বৃহস্পতিবার, ১৬ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা

বিশ্বাস দ্বারা ইতিহাস পাল্টানোর কসরত

মোশাররফ হোসেন মুসা

ইতিহাস মানে অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনা। সে কারণে ইতিহাসবিদরা ঘটে যাওয়ার ঘটনার সত্যতা প্রমাণের জন্য বিভিন্ন স্থাপত্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের উদাহরণ দেন। এ দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তুগুলোর আবিষ্কার বেশি দিন আগের নয়। সম্ভবত সে কারণে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে পৌরাণিক কাহিনীর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু ইউরোপিয়ান দেশগুলোয় (বিশেষ করে রোম ও গ্রিসে) খ্রিস্টপূর্ব আমল থেকে নগর রাষ্ট্রের দালান-কোঠাসহ বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দৃশ্যমান থাকায় সেখানকার ইতিহাস যুক্তি ও সত্যবাদিতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এখানে বিশিষ্ট গবেষক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বাঙ্গালার ইতিহাস' নামক গ্রন্থের ভূমিকার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, 'যে দেশে শিলালিপি, তাম্রশাসন, প্রাচীন মুদ্রা ও সাহিত্যে লিপিবদ্ধ জনপ্রবাদ ব্যতীত ইতিহাস রচনায় অন্য কোন বিশ্বাসযোগ্য উপাদান আবিষ্কৃত হয় নাই, সে দেশের ইতিহাসের কঙ্কাল ব্যতীত অন্য কিছু আশা করা যাইতে পারে না।'

আমরা জানি, মানুষ স্বীয় বিশ্বাস দ্বারা বর্তমানকে পাল্টাতে সক্ষম হলেও অতীতকে পাল্টাতে পারে না। কিন্তু কিছু ধর্মান্ধ ব্যক্তি যুগে যুগে তাদের বিশ্বাস দ্বারা অতীতকে পাল্টানোর কাজে সচেষ্ট থাকেন। গত বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক কর্মিসভায় বলেছেন, 'হিন্দু দেবতা গণেশের মাথায় হাতির মাথার সংযোজন দেখেই প্রমাণ পাওয়া যায় প্রাচীন ভারতে প্লাস্টিক সার্জারির প্রচলন ছিল। মহাভারতে যে মাতৃগর্ভের বাইরে একটি শিশু জন্মানোর কথা বলা হয়েছে, তাতেই প্রমাণিত হয় এই শিশু আসলে বিশ্বের প্রথম টেস্টটিউব বেবি। রামায়ণ পড়ে জানা যায়, প্রাচীন ভারতেই হয়েছিল বিমানের আবিষ্কার, পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার ও স্টেম থেরাপি' (কালের কণ্ঠ : ৩০ ডিসেম্বরস, ২০১৪)। গত বছর বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর 'আরএসএস' (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ) 'ঘর ওয়াপসি' অর্থাৎ 'ঘরে ফেরা' কর্মসূচি চালু করে। 'আরএসএস'-এর বক্তব্য ভারতীয় মুসলমানরা আগে হিন্দু ছিল। সে জন্য কেউ যদি হিন্দুধর্মে ফিরে আসে তাহলে কোনো বাধা নেই। এ নিয়ে বিতর্ক দেখা দেওয়ায় 'এমআইএম' দলের প্রধান আসাফ উদ্দিন ওয়াসি বলেছেন, 'প্রত্যেক মানুষ প্রথমে মুসলমান হয়ে জন্মগ্রহণ করে। পরে অন্য ধর্ম গ্রহণ করে।' (ইত্তেফাক : ৬ জানুয়ারি, ২০১৫)। অর্থাৎ তারা ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা ইতিহাস পাল্টাতে চান। কিন্তু প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস ঘাঁটলে তাদের বক্তব্যের সমর্থনে যথোপযুক্ত প্রমাণ পাওয়া যায় না। খ্রিস্টপূর্ব আমলেও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বহু সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল। যেমন- মিসরীয় সভ্যতা, মেসোপটেমীয় সভ্যতা, সিন্ধু সভ্যতা, ফিনিশীয় সভ্যতা, পারস্য সভ্যতা, হিব্রু সভ্যতা, চৈনিক সভ্যতা, গ্রিক সভ্যতা, রোমান সভ্যতার নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। হিব্রু সভ্যতা সম্পর্কে উল্লেখ আছে, হিব্রুদের আদিবাস ছিল আরব মরুভূমিতে। বর্তমান ইসরায়েলের অধিবাসীরা হচ্ছে হিব্রুদের বংশধর। পরে হিব্রুদের নেতা হন আবরাহামের নাতি জেকব (হজরত ইয়াকুব আ.)। হজরত ইয়াকুব (আ.) হিব্রুদের নিয়ে আসেন ফিলিস্তিনে। ১৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হিব্রুরা চরম দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েন। জীবন বাঁচাতে তারা চলে যান মিসরে। সেখানকার শাসক ফারাওরা তাদের বন্দী করে দাসে পরিণত করেন। এরপর তাদের উদ্ধার করতে নতুন নেতা মুসা (আ.)-এর আগমন ঘটে। হিব্রুরা সর্বপ্রথম একেশ্বরবাদের কথা বললেও তাদের আগেকার ধর্মীয় আচরণে বহু দেবতার অস্তিত্ব ছিল। জনৈক মৌলবাদী শিক্ষক এ বিষয়ে বলেন, 'এগুলো পরীক্ষায় পাসের জন্য করা যেতে পারে। বিশ্বাস করা যাবে না। এগুলো মানুষের মনগড়া লেখা'।

