শনিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ধর্মান্তরকরণ ও গো-মাংস নিয়ে রাজনীতি

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

ধর্মান্তরকরণ ও গো-মাংস নিয়ে রাজনীতি

১৭ মাসের এনডিএ শাসনে ভারতে চারদিকে অবক্ষয় শুরু হয়েছে। অবক্ষয়ের কারণ কী? কারণ হলো- হিন্দি বলয়ে ব্যাপকহারে জাতপাতের রাজনীতি। এই রাজনীতি শুরু করেছে বিজেপির পরামর্শদাতা আরএসএস। আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত সরকারি টিভি চ্যানেলে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন। কোনো বেসরকারি ব্যক্তি সরকারি চ্যানেলে বক্তৃতা দিতে পারেন না। যেহেতু তিনি মোদি সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, তাই তার সাতখুন মাপ। এই ১৭ মাসে শুধু দ্রব্যমূল্য বেড়েছে, মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ভারতবর্ষের এখন সাধারণ ও গরিব মানুষের কাছে দ্রব্যমূল্য, বিশেষ করে ডাল-পিয়াজসহ আবশ্যক জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণ করার কোনো ব্যাপার নেই।

পাঁচ দিন উৎসব উপলক্ষে সংবাদ মাধ্যম ছুটি থাকলেও টিভি খুললেই দেখা গেছে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি রোজই ডাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলছেন। তার কথাই সার। কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না।

প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বাড়ছে। বিজেপি জোটের অংশীদার মহারাষ্ট্রের শিবসেনা বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেছে, আগে দ্রব্যমূল্য কমান, তারপর শরিকদের পরামর্শ দেবেন। বিরোধী কংগ্রেস এবং অন্য দলগুলো অভিযোগ করেছে, উত্তর ভারতের রাজস্থান, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব, হিমাচল প্রদেশ যেখানে যেখানে ডাল এবং পিয়াজ উৎপাদন বেশি তা নিয়ন্ত্রণ করেন বিজেপির ব্যবসায়ীরা। মাণ্ডির পর মাণ্ডি তারা প্রতিদিন ঠিক করে দেন কত দামে বিক্রি হবে। সেই টাকার একটা অংশ যায় অমিত শাহের দলের তহবিলে। পশ্চিমবঙ্গের গোটা ব্যবসাই নিয়ন্ত্রণ করছেন কালীঘাটের মমতা দেবী। এর মধ্যে হরিয়ানায় দলিত পরিবারের দুটি শিশুকে পুড়িয়ে মেরেছে আরএসএস ঘনিষ্ঠ সমাজবিরোধীরা। এ ঘটনায় উত্তর ভারতসহ গোটা দেশে দারুণ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিজেপির নীতি অনুযায়ী তপশীলি জাতি ও উপজাতির লোকদের ভয় দেখিয়ে প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে একটার পর একটা ঘটনা ঘটানো। এতে বিজেপির জনপ্রিয়তা গোটা দেশেই দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।

অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গে চলছে জোর যার মুল্লুক তার। এখানে শুধু সাধারণ মানুষের ওপর সীমাহীন অত্যাচারই চলছে না, মমতার রাজত্বে এমন কোনো জেলা নেই যেখানে তৃণমূলী সন্ত্রাসবাদীদের হাতে পুলিশ মার খাচ্ছে না। অতি সম্প্রতি দার্জিলিংয়ের মিরিকে একজন পুলিশকর্মীকে পিটিয়ে মারা হয়েছে। এর আগে ১৭ মাসে কম করে হলেও সাধারণ নিরীহ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনীতিকরা তৃণমূলী সন্ত্রাসের বলি হয়েছেন। উৎসবের মৌসুমে একদিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, খুন-জখম আর অন্যদিকে জাতপাতের রাজনীতি। এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে নৈমিত্তিক ঘটনা।

জাতপাতের ইস্যুতে মুখ খুলেছেন স্বয়ং রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। তিনি পুজোর সময় নিজের বাড়ি বীরভূমে এসে বলেছেন, সহিষ্ণুতাই ভারতের ঐক্যের মূলমন্ত্র। সাধারণত ভারতের রাষ্ট্রপতি এ ধরনের কোনো বিবৃতি দেন না। বিজেপি এখনো কোনো মন্তব্য না করলেও, বিরোধী দলগুলো রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করে বলেছে, মোদি সরকারের কাজকর্ম রীতিমতো উদ্বেগজনক।

মোদির অগ্নিপরীক্ষার ফল জানা যাবে আগামী ৯ নভেম্বর। সেদিনই বিহারের নির্বাচনের ফল প্রকাশ হবে। লড়াই হচ্ছে একদিকে বিহারের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদব এবং কংগ্রেস। আর অন্যদিকে বিজেপি, লোকজনশক্তি পার্টি এবং কয়েকটি আঞ্চলিক দল। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মোদি তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বাজি রেখেছেন। ভারতের এই অঙ্গরাজ্যে নীতিশের আমলে সাধারণ মানুষের জন্য উন্নয়নমূলক অনেক কাজ হয়েছে বলে বিহারের যুবসমাজও খুশি। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজের বক্তব্য- আমরা জাতপাত চাই না। আমরা চাই শিক্ষা আর চাকরি।

নেহেরু থেকে জয়প্রকাশ নারায়ণ, যারা স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তারা সবাই জাতপাতবিরোধী ছিলেন। ভারতের সংবিধান প্রণেতা ড. বি আর আম্বেদকর নিজেও একজন দলিত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। আরেকটি বড় সমস্যা এই মুহূর্তে মাথা তুলছে, তা হলো গো-মাংস ভক্ষণ। দেশের কয়েকটি রাজ্য গো-হত্যা এবং গো-মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করেছে।

এতেই প্রমাণিত হচ্ছে অবক্ষয়ের মূল কারণ সরকারি নীতি। কে কী খাবে সেটাও সরকার ঠিক করে দিতে চাইছে। গো-মাংস দিয়ে জাতপাত ঠিক করা হবে। স্বাধীনতার পর থেকে কোনো সরকারই এ পথে চলেনি। কোটি লোকের দেশ তার নাগরিকের স্বাচ্ছন্দ্য দেখবে, নাকি মোদি আর তার আরএসএস কোম্পানির কথায় চলবে? মানুষ এবার প্রতিবাদ করতে শুরু করেছে। অন্তত ৪০ জন বুদ্ধিজীবী তাদের একাডেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছেন। মনে হচ্ছে, আরও অনেকে দেবেন। এই পরিস্থিতিতে ভারতের যে অবক্ষয় শুরু হয়েছে তা থেকে ভারতবাসী কী করে মুক্তি পাবে?

রাজ্যের বিশিষ্টজনরা এ নিয়ে পর্যালোচনা শুরু করে দিয়েছেন। ধর্মান্তরকরণ, গো-মাংস নিয়ে রাজনীতি ভারতে আগে কখনো দেখা যায়নি। ভারতে এখন বিজেপি-আরএসএসের দ্বৈত প্রশাসন চলছে। বিজেপি মুখে যা বলে তা বাস্তবে করে না। বাস্তবে তারা আরএসএসের নীতিই অনুসরণ করে চলে।

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর