বৃহস্পতিবার, ১৬ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা
প্রসঙ্গক্রমে

ঈদের অর্থনীতি

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

ঈদের অর্থনীতি

পৃথিবীর তাবৎ দেশ, ধর্ম ও সমাজে স্ব স্ব সংস্কৃতি ও অবকাঠামো অবয়বে উদযাপিত উৎসবাদিতে মানবিক মূল্যবোধের সৃজনশীল প্রেরণার, সখ্য সৌহার্দ্য প্রকাশের অভিষেক ঘটে থাকে। নানান উপায় উপলক্ষে সম্প্রীতিবোধের বিকাশ লাভ ঘটে থাকে, অবনিবনার পরিবর্তে বন্ধন, মতপার্থক্যের অবসানে সমঝোতার পরিবেশ সৃজিত হয়। উৎসবমাত্রই বিশেষ উপলক্ষে আনন্দঘন পরিবেশ। এ পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে কর্মচাঞ্চল্য বাড়ে; চাহিদা ও সরবরাহ, বণ্টন ব্যবস্থায় নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। আর সবই আর্থিক লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, মুদ্রা সরবরাহ তথা দেশজ উৎপাদনে যোজনা সৃৃষ্টি করে। পৃথিবীর তাবৎ দেশ, সমাজ ও অর্থনীতিতে উৎসবই হচ্ছে অন্যতম উপলক্ষ আর্থ-সামাজিক সাংস্কৃতিক ভাব ভাবনার, অকিঞ্চন আকাঙ্ক্ষার প্রয়াস-প্রকাশের। এ উৎসব ধর্মীয়, আবহমান সংস্কৃতির ধারা, পার্বণ কিংবা সম্মিলন ও বিশেষ দিন বা ঘটনা উদযাপন উপলক্ষে পরিপালিত হয়। আঞ্চলিক, জাতীয় এমনকি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও উৎসব পালিত হয়। খ্রিস্টীয় সমাজে বড়দিনের উৎসবে, জাপানে নববর্ষের উদযাপনে, চীনে নানান প্রাকৃতিক উৎসব আয়োজনাদিতে, ভারতবর্ষে পূজা-পার্বণাদিতে প্রচুর কেনাকাটা, পরিবহনব্যবস্থায় ব্যাপক লেনদেন হয়ে থাকে। উৎসবে মানুষ জেগে ওঠে, যাতায়াত-যোগাযোগ বেড়ে যায়, সাক্ষাৎ-সম্মিলনের সুযোগ অবারিত হয়, স্টক মার্কেটে লেনদেনের, উপহার আদান-প্রদানের এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা তথা নতুন পোশাক-আশাক পরিধানের ধুম পড়ে যায়, এমনকি আপ্যায়ন আহারাদি সূত্রেও আয়-ব্যয় ব্যবস্থাপনা বাড়ে। মুসলিম বিশ্বে দুই ঈদের উৎসবে সংযম সাধনায় ত্যাগের আনন্দ, আত্দশুদ্ধি এবং আত্দস্বার্থ উৎসর্গের, হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজায় আত্দশুদ্ধির আনন্দের, অপয়া অসুর সত্তার সংহার, সংবেদনশীলতার শুভ উদ্বোধন উপলক্ষে আর্থ-সামাজিক অবকাঠামোতে প্রাণচাঞ্চল্য পরিলক্ষিত হয়েছে। খ্রিস্টীয় বড়দিনের উৎসব সংবছরের সব বিভ্রান্তি, বিবাদ-বিসংবাদ ভুলে অনাবিল আনন্দ আচার-অনুষ্ঠানে নিবেদিত হওয়ার সুযোগ সমুপস্থিত হয়ে থাকে। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সৎ চিন্তা, সৎ ধ্যান ও অহিংস অভেদ বুদ্ধি-বিবেচনার বাহ্যিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাদের পরিপালনীয় নির্বাণ অনুষ্ঠানাদিতে। উৎসবের সব আয়োজন-আপ্যায়নের মর্মবাণীই হলো সামাজিক সমতা-সখ্য বৃদ্ধি এবং সম্পদ, সুযোগ ও সৌভাগ্যকে বণ্টন ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনা, ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতিতে যা নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। আত্দশুদ্ধির জন্য উৎসর্গ বা সংহার প্রকৃত প্রস্তাবে খোদাভীতি ও তার সন্তুষ্টি অর্জনের উপায় হিসেবে জীবে প্রেম বা দয়া ও সেবার প্রেরণাদায়ক হিসেবে প্রতিভাত হয়। সাড়ে ১৫ কোটি মানুষের দেশে যেখানে মাথাপিছু জিডিপি ১৩৪৫ মার্কিন ডলার, সে দেশে প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর উদযাপনে লাখো কোটি টাকার নগদ লেনদেন হয় শুধু নতুন পোশাক ও বিশেষ খাদ্যসামগ্রী কেনায়, এক-অষ্টমাংশ মানুষের স্বজনদের সঙ্গে যোগ দিতে যাতায়াতে, গরিব ও অসহায়দের মাঝে জাকাত বিতরণে এবং বেতনের সমপরিমাণ বোনাস বিতরণে। বাজারে একসঙ্গে নগদ টাকার এত চাহিদা বাড়ে যে, গ্রাহকের দাবি মেটাতে ব্যাংক ও আার্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কলমার্কেট থেকে কঠিন সুদে টাকা জোগাড়ে নামতে হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তার নগদ নতুন নোটের খাজাঞ্চিখানার দুয়ার খুলে দিতে হয়। সাম্প্রতিককালের ঈদুল ফিতরের এক সপ্তাহ আগে শুধু একটি দিনে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ১৪ হাজার ২৫৮ কোটি টাকার বিশেষ রেপো কিনতে চায়, এ চাহিদার বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের ৯ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকার রেপো এবং ৬ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা তারল্য সংকট মোকাবিলায় বরাদ্দ করে। ঈদ উপলক্ষে প্রবাসীরা প্রত্যাবাসন করেন প্রায় দেড় গুণ বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অন্য সাধারণ মাসগুলোর তুলনায়, সেবা ও রেগুলেটরি সংস্থাগুলোর এ সময় কর্মতৎপরতা চোখে পড়ার মতো। সেখানে ইনফরমাল আর্নিং বেড়ে যায় নানান উপায়ে, এমনকি ফরমাল বকশিশের পরিমাণও যৎসামান্য নয়। ঈদ আসবে বলে রোজা শুরুর আগে থেকে ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট মিডিয়ায় তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় স্পন্সর খোঁজাখুঁজিতে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ আর বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজনে। এ মৌসুমে সব মহলে সৃজনশীল হওয়ার ধুম পড়ে যায়। এমনকি নগদ টাটকা কাগজি নোটের সরবরাহ বাড়াতে হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নকল নোটের জোয়ার ঠেকাতে। গোটা অর্থনীতি যেন জেগে ওঠে। শুধু জেগে ওঠা নয়, রীতিমতো দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে যায়। মূল্যস্ফীতির মাত্রা পরিসংখ্যান ব্যুরোর ফিতায় মাপা না গেলেও তবুও সচল সজাগ সজীব থাকে কেনাকাটা, যাতায়াত, যোগাযোগের। সাম্য ও সামাজিক সংহতির ধর্ম ইসলামের উৎসবগুলোর মধ্যে ঈদের মূল তাৎপর্য হলো আত্দশুদ্ধি ও আত্দোৎসর্গের কঠোর ত্যাগ সাধনার প্রেক্ষাপটে আনন্দঘন সম্মিলন। এ সম্মিলনের আর্থ-সামাজিক তাৎপর্য ব্যাপক। গরিব-দুঃখীদের মধ্যে দান-খয়রাত করা, ভেদাভেদ ভুলে সবার সঙ্গে এ সম্মিলনে শরিক হওয়া, পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময় ও কোলাকুলি করার মাধ্যমে সামাজিকতার বাহ্যিক প্রকাশ ঘটে থাকে। ঈদের এ আনন্দ-উৎসবে শরিক হওয়ার সামর্থ্য সবার সমানভাবে থাকে না। সে জন্য ইসলামে সমাজের ধনী ও বিত্তবান সদস্যদের ওপর দরিদ্র ও বিত্তহীনদের মধ্যে জাকাত ও ফিতরা প্রদানের নির্দেশ রয়েছে। পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে 'বিত্তবানদের সম্পদের ওপর বিত্তহীনদের হক আছে।' (সুরা জারিয়াত, আয়াত ১৯) কোরআনের এ অমোঘ নির্দেশ ঈদুল ফিতরের প্রাক্কালে জাকাত ও সাদাকা প্রদানের মাধ্যমে কার্যকর হয়ে থাকে। বিধান রয়েছে ঈদের নামাজ আদায়ের আগেই জাকাত ও ফিতরা প্রদান করতে হবে। এটা ঈদুল ফিতরের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক তাৎপর্য।

লেখক : সাবেক সচিব

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান

 

সর্বশেষ খবর