ইদানীং জন্ম নেওয়া আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন 'আইএস'-এর বক্তব্যও তাই। তারা ঘোষণা দিয়েছে কাবা শরিফ ও মদিনায় হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রওজা মোবারক ছাড়া সব স্থাপনা ধ্বংস করে দেবে। তারা ইতিমধ্যে হজরত ইউনুস (আ.)-এর মাজার ও কিছু পীর-আউলিয়ার মাজারসহ অতীতের বহু স্থাপনা ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা ইরাক ও সিরিয়ার বেশকিছু প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা দখল করে বাজেভাবে লুটপাট করে বিক্রি করে দিচ্ছে। তাদের দখলে এখনো আ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী, গ্রিসীয়-রোমান সভ্যতার বিকাশস্থল এবং মুসলমান-খ্রিস্টানদের নির্মিত স্থাপনাসহ বহুরকম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে। ইউনেস্কোর মতে, এগুলো ধ্বংস হয়ে গেলে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস লেখার জন্য আর কোনো নিদর্শনই অবশিষ্ট থাকবে না। পৃথিবীর কোনো সভ্যতা ও মতবাদই চিরন্তন নয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুই পরিবর্তিত হয়ে পড়ে। কিন্তু কিছু গোড়া প্রকৃতির লোক প্রগতির এ ধারাকে অস্বীকার করে নিজেদের বিশ্বাসমতো বর্তমানকে পাল্টাতে গিয়ে বহু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম দেয়। তাদের গোঁয়ার্তুমির কারণে কোনো কোনো সময় একটি জাতি কিংবা একটি সভ্যতা ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হয়। এখানে আফগানিস্তানের তালেবানি শাসন উদাহরণ হতে পারে। ইদানীং 'আইএস' সিরিয়া ও ইরাকে কিছু অংশ দখল করে মধ্যযুগের খেলাফত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখাচ্ছে, বর্তমান যুগে এটাকে প্রহসন ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না। তারাও একসময় ভুল বুঝতে সক্ষম হবে, তবে বহু রক্তপাতের পর।

লেখক : গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক

ইমেইল[email protected]

 

সর্বশেষ খবর