শনিবার, ১ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা
জন্মদিন

প্রবাদপ্রতিম এক শিশু চিকিৎসক

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

প্রবাদপ্রতিম এক শিশু চিকিৎসক

ডা. এম আর খান

শিশুবন্ধু, সমাজ হিতৈষী, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসা ক্ষেত্রে দক্ষ প্রশাসক, চিকিৎসা-শিল্প উদ্যোক্তা, সদালাপী, সদা সংস্কার মনস্ক এবং সমাজসেবায় একুশে পদকপ্রাপ্ত জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ রফি খান (সাতক্ষীরায় জন্ম ১ আগস্ট ১৯২৮) যিনি এম আর খান হিসেবে অতি পরিচিত, আজ তার ৮৮তম জন্মজয়ন্তী। তাকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন- জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

মহৎপ্রাণ মানুষরা নিজের জন্য নয় অন্যের কল্যাণে নিবেদন করেন নিজের সব ধন ও ধ্যান-ধারণাকে। উৎসর্গ করেন নিজের স্বার্থ ও ভবিষ্যৎ ভাবনাকে। এম আর খান আনোয়ারা বেগম ট্রাস্ট ফান্ড এমন এক মহৎ উদ্দেশ্যে নিবেদিত, শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন আর অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য তিনি উৎসর্গ করেছেন নিজের সঞ্চয়, সম্পদ ও সামর্থ্য। নিজের একমাত্র কন্যাসন্তান কানাডা প্রবাসী। ২০১১ সালে স্ত্রী আনোয়ারা খানের মৃত্যুর পর নিজের জন্য পরিবারের জন্য যেন তার আর নেই কোনো পিছুটান। তাই একের পর এক প্রতিষ্ঠান গড়ে চলেছেন, দিচ্ছেন দিক নির্দেশনা। তার একান্ত প্রত্যাশা স্থায়িত্ব লাভ করুক জনদরদি এ ফান্ড ও প্রতিষ্ঠান। সাতক্ষীরা তথা দেশের মানুষ পাক স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধ জীবন যাপনের দিশা। সময়ের সিঁড়ি বেয়ে তার নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি দেখেছেন, শিখেছেন এবং উপলব্ধি করেছেন মানুষের অসহায়ত্বকে সহায় হয়ে দাঁড়াবার অনিবার্যতা। 'দুর্বল মানুষ যদি পার হয় জীবনের অথৈ নদী' তাতে নিজের কোনো ক্ষতি নেই বরং বিপদমুক্ত মানুষের কলরবে সাফল্যে ভরবে দেশ ও জাতি। কেন তাই এ পথে পিছিয়ে যাব? রেখেছেন এ প্রশ্ন নিজের কাছে, দেশের কাছে।

জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান মনে করেন, রোগীও একজন মানুষ। আর এ রোগীটি সামাজে আমাদেরই কারও না কারও আত্মীয়স্বজন, এমন কি আপনজন। রোগী যখন ডাক্তারের কাছে আসেন; তখন সাহায্য প্রার্থী, কখনো কখনো অসহায় বটে। আর রোগীটি যদি শিশু হয় তা হলে তো কথাই নেই।

ডাক্তারের কর্তব্য হবে রোগীর কষ্ট গভীর মনোযোগের সঙ্গে ধৈর্য সহকারে শোনা, রোগীর শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। রোগীকে সুস্থ করে তুলতে সঠিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা যেমন প্রয়োজন; তেমনি রোগীর অভিভাবকদের প্রতি ডাক্তারের সহমর্মিতা প্রদর্শন ও আশ্বস্ত করা প্রয়োজন। সব রোগীই তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে এমনটিও ঠিক নয়। কারও কারও সুস্থ হতে সময় লাগতে পারে। মহান আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা রেখে তিনি বলেন, হায়াত ও মউতের মালিক যেমন আল্লাহতায়ালা; তেমনি রোগ হতে মুক্তি দাতাও তিনি। তবে রোগীর আপনজনরা এমন যেন বলতে না পারেন যে- ডাক্তার আন্তরিক ছিলেন না, তার অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে। তার জীবন দর্শন হলো- কর্মচাঞ্চল্য আর মহৎ ভাবনার সরোবরে সাঁতার দিয়ে মানবকল্যাণে নিবেদিত চিত্ততা। নিবেদিতা মেডিকেল ইনস্টিটিউট আর অগণিত শিশু চিকিৎসা সদন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তার সেই স্বপ্নের ডানা মেলে ফিরেছে সাফল্যের আকাশে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিশু, নারী ও অসহায়জনের নতশির, মূক ও ম্লানমুখে হাসি ফুটিয়ে সাফল্যের তারকারা ঝিলিমিলি করে তার ললাটে, তার মুখে-তার সানন্দ তৃপ্তির নিলয়ে। জোনাকির আলো যেমন অমানিশার অাঁধারে মিটিমিটি জ্বলে এক অভূতপূর্ব পেলব শান্তি ও সোহাগের পরিবেশ রচনা করে তেমনি তার সুদক্ষ পরিচালনায়, পৃষ্ঠপোষকতায়, নৈপুণ্যে, নিবেদনে অর্থবহ অবয়ব রচনা করে চলেছে নিত্যনিয়ত। এসবের মাঝে চির ভাস্বর হয়ে রইবে তার স্মৃতি।

নিজের গ্রাম রসুলপুরকে আদর্শ গ্রাম তথা দারিদ্র্যমুক্ত গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার স্বপ্ন উদ্যোগ দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভূয়োদর্শন হিসেবে বিবেচনার অবকাশ রয়েছে। 'নিজের গ্রামকে আগে দারিদ্র্যমুক্ত করি' এ প্রত্যাশা ও প্রত্যয়ে দীপ্ত বাংলাদেশের সব সচেতন মানুষ তার মতো কর্মবীরের অনুসরণে একযোগে কাজ করতে পারলে, সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা সুদূর পরাহত থাকে না আর। 'রসুলপুর আদর্শ গ্রাম' এ মডেলে গড়ে উঠুক বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রাম ও জনপদ। ভাবনা ও কর্মযজ্ঞে রসুলপুর হোক পল্লী উন্নয়নে সমৃদ্ধ চেতনার নাম।

শিশুরা দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। মানুষের সৃজনশীল সম্ভাবনার সত্তা তাকে পুষ্টি দিয়ে মননশীল করে সুচিকিৎসা দিয়ে সুস্থভাবে বড় হওয়ার সুযোগ দিতে হবে- এ সুযোগ লাভ তার অধিকার। ডা. এম আর খান শিশু চিকিৎসার ওপর বিদেশে বড় ডিগ্রি অর্জন করে সেখানে উঁচুমাপের চাকরির সুযোগ ও সুবিধা পরিত্যাগ করে চলে এসেছেন নিজ দেশে। দেশে শিশু চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় প্রতিষ্ঠায় অবতীর্ণ হয়েছেন পথিকৃতের ভূমিকায়। সরকার তার এ মহৎ অবদানের যথাযোগ্য স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯৫ সালে তাকে জাতীয় অধ্যাপক পদবিতে ভূষিত করেছেন এবং তার পরিকল্পনায় ও প্রযত্নে শিশু স্বাস্থ্যবিষয়ক জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দিয়েছেন সক্রিয় ও সার্বিক সহযোগিতা। তার মহান ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার কারণেই এ দেশে শিশু চিকিৎসা ক্ষেত্রে নবদিগন্তের সূচনা সম্ভব হয়েছে।

তিনি শেরেবাংলা জাতীয় স্মৃতি সংসদ স্বর্ণপদক (১৯৯২), কবি কাজী নজরুল ইসলাম জাতীয় স্বর্ণপদক (১৯৯৩), কবি সরোজিনী নাইডু স্মৃতি পরিষদ স্বর্ণপদক (১৯৯৭), খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা স্বর্ণপদক (১৯৯৮), বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক সমাজসেবা স্বর্ণপদক (১৯৯৯), ইবনে সিনা স্বর্ণপদক (১৯৯৯), নবাব সলিমুল্লাহ পুরস্কার (২০০৬), একুশে পদক (২০০৯)সহ বিভিন্ন পুরস্কার ও পদকে ভূষিত হন।

লেখক : সাবেক সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির চিফ কো-অর্ডিনেটর ও চট্টগ্রাম স্টক এঙ্চেঞ্জের চেয়ারম্যান।

 

সর্বশেষ খবর