মঙ্গলবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষতা হারিয়েছে

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষতা হারিয়েছে

ব্লগারদের একের পর এক হত্যা, শিশু হত্যা, নারী হত্যা- হত্যার যেন শেষ নেই। সেদিন রাজধানীতে প্রকাশককে হত্যা জাতিকে স্তম্ভিত করেছে। এ যেন মৃত্যুর মিছিল। তার পরও সরকার বলবে সবকিছু ঠিকঠাক। এরা কী করে বুঝবে, কোনো কিছুই ঠিকঠাক নেই। এক অসম্ভব যন্ত্রণায় দেশ চলছে। এই ক্রান্তিকাল অতিক্রম করা কারও একার পক্ষে সম্ভব নয়। সবাইকে আস্থায় নিয়ে মিলেমিশে এই জাতীয় সংকট অতিক্রম সরকারকেই করতে হবে। সময় যে খুব বেশি আছে তেমন নয়। হারিয়ে গেলে পাওয়া আর মরে গেলে জীবিত হওয়া এ এক দিবাস্বপ্ন, অলৌকিক কল্পনা।

জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কোথা কে কবে? জন্মের পর মৃত্যু অবধারিত সত্য। সেই সত্যের মুখোমুখি হতে অর্জুনার কুঠিবয়ড়ার মাকসুদা ফুপুর জানাজায় গিয়েছিলাম। বাবার একমাত্র মামা মতিয়ার রহমানের বড় মেয়ে মাকসুদা খাতুন ৮৭ বছর বয়সে গত ২৬ অক্টোবর সোমবার পরপারে গেলেন। তার স্বামী হামিদুর রহমান খান আগেই গিয়েছেন। শওকত হামিদ খান, ফিরোজা রহমান, আফরোজা খান, মনিজা মিঞা, আক্তার হামিদ খান নামে পাঁচ ছেলেমেয়ে রেখে গেছেন। আমার দাদি ছিলেন তার একমাত্র বোন। বাবাকে কয়েক মাসের রেখে তিনি মারা যান। বাবা মামার বাড়ি খুব একটা যেতেন না। কিন্তু আমি যেতাম। ছাতিহাটি থেকে দিগলকান্দি ৮-১০ মাইলের পথ। ছোট্ট বয়সে হাঁটতে হাঁটতে একেবারে পেরেশান হয়ে যেতাম। মাকসুদা ফুপু আমার থেকে ১৭-১৮ বছরের বড়। গেলেই খেজুরের গুড় দিয়ে মুড়ি দিতেন। জীবনের উথাল-পাথালে কত কিছু ভুলে গেছি। কিন্তু তার মুড়ি দেওয়া ভুলিনি। কুঠিবয়ড়ায় পারিবারিক গোরস্থানে তাকে কবরে রেখে আসার পথেও বার বার সেই গুড়-মুড়ির কথা মনে হয়েছে। যমুনার পাড়ের গোপালপুর, ভূঞাপুর, কালিহাতী আমার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত। কুঠিবয়ড়া খান বাড়ির গা ঘেঁষে যমুনা এসে গেছে। আর কদিন বাড়িঘর, পারিবারিক কবরের অস্তিত্ব থাকবে বলা যায় না। আমি গিয়েছি শুনে অনেক মুক্তিযোদ্ধা এসেছিল। কালিহাতীর উপনির্বাচন নিয়ে ছোটাছুটি করছি বলে সময় দিতে পারিনি। তাড়াতাড়ি চলে এসেছিলাম। জোগারচর গোহালিয়া বাড়ির সামাদ আসতে চেয়েছিল। তাকে সময় দিয়েছিলাম। কাউকে সময় দিয়ে রক্ষা না করা আমার ধাতে সয় না। ফিরতে ফিরতে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম, আল্লাহ যেন তাকে বেহেশতবাসী করেন।

ভূঞাপুর-তারাকান্দি রাস্তা একেবারে জঘন্য, চলার অযোগ্য। তার মধ্যেও মানুষ কষ্ট করে কীভাবে যে চলে। আমার তো অর্জুনা পর্যন্ত যেতে আসতে জীবন বেরিয়ে যাওয়ার অবস্থা। মানুষের বয়স হলে শান্তিতে থাকতে চায়। আমার কপাল হয়েছে উল্টো। ছেলেবেলা যেমন অযত্ন-অবহেলা আর মারধরের মধ্যে কেটেছে, শেষ বয়সে পড়েছি প্রায় তেমনি অবস্থায়। গাড়ি-ঘোড়া, রাস্তাঘাট খারাপ, চারদিকে সামাজিক অস্থিরতা, অশান্তি, কারও প্রতি কারও সম্মান নেই, অতীতের ত্যাগ-তিতিক্ষার কোনো মূল্য নেই- এ যেন গায়ের জোরে চলা। এই সময় বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী পদত্যাগ করায় কালিহাতীতে উপনির্বাচন। সেখানে কী যে রংতামাশা। শুধু আমাকে কুপোকাত করতে ন্যায়-অন্যায়ের বাছ-বিচার না করে একটি সরকার কীভাবে নীতিহীন হয়ে পড়তে পারে তার একটা জ্বলন্ত প্রমাণ কালিহাতীর উপনির্বাচন। যারা একসময় আমার একটু ছোঁয়া পেলে ধন্য হতো অথবা একটা চকলেটের জন্য হাত বাড়িয়ে থাকত তারা এখন নেতা-অভিনেতা। কিসব জঘন্য কথাবার্তা বলে, কল্পনাও করা যায় না। কেমন যেন সবকিছুর মান নেমে গেছে। পাকিস্তানের সময় সরকারি দল মুসলিম লীগকে দেখেছি, তাদের দাপট ছিল। কিন্তু তারাও এমন জঘন্য ছিল না। তৃণমূলের চেয়ে মধ্যস্বত্বভোগীরাই বেশি বিশ্রী। চাটু ছাড়া তাদের আর কিছু করার আছে বলে মনে হয় না। সেদিন বাংলাদেশ প্রতিদিনে সৈয়দ বোরহান কবিরের ‘তৈলাক্ত বাঁশ : ঘটায় সর্বনাশ’ শিরোনামে এক অসম্ভবসুন্দর লেখা পড়লাম। লেখাটা আমায় আনন্দ দিয়েছে। যখন যে দেশে তেলের প্রাধান্য বাড়ে তখন সে দেশে বা সেখানে সর্বনাশ হয়। একজন নেতার যতই সমালোচনা করা হোক তার মধ্যে ভাষার একটা সৌন্দর্য থাকা উচিত। দেশের প্রধানমন্ত্রী, তাকে সম্মান দিয়ে সমালোচনা করা দরকার। রাজনীতিতে ব্যক্তির চেয়ে কর্ম বড়। কর্মের সমালোচনা হবে বলেই ব্যক্তিকে ছোট করা হবে এটা রাজনৈতিক কৃষ্টি না। যদিও বর্তমানে এসবই হয় বেশি। কালিহাতীর উপনির্বাচনের ব্যাপারটাই দেখুন, জানি না কোন দুষ্ট কীট এভাবে রাজনীতিকে কলুষিত করছে। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছে, এসব তঞ্চকতার সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জড়িত। আমি কোনো দিন বিড়ি-সিগারেট খাইনি, অন্যের হোক্কায় তামুক খাব কী করে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সুখে-দুঃখে অনেক সময় কাটিয়েছি। তাই তিনিই এসব করছেন নিজ মুখে না বললে বিশ্বাস করি কী করে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর কন্যা এটাও তো ভুলতে পারি না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী হয়ে কাজ করবেন না বলে যে শপথ নিয়েছেন শুধু আমাকে ঠেকাতে তিনি কেন সে শপথ ভঙ্গ করে আল্লাহর কাছে দায়ী হবেন? শত চেষ্টা করেও এসবের কোনো উত্তর খুঁজে পাই না।

সরকার চালাতে নানা টানাপড়েন থাকে, এ সরকারেও হয়তো আছে। যাদের নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব থাকার কথা তাদের তা নেই। যাদের কিছুই থাকার কথা নয় তারাই সর্বেসর্বা। এসব কারণে অসঙ্গতি থাকবে, এ সরকারেও আছে। তা থাক। তাই বলে এমন জঘন্য অন্যায় হবে ভেবে পাই না।

গিয়েছিলাম হাইকোর্টে। হাইকোর্ট মনোনয়ন বৈধ করে নির্বাচন করার সুযোগ দিয়েছিল। সে হিসেবে ২২ তারিখ রিটার্নিং অফিসার আমাদের দলের নির্বাচনী প্রতীক গামছা বরাদ্দ করেছিলেন। এরপর আর নির্বাচন নিয়ে কিছু হওয়ার কথা নয়। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সুপ্রিমকোর্টে গিয়েছিল। সুপ্রিমকোর্টে যাওয়ার প্রক্রিয়াও ঠিক ছিল না। ২১ তারিখ হাইকোর্টের রায়ের সঙ্গে সঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল খেপে গিয়ে বলেছিলেন, সরকার আপিল করবে। নির্বাচনে সরকার থাকবে নিরপেক্ষ। কী করে তিনি ক্ষুব্ধ হলেন বুঝতে পারিনি। জনাব অ্যাটর্নি জেনারেলের ক্ষুব্ধতা সামলাবে কে? গ্রামীণ ব্যাংক থেকে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূসকে সরাতে দম্ভ করে বলেছিলেন, অধ্যাপক ইউনূস শান্তিতে নোবেল পাবে কেন? শান্তিতে নোবেল পাবেন যৌথভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্তু লারমা এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আমি তখন ভেবেছিলাম, একজন সন্ত্রাসীর সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে বক্তব্য দেওয়ায় হয়তো অ্যাটর্নির চাকরি যাবে। আমি মনে করেছিলাম কোথায় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুর কন্যা, জননেত্রী শেখ হাসিনা আর কোথায় সন্তু লারমা। আমার ধারণা যে ভুল অ্যাটর্নির চাকরি না গিয়ে বরং পোক্ত হওয়াই তার প্রমাণ। মায়ের মতো আমার বোন যদি সন্তু লারমার সঙ্গে নোবেল পাওয়া সম্মানের মনে করেন আমি অপমানবোধ করে কী করব?

 

 

২৭ তারিখ চেম্বার কোর্টে আপিল হয়েছিল। কিন্তু মিডিয়ায় ২৫ তারিখ থেকে ফলাও করে প্রচার করছিল, অ্যাটর্নি জেনারেল আপিল করেছেন। অথচ অ্যাটর্নি জেনারেল আপিল করেননি, করেছে নির্বাচন কমিশন- যা নির্বাচন কমিশনও করতে পারে না। এই যে সর্বোচ্চ আদালত নিয়ে এমন ভিত্তিহীন মিথ্যা প্রচার, এ নিয়ে কি কোনো আইন-আদালত হবে না? হাইকোর্ট তো স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কত আদেশ-নির্দেশ দেন, এ ক্ষেত্রে একজন মুক্তিযোদ্ধার মান বাঁচাতে কি কিছুই করবেন না? নির্বাচন নিয়ে সরকারের ক্ষুব্ধ হওয়ার কী আছে? আমি তো সাদা বুদ্ধিতে বুঝি, সরকারের বরং খুশি হওয়ার কথা। ৪০টি নিবন্ধিত দলের মাত্র ৪-৫টি এখন সংসদে। নির্বাচনে আমরা জয়ী হলে আরও ১টি দল সংসদে পেতে পারে। আর সংসদে ৩৫০ জনের মধ্যে ৩৪৯ জনই তারা, আমি একা গিয়ে তেমন কী করব? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমায় ভালো করেই জানেন, ভালোকে ভালো, খারাপকে খারাপ বলাই আমার স্বভাব। তাতে তারই সুবিধা। বেশ কিছু দিন খুব তৎপর থেকেও শেষ পর্যন্ত অ্যাটর্নি আপিল করেননি। তার আপিল করার কোনো পথ বা সুযোগ ছিল না, যারা করেছেন তাদেরও আপিল করার সুযোগ নেই। তারা কোনোমতেই প্রতিপক্ষ হতে পারেন না। নির্বাচন কমিশন আমার প্রার্থিতা নিয়ে প্রতিপক্ষ হয়ে নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। স্বাধীন-সার্বভৌম নিরপেক্ষ সংস্থার দ্বারা নির্বাচনের যে মূলমন্ত্র এখানে তা বিঘ্নিত হচ্ছে। একে তো সরকারি আইন কর্মকর্তার অতিরিক্ত তৎপরতা, অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্ব কালিহাতীর উপনির্বাচনকে এক বিরাট প্রশ্নের সামনে ফেলে দিয়েছে। অথচ এ নির্বাচনে সরকার এবং নির্বাচন কমিশন উভয়ের মর্যাদা উদ্ধারের মস্ত একটি সুযোগ ছিল। কেউ যদি হেলায় ফেলায় নিজের এবং সংস্থার মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে সেখানে আমার কী করার আছে? অন্যদিকে কালিহাতীতে ভোট নিয়ে যে রংতামাশা হচ্ছে তা বলার মতো নয়। যেখানেই যাবেন সেখানেই শুনবেন, ‘আমরা ভোট দেব, কিন্তু সে ভোট রক্ষা হবে তো?’ আর সরকারি দলের প্রার্থী প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা নিয়ে অনবরত প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। আসলে একটা নির্বাচনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কোনো পক্ষ হতে পারেন? তার নামে দিবারাত্রী প্রচার হচ্ছে। বলা হচ্ছে, পাঁচ ভোট পেলেও তারাই জিতবে। এটা একটা কথা হলