শনিবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

শিক্ষা, শিক্ষক এবং শিক্ষাঙ্গন

আবু হেনা

শিক্ষা, শিক্ষক এবং শিক্ষাঙ্গন

১৯৫৮ সালের কথা। আমি সে বছর রাজশাহী কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়েও পরে ঢাকায় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করি। আসার আগে আমি বৃহত্তর রাজশাহী জেলার ডেপুটি কমিশনার, সবার কাছে ড. জনসন নামে খ্যাত শামসুর রহমান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। আমি তখন কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতির দায়িত্বে ছিলাম। কলেজ গভর্নিং বডির সভাপতির সঙ্গে সেই কারণেই এই বিদায়ী সাক্ষাৎ। ঢাকায় যাচ্ছি এ কথা শুনে খুব খুশি হলেন তিনি। বললেন, ‘শোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন বিশেষ মানুষ আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেই ডানদিকে তাকালেই চোখে পড়বে টিনশেডের বিখ্যাত মধুর ক্যান্টিনের জমজমাট পরিবেশ। এই ক্যান্টিনেই বসেন এর মালিক মধুদা। আর এখানে বসেই মধুদার দৃষ্টি প্রসারিত হয় পুরনো আর্টস বিল্ডিং ছাড়িয়ে কার্জন হল পর্যন্ত সর্বত্র। এখানকার সব কর্মপ্রেরণার কেন্দ্রস্থল এই টিনশেড। এখানে চায়ের টেবিলে বসে সব বিষয়ে টিউটোরিয়াল লেখা হয়। আবার ওই একই টেবিলে বসেই লেখা হয় সব সংগ্রাম আন্দোলনের জন্য বিভিন্ন স্লোগান সংবলিত পোস্টারগুলো।’ বললেন, ‘কয়েক দিন আগে ঢাকায় গিয়েছিলাম। সেখানে একটি কাজ সেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে যাওয়ার পথে মূল গেটটি পার হয়ে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি মধুদা একটি সাইকেলে চড়ে আমার রিকশার পেছনে পেছনে আসছে। আমি রিকশাচালককে জোরে চালানোর তাগিদ দিয়ে ভাবতে লাগলাম মধুদার পাওনা টাকাগুলোর কথা। একটু পরেই রিকশার গতিকে হার মানিয়ে মধুদা আমাকে ধরে ফেলল। আমি তাড়াতাড়ি রিকশা থেকে নেমে হাতজোড় করে বললাম, ‘মধুদা আমি অতি শিগগির তোমার টাকাটা দিয়ে দিব।’ মধুদা অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জনসন দা, এটা কী কইলেন? আমি ট্যাকার লাইগা আইছি? আপনার লগে কতদিন দেখা হয় নাই কন তো?’ বুঝলাম মধুদা টাকার জন্য আমার পিছু নেয়নি। তাই রিকশা ছেড়ে তার ক্যান্টিনে গেলাম। সেই পুরনো টেবিল। তার একদিকে আমি, অন্যদিকে মধুদা। চা-নাশতা খেতে খেতে অনেক গল্প। শেষে বাইরে এসে মধুদা একটি রিকশা ধরিয়ে দিয়ে প্রণাম করল।’

ডিসির বাসভবন থেকে বেরিয়ে রাজশাহী শহরের পাশ ঘেঁষে বয়ে যাওয়া পদ্মা নদীর ধার দিয়ে আনমনে চলতে চলতে মনে পড়ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়কার একজন অসাধারণ কৃতী ছাত্রের স্মৃতিচারণের কথাগুলো। পথে পড়ল ব্রিটিশ ভারতের প্রেসিডেন্সি কলেজ, রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষের ঐতিহ্যবাহী বাসভবনটি। তখন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী একজন শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাবিদ প্রফেসর শামসুল হক। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতেই উপস্থিত হলাম ইতিহাস বিভাগের তরুণ শিক্ষক হাবিবুর রহমান শেলীর বাড়িতে। তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের অনেক ঘটনার সংঘটক। ইতিহাসে অনার্স এবং এমএ দুটোতেই প্রথম বিভাগে প্রথম হয়েও বিশ্ববিদ্যালয় অথবা কলেজে কোনো অধ্যাপনার কাজ পাননি। কারণ তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্রসংসদের ভিপি ছিলেন। ছাত্ররাজনীতিতে জড়িত ছিলেন এবং বাহান্নর ভাষা আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে অনেক আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এর প্রতিবাদে তিনি এসএম হলের বাইরে একটি পানের দোকান দিয়েছিলেন। পাকিস্তান সরকার অবশেষে তাকে সরকারি কলেজে নিয়োগ দিতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং ১৯৯৬-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হয়েছিলেন।

আমি ঢাকায় যাচ্ছি শুনেই খুব খুশি হলেন তিনি। বললেন, ‘এশিয়ার বৃহত্তম ছাত্রাবাস, মুসলিম স্থাপত্যের উৎকৃষ্ট নিদর্শন, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ বাহাদুরের অপরূপ সৃষ্টি এই হলে ঢুকতেই তোমার চোখে পড়বে রৌদ্রোজ্জ্বল সৌন্দর্যমণ্ডিত গম্বুজগুলো। প্রবেশ পথের দুই পাশে বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে আছে টেনিস মাঠগুলো। বিশালাকার এই স্থাপত্যটির নির্মাণের ধরন অনেকটা দিল্লির রেডফোর্টের অভ্যন্তরে দেওয়ানি আম এবং লাহোরের শালামার গার্ডেনের অনুরূপ। পূর্ণিমার চাঁদ এই অপূর্ব সৃষ্টির মহিমা পরিপূর্ণরূপে বিকশিত করে তোলে।

১৯৫৫ সালে তিনি এই হল ছাত্র ইউনিয়নের ভিপি ছিলেন। তার কথাগুলো ছিল আবেগজড়িত। একটু পরেই বিষয়ান্তর ঘটল। বললেন, “এসএম হলে একজন মজার মানুষকে দেখতে পাবে- ‘নাজু’। নাজু এই ছাত্রাবাসের প্রাণ। হলের গেটে ঢুকতেই দেখা পাবে তার। দীর্ঘদেহী পাঠান মুলুকের একজন মানুষ। পরনে উর্দি, মাথায় পাগড়ি। এই নাজুর চোখ এড়িয়ে কাকপক্ষীও এই হলে ঢুকতে পারবে না। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার নাজুকে আদেশ দিল, ‘নাজুক্ষু দরওয়াজা খোলো’। নাজু জবাব দিল, ‘হুকুম নেহি হ্যায়’। ব্রিগেডিয়ার বলল, ‘হাম তুমকো হুকুম দেতা হ্যায়,’ ‘তুম কোন হো হুকুম দেনেকা,’ নাজু বলল, ‘মেরা প্রোভোস্ট কা হুকুম চাহিয়ে’। তখন প্রভোস্ট ছিলেন ড. এমও গনি। ব্রিগেডিয়ার তার কাছ থেকে হলে ঢোকার অনুমতি পাননি।

ওখান থেকে গেলাম প্রফেসর একরামুল হকের বাসায়। ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে ছাত্ররাজনীতিতে জড়িত প্রফেসর হক সে সময় ডাকসুর ভিপি ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. নুরুল মোমেন মাঝে মাঝে বলতেন, ‘একরাম কোনো দিন দেশের প্রধানমন্ত্রী হলে, আমি খুশি হব।’ প্রেসিডেন্ট জিয়ার সময় তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। অল্প সময়ে তার কাছেও এই ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাঙ্গনের অনেক কল্পকাহিনী শুনলাম।

সর্বশেষে গেলাম রাজশাহী কলেজ হোস্টেল সুপার এবং ইতিহাস বিভাগের অধ্যক্ষ প্রফেসর মীর জাহানের বাসভবনে। আমার শিক্ষাজীবনে তিনিই আমার আদর্শ শিক্ষক। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় লেটার মার্ক পেয়েছিলাম বলে তিনি আমাকে ইতিহাসে অনার্স নিতে বলেছিলেন। বলেছিলেন, অন্যথায় আমি অনার্স কোর্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রান্সফার করে দিব।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যক্ষ প্রফেসর হালিমের তিনি প্রিয় ছাত্র। আমার জন্য আগে থেকেই  শিক্ষকের জন্য একটি চিঠি তার সুন্দর  হাতের লেখায় আমার জন্য লিখে রেখেছিলেন। ঢাকাইয়া ভাষায় বললেন, ‘ভালো কইরা লেখাপড়া করবা।’ আমি চিঠিটি নিয়ে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে উঠতেই দেখলাম তার চোখ দুটি অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছে। আমিও অশ্রু সংবরণ করতে পারলাম না। আমার প্রিয় শিক্ষক ধীরে ধীরে ঘরের ভিতরে চলে গেলেন, আমি চোখ মুছতে মুছতে অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়ালাম। ঢাকায় এসে প্রথমেই এসএম হলের বাইরের গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই দেখলাম পাগড়ি পরিহিত নাজুর পাশে বিলেতি কায়দায় স্যুট পরিহিত একজন ছোটখাটো ছিপছিপে মানুষ। বুঝলাম তিনিই বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারনিউমেরারি প্রফেসর আবু হেনা। এই হলের তিনি প্রভোস্ট। একটু পরেই একটি গাড়ি এসে থামল। গাড়ি থেকে নামল পাঠান মুলুকের কয়েকজন উর্দি আর পাগড়ি পরিহিত মেহমান। নেমেই তারা সরাসরি নাজুর কাছে চলে গেল এবং সালাম বিনিময় করে নাজুকে একে একে জড়িয়ে ধরল। তাদের ধারণা ছিল, নাজুই হলের প্রভোস্ট। নাজু বিব্রতবোধ করল। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে নাজু প্রফেসর আবু হেনার দিকে ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নতশিরে বললেন, ‘হামারা প্রভোস্ট সাহেবকে মিলিয়ে।’ ইংরেজি সাহিত্যের প্রফেসর, এক সময়কার জাঁদরেল প্রিন্সিপাল, আবু হেনা বিলেতি কায়দায় ‘হ্যান্ডশেক’ করে বললেন, ‘প্লিজ কাম ইন।’

সেদিনই তার অফিসে দেখা করলাম। আমার দিকে একটি বক্র দৃষ্টি দিয়ে বললেন, ‘তোমার নাম মোহাম্মদ আবু হেনা?’ আমি বললাম, ‘জি-হা’।’ তিনি ইংরেজিতেই বললেন, ‘কিন্তু দুই সিংহ একই গুহায় কি করে বাস করবে?’ আমি দেরি না করেই বলে ফেললাম, ‘সে ক্ষেত্রে নতুনেরই জয় হবে।’ ভর্তি হয়ে প্রফেসর হালিমের সঙ্গে দেখা করে প্রফেসর মীর জাহানের চিঠি দিলাম। তিনি মনোযোগ দিয়ে চিঠিটি পড়লেন। তারপর বললেন, ‘ঠিক সে পড়ালেখা কর’। পরে তার প্রিয় পিয়ন ‘দিজু’র দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ইসকো খেয়াল রাখ না’। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমাদের কাছেও এদের স্মৃতি চির অম্লান। একদিন রাত ১২টায় আমরা কয়েকজন ছাত্র পলাশী ব্যারাকে চা খেতে গেলাম। দেখলাম সব দোকান বন্ধ, শুধু একটি বন্ধ ঘরে আলো জ্বলছে।

এখানে চা পেতে পারি, এই আশা নিয়ে দরজায় ধাক্কা দিতেই ভিতর থেকে বেশ কয়েকজন লাঠিসোঁটা নিয়ে আমাদের তাড়া করল। আমরা প্রাণভয়ে দৌড় দিয়ে কিছুদূর আসতেই দেখলাম হামলাকারীরাই পিছুটান দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে। পেছন ফিরে দেখলাম বিরাট এক লোহার রড নিয়ে নাজু ছুটে চলেছে ওদের পেছনে। একটু পরে ফিরে এসে রাগে গরগর করতে করতে নাজু বলল, ‘এত বড় সাহস।’ আর একদিনের কথা। নাজু একটি কাগজ হাতে নিয়ে খুব চিন্তিত। বললাম, ‘নাজু, কিয়া হুয়া?’ নাজু গম্ভীরভাবে বলল’, দেখিয়ে না সাব, হাম মুহিত সাহেব সে এক প্লট মাঙ্গাথা। উনি আমাকে গভর্নর আজম খান সাহেবের কাছে নিলেন। আজম সাহেব হামার মুলুকের লোক। আমাকে বুকে জড়িয়ে বললেন, ‘নাজু, তোমাকে তিন প্লট দিলাম। এখন আমি তিন প্লট দিয়ে কি করি?’ একসময়কার এসএম হলের ভিপি এএমএ মুহিত (বর্তমান অর্থমন্ত্রী) তখন গভর্নরের সচিব ছিলেন। আমি বললাম, নাজু দুটা প্লট বেচে দাও। নাজু স্বস্তি পেল।

মধুদা ছিল আমাদের পরিবারপ্রধান। কখন কী খেয়েছি। কখন না খেয়ে আছি, এগুলো মধুদা আমাদের মুখ দেখলেই বুঝে ফেলত। তারপরই জোবেদ আলীর প্রতি আদেশ হতো। প্রায় ক্ষেত্রেই খাতায় নামের নিচে যোগ হতো প্রতিদিনের হিসাব। কে কত মধুদার দেনা শোধ করেছে, কেউ বলতে পারবে না। আর দিজুদা সেও এক মজার মানুষ। একদিন দিজুদা এসে বলল, ‘হালিম স্যার বলে আবু হেনা শুধু রাজনীতি করে, পড়ালেখা করে না।’ আমি দিজুদাকে ভালো করে খাইয়ে দিয়ে বললাম, ‘দিজুদা কিছু কর।’ পরে ধীরে ধীরে দিজুদাকে অনুসরণ করলাম। দেখলাম দিজুদা একটি কাপড় দিয়ে টেবিল মুছতে মুছতে বলছে, ‘স্যার, আবু হেনা আজকাল বহুত লেখাপড়া করে। এখন লাইব্রেরিতে আছে।’ স্যার মুখ তুলে বললেন, ‘আচ্ছা, এত বহুত খুশিকা বাত হ্যায়।’

দিজুদার এত প্রচেষ্টা কাজে লাগেনি। বাষট্টির হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট প্রকাশিত হলো। এ রিপোর্ট বাস্তবায়িত হলে একমাত্র বিত্তশালী ছাড়া অন্যদের জন্য উচ্চশিক্ষার কোনো সুযোগ থাকত না। একই সময়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শীর্ষ নেতা পাকিস্তান এবং অবিভক্ত বাংলার সাবেক প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গ্রেফতার হলেন। দেশের ছাত্র আন্দোলনের পাদপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক আমতলা থেকে মিছিল নিয়ে সারা ঢাকার রাজপথ প্রদক্ষিণ করে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কাছে আসতেই পাকিস্তান আর্মি গোলাগুলি শুরু করল। মিছিল ছত্রভঙ্গ হলো। আমরা অনেকে পার্শ্ববর্তী ছাত্রাবাসে আশ্রয় নিলাম। ওরা শত শত ছাত্রকে ট্রাকে তুলে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গেল। রাতে আমাকে সেগুনবাগিচার একটি বাড়ি থেকে গ্রেফতার করল। তারপর তেজগাঁও থানায় রাত কাটিয়ে সকালে কোর্টে এবং তারপর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। সেখানে একটি কক্ষে আমরা ১৮ জন ছিলাম। রাতে মেঝেতে শুয়ে ছিলাম আমরা। হঠাৎ সেখানে উপস্থিত হলেন তখনকার গভর্নর জেনারেল আজম খান। আজম খান পশ্চিমা হলেও এ দেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তিনি আমাদের মেঝেতে শুয়ে থাকতে দেখে ভীষণ অখুশি হলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার আদেশে আমাদের প্রথম শ্রেণির সব সুবিধা দেওয়া হলো। বেশ কয়েকজন পুরনো বন্দী আমাদের পরিচর্যা করার জন্য নিয়োজিত হলো। তারা সবাই আমাদের খুব আদর-যত্ন করতেন। বিকালে আমরা ভলিবল খেলতাম। তখন কারাগারের সবাই হাততালি দিয়ে আমাদের অনুপ্রেরণা জোগাত। আদালতে আমাদের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থান করতেন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান খান এবং সাবেক মন্ত্রী ও বিশিষ্ট আইনজীবী এম জহিরুদ্দিন। রাজবন্দী হিসেবে আমাদের সঙ্গে ছিলেন কাজী জাফর, আনোয়ার জাহিদ, শাহ্ মোয়াজ্জেম, কামরুন্নাহার লাইলী, জিয়াউদ্দিন মাহমুদ, বন্ধু মোস্তফা এবং আনোয়ার আনসারী খান, আমাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়েছিল। বলা হয়েছিল ফাঁসি দেওয়া হবে। পরবর্তীতে আন্দোলন তীব্রতর হলো, আমরা মুক্তি পেলাম। এম এ পরীক্ষা দিতে পারলাম না। এক বছর পর এম এ এবং সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষা দিলাম। কিছুদিন খুলনা বিএল কলেজে অধ্যাপনা করে সিএসএস মৌখিক পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেখলাম জীবনের পথ আরও কণ্টকাকীর্ণ হয়েছে। পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান আমাকে বললেন, যেহেতু রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ নিয়ে তুমি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে বিচারাধীন ছিলে, সেই কারণে রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো সার্ভিস তোমাকে দেওয়া যাবে না।’ আমি ফাইন্যান্স সার্ভিস বেছে নিয়েছিলাম। পরে পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময় এসপি আওয়াল সাহেব আমাকে পুলিশের ছাড়পত্র দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। সে সময় আমার সাহায্যে এগিয়ে আসেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক তদানীন্তন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যক্ষ এবং পরবর্তীকালে দেশের অর্থমন্ত্রী ড. এ. আর মল্লিক। তার অনুরোধেই আমি ছাড়পত্র পাই এবং সেই কারণেই আমি ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান ফাইন্যান্স সার্ভিসে যোগদান করি। ইতিহাসের ছাত্রকে লাহোর ফাইন্যান্স একাডেমিতে পড়তে হলো বুক কিপিং অ্যান্ড অ্যাকাউন্টেন্সি, ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্স, পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, ফাইন্যান্সিয়াল রুলস। কাস্টমস, একসাইজ এবং কর প্রশাসন আইনসমূহ। লন্ডন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সির কঠিন কঠিন প্রবলেম সমাধান করতে হয়েছে আমাদের।

এই বিদ্যা সম্বল করেই ১৯৮৪ সালে ব্রাসেলের বিশ্ব কাস্টমস সংস্থার বাংলাদেশের প্রথম স্থায়ী প্রতিনিধি এবং বাংলাদেশ মিশনে মিনিস্টার হিসেবে যোগদান করি। এই দায়িত্বে কর্মরত অবস্থায় ভিয়েনায় মাদকাসক্তি ও পাচারবিরোধী আইন প্রণয়নের জন্য জাতিসংঘ আহূত মাসব্যাপী প্লেনিপোটেনসিয়ারি কনফারেন্সে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হই। এই আইনের অপরাধ ও শাস্তি-সংক্রান্ত বিধানগুলো আমারই সভাপতিত্বে প্রণীত হয়। এ ছাড়া ইসতাম্বুল কনভেনশন এবং কাস্টমসবিষয়ক ইনটেলেকচুয়াল প্রোপার্টি আইনও আমার সভাপতিত্বে প্রণীত হয়। আজ যে কাস্টমস এইচ এস কোড বিশ্ববাণিজ্যে যুগান্তকারী বিবর্তন এনেছে এর প্রণয়নেও আমি অংশ নিয়েছি। আমাদের এই সাফল্যের কারণ একটিই। আমরা ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছি। আমি নওগাঁ কেডি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় স্কলারশিপ নিয়ে উত্তীর্ণ হই। এই স্কুল থেকেই একসময় প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, রাজনীতিক হুমায়ূন কবীর অবিভক্ত বাংলায় কলকাতা বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ভারতের শিক্ষামন্ত্রী হন। তার সময়কার শিক্ষক বাবু কুমুদ রঞ্জন আমাদের ইংরেজি পড়াতেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে টেস্ট পরীক্ষায় আমি ইংরেজিতে শতকরা ৮৫ নম্বর পেয়েছিলাম। এতে আমি বেশ উল্লসিত বোধ করি। কুমুদ বাবু এটা লক্ষ্য করে আমাকে হাত ধরে প্রধান শিক্ষকের ঘরে গিয়ে হুমায়ূন কবীরের রেকর্ড দেখালেন। কোনো বিষয়েই তার ৯৮-এর নিচে নম্বর ছিল না। আমার উল্লাসের এখানেই সমাপ্তি হয়েছিল, কারণ আমাদের সময় ইংরেজিতে কেউ ম্যাট্রিক পরীক্ষায় লেটার মার্ক পায়নি। তা সত্ত্বেও বিশ্ব সংস্থায় আমরা ইংরেজি মাতৃ ভাষাভাষীদের তুলনায় পিছিয়ে ছিলাম না। বলা বাহুল্য, পঞ্চাশের দশকে বেসরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক এমরান আলী ভাষাতত্ত্বে¡ পিএইচডি ছিলেন।

আজ শিক্ষাঙ্গনে শুধুই হতাশা-ব্যর্থতা আর বিশাল অনিশ্চয়তা। শিক্ষক-শিক্ষিকা ছাত্রদের হাতে প্রহৃত হচ্ছেন। শিক্ষক বড় না আমরা বড় এ নিয়ে চলছে অবিরাম সংগ্রাম, আন্দোলন, সংঘাত। ১৯৪৯ সালে সারা পাকিস্তানের সর্বোচ্চ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন শফিউল আজম। ১৯৭১ সালেও তিনি যুগ্ম সচিব পদমর্যাদায় পূর্ব পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারি ছিলেন। কারণ সারা পাকিস্তানে তখন মাত্র ২০ জন সচিব, ৫৯ যুগ্মসচিব এবং ২০৩ জন উপসচিবের পদ ছিল। আজ বাংলাদেশে হাজার হাজার সিনিয়র সচিব, সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব আর উপসচিব। তাতেও কুলাচ্ছে না। প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা না দিলে মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট জালকারী সিনিয়র সচিবদের পূর্ণ মর্যাদা দেওয়া যাচ্ছে না। আজ বাজেটের সিংহভাগ এই শ্বেতহস্তীর ভরণপোষণে ব্যয় হচ্ছে। আর এই অর্থ জোগান দিচ্ছে পরোক্ষ করের মাধ্যমে সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর আর রাস্তার ভিখারি। এ দেশে এখন সবই প্রহসন। যারা কর প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা তারা প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষ করের পার্থক্য বোঝেন না। বোঝেন না কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভ্যাটের মতো পরোক্ষ কর দেয় না। এরা ভোক্তাদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করে নিজেদের নামে চালিয়ে দেয়। সরকার এদের ভ্যাট প্রদানকারী হিসেবে ট্রফি প্রদান করে। এরা আমদানি করার সময় অ্যাডভান্স আয়কর দেয়। তারপর এই আয়করের একটি সূ² কারচুপির মাধ্যমে পণ্যের বিক্রয় মূল্যের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়ে তাদের ওপরে নির্ধারিত আয়কর আবার গরিব ভোক্তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। অশিক্ষা আর কুশিক্ষা আজ সর্বত্র, সর্বগ্রাসী। আর এর জন্য খেসারত দিচ্ছে গরিব, নিঃস্ব মেহনতি মানুষকে।

আজ শিক্ষাঙ্গনে সেই পবিত্রতা নেই। আজ বিচারপতি হামুদুর রহমান, মাহমুদ হোসেন, মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী, মোজাফফর আহমদ, ওসমান গনির মতো উপাচার্য নেই। ড. এম এন হুদা, ড. হালিম, ড. টারনার, ড. দানী, ড. সাজ্জাদ হোসেনের মতো শিক্ষক নেই। শিক্ষক, ছাত্র-কর্মচারীরা মাসের পর মাস কর্মবিরতি করে এদের অবরুদ্ধ করে রাখলেও এরা পদত্যাগ করেন না। অস্ত্র হাতে প্রকাশ্যে গোলাগুলি করে দিনদুপুরে হল দখল এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এইচএসসি পরীক্ষায় ৭৫ হাজার পরীক্ষার্থী জিপিএ ৫ পাওয়ার পর মাত্র দুজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি অনার্স ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেছে। শতকরা ৯৮ থেকে ১০০ নম্বর পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা হাজার হাজার। এর কারণ এরা হুমায়ূন কবীরের মতো মেধাসম্পন্ন নয়। এর কারণ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। যারা লেখাপড়া করে পরিশ্রম করে পরীক্ষা দিয়েছে তারা মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী দুর্বৃত্তদের পেশিশক্তির সামনে অসহায়। এরা আজ শিক্ষাঙ্গনকে কলুষিতই করছে না, পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেশের সরকারি-বেসরকারি সব সেক্টরকেই মেধাশূন্য করছে। আজ কোথাও মেধার প্রতিযোগিতা নেই- আছে খেলাপি ঋণ, ব্যাংক ডাকাতি আর জালিয়াতির দাপট, পেশিশক্তির মহাযজ্ঞ। কবে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। আজও বংশানুক্রমে তাদের নাতি-পুতিরা শতকরা ৩০ ভাগ পদ দখল করে চলেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এর কোনো নজির নেই। ১৯৯১-৯২ সালে আমি যখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (প্রশাসন) ছিলাম তখনো চাকরি দেওয়ার জন্য সঠিক মেধাসম্পন্ন মুক্তিযোদ্ধার অভাব ছিল।

আজ আর আশা নেই, ভরসা নেই। আমরা সমুদ্রের অতলে গভীর হতাশায় নিমজ্জিত। এই মুহূর্তে কে দেবে আমাদের আশা, ভরসা, কে দেখাবে টানেলের শেষপ্রান্তে আলোক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সূর্যরশ্মিটি? কে বাঁচাবে মুমূর্ষু জাতিকে?

                হলেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর