাঁঠাল গাছ। নতুন বাগানও হয়েছে প্রচুর। এতেও কাঁঠালের সরবরাহ ও সমারোহ বেড়েছে। কিন্তু বাজার চাহিদা বাড়েনি। এমনকি কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্যও নেওয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ। স্থানীয় অনেক বাগান মালিক ও কৃষকের বিবেচনায় দিনের পর দিন কাঁঠালের স্বাদ কমে যাচ্ছে। তার দাবি, একদিকে জলবায়ুর পরিববর্তন অন্যদিকে নানারকম কীটনাশক ও সার ব্যবহারের কারণে কাঁঠাল তার বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে। একসময় মধুমাসে কাঁঠালকে ঘিরে গ্রামাঞ্চলে চলত রীতিমতো আনন্দ আয়োজন। সুমিষ্ট কাঁঠালকে ঘিরে অনেক স্বপ্নও থাকত কৃষকের। বছরান্তে কাঁঠাল বিক্রি করে বাড়তি যে টাকা আসত তা দিয়ে কিছু দিন ভালো কাটত দরিদ্র কৃষকের দিন। আবার কারও ঘরে যোগ হতো আনন্দের খোরাক। কিন্তু এবার সে আনন্দে পড়েছে ছন্দপতন।

কাঁঠালের এ হতাশাজনক পরিস্থিতি আমাকে আরও হতাশার মধ্যে ফেলেছে। বিশেষ করে আমার প্রতিবেদন প্রচারের পর ফেসবুকে বহু মানুষের হতাশা, পরামর্শসহ নানা মন্তব্যে প্রথমত নিশ্চিত হয়েছি সারা দেশেই কাঁঠাল নিয়ে এ সংকট চলছে। চাষি ও বাগান মালিকরা মোটেই দাম পাচ্ছেন না। দ্বিতীয়ত, আরেকটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে পৃথিবীর সব দেশেই কাঁঠালের ব্যাপক চাহিদা। দেশে দেশে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে নয় শুধু, বিদেশিদের কাছেও কাঁঠাল পুষ্টিকর সুস্বাদু ফলই নয় শুধু, কাঁঠাল রীতিমতো দামি একটি ফল। মধ্যপ্রাচ্যের কাতারে ৪-৫ রিয়াল দিয়ে কিনতে হয় ছোট এক কৌটা প্রক্রিয়াজাত কাঁঠাল; যা বাংলাদেশি টাকায় পড়ে হাজারের ওপরে। আমাদের দেশের একটি কাঁঠাল দিয়ে অন্তত ৫ কৌটা তৈরি করা সম্ভব। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামে কাঁঠালের চিপস ব্যাপক জনপ্রিয়। সেখানে চিপস উপযোগী কাঁঠালের জাত উন্নয়ন করে কাঁঠালজাত অন্যান্য পণ্যসামগ্রীর পাশাপাশি চিপস তৈরি করা হচ্ছে ব্যাপকভাবে। শুধু তাই নয়, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় স্কুলের শিশুদের ডে মিলের সঙ্গে কাঁঠালের চিপস দেওয়া হচ্ছে। পুষ্টি ও স্বাদের দিকটি খেয়াল করেই পরিকল্পিতভাবে এটি করা হচ্ছে। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত কাঁঠাল শুধু মুখে খাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। বলা বাহুল্য, সঠিক নিয়মে কাঁঠাল থেকে কোষ ছাড়ানো এবং তা সঠিকভাবে পরিবেশনের কোনো নিয়মও আমাদের দেশে অনুসরণ করা হয় না। মানুষ কাঁঠাল ভেঙে খেয়ে ফেলে। এমনটি কাঁঠালের আঠা থেকে মুক্ত থাকার জন্য যে সঠিক ব্যবস্থাপনা সে সম্পর্কেও সঠিক ধারণা নেই সবার।

এ তো গেল একটি দিক। আমাদের দেশের এই জাতীয় ফলটি নিয়ে গবেষণা ও সম্প্রসারণ প্রতিষ্ঠানগুলোর তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। যতদূর জানা যায়, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কাঁঠাল নিয়ে গবেষণা করে দুটি নির্বাচিত জাত অনুমোদন করেছে। শুধু এটুকুই, এর বাইরে দেশের বাজার চাহিদা, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন ও রপ্তানির জন্য কোনো উদ্যোগের কথা এখনো শোনা যায় না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মানসম্পন্ন ফল উন্নয়ন প্রকল্পের সাবেক পরিচালক কৃষিবিদ কামরুজ্জামান জানিয়েছেন, ভিয়েতনাম থেকে চিপস তৈরি উপযোগী কাঁঠালের জাত এ দেশে উৎপাদনের প্রক্রিয়া চলছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে এর চারা তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এটি তো শুধু চিপসের উপযোগী জাত। কিন্তু আমাদের দেশের আদি জাতগুলোর বৈশিষ্ট্য নিয়ে আজ পর্যন্ত কার্যকর কোনো গবেষণা হয়নি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ড. আবুল কালাম আজাদ একসময় কিছু কাঁঠালের জাত ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে কাজ করেছিলেন। তারপর আর ব্যাপকভিত্তিক কোনো কাজ হয়নি কাঁঠালের জাত ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ও দেশের সর্ববৃহৎ ফলের জার্ম প্লাজম সেন্টারের পরিচালক ড. আবদুর রহিম জানালেন, আমাদের জাতীয় ফল কাঁঠালের বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও এ নিয়ে আমাদের কাজ খুবই সীমিত। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কাঁঠালের একটি জাত উন্নয়ন করেছে। সেটি হচ্ছে বাউকাঁঠাল-১। এ ছাড়া কিছুকাল আগে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটেরই একজন গবেষক একাডেমিক গবেষণার অংশ হিসেবে কাঁঠালের বার (আমসত্ত্ব) ও জ্যাম তৈরিতে সাফল্য দেখান। কিন্তু তার গবেষণা যেখানে শেষ এর বাস্তবতাও থেমে গেছে সেখানেই। ড. আবদুর রহিম জানালেন, কাঁঠাল একটি উচ্চ সংকরায়িত ফলগাছ। যে কারণে বাংলাদেশে কৃষকের বাগানে একেকটি গাছের কাঁঠাল বৈশিষ্ট্যগতভাবে একেক রকম। এ হিসেবে বাংলাদেশে কাঁঠালের জাত হিসাব করতে গেলে তা লক্ষাধিক ছাড়িয়ে যাবে। তবে সার্বিক হিসেবে আমাদের দেশে কাঁঠাল প্রধানত দুই রকমের- একটি খাজা কাঁঠাল, অন্যটি গালা কাঁঠাল। আমাদের খাজা কাঁঠালের মতো কাঁঠাল দিয়েই মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড চিপস তৈরি করছে। আর গালা কাঁঠাল দিয়ে জুস, কাঁঠাল কেন, ক্যান্ডি তৈরি করা সম্ভব। শুধু তাই নয়, কাঁঠালের সঠিক ব্যবহার, রেসিপি ও খাওয়ার কৌশল সম্পর্কে সবার মধ্যে ধারণা দেওয়া গেলে কাঁচা কাঁঠাল ও পাকা কাঁঠাল দুয়েরই সবজি হিসেবে দারুণ উপযোগিতা রয়েছে। যে বিষয়গুলো সরকারের গবেষণা ও সম্প্রসারণ বিভাগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের বিশেষ নজর দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে অংশীদারিত্বের (পিপিপি) মাধ্যমেও গড়ে তোলা যেতে পারে বড় কোনো প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা। এত বিপুল সম্ভাবনা থাকার পরও জাতীয় ফলের এ দুর্দশা সত্যিই হতাশাজনক।

এবার পার্বত্য এলাকা থেকে শুরু করে সারা দেশে কৃষকের বাগানে লাখ লাখ কাঁঠাল নষ্ট হয়েছে। কাঁঠালের মতো মূল্যবান ফল পরিণত হয়েছে আবর্জনায়। জাতীয় ফলের এ অবমূল্যায়ন সত্যিই কষ্টকর। আমি বিশ্বাস করি, এবারই জাতীয় ফলের বহুবিধ ব্যবহার, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন এমনকি রপ্তানির বিষয়টি আমলে আনবে সরকার। একই সঙ্গে বিশ্বাস করি, অবশ্যই কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানিগুলো কাঁঠাল নিয়ে দেশি-বিদেশি অনুশীলনগুলোকে অনুসরণ করে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। তা না হলে, আগামী বছরও রমজানে পড়বে কাঁঠালের মৌসুম। তখনো এ দুর্দশায় পড়বে কাঁঠাল বাগান মালিক, চাষি ও ব্যবসায়ী। পাশাপাশি প্রচলিত প্রক্রিয়ায় কাঁঠাল খাওয়ার প্রতিও মানুষের আগ্রহ কমতে থাকবে। জাতীয় ফলের সঠিক মূল্যায়ন না করতে পারা, জাতীয় ফলকে কেন্দ্র করে বড় একটি শিল্প বাণিজ্য বলয় গড়ে না তুলতে পারার ব্যর্থতা আমাদের জন্য সত্যিই লজ্জাজনক।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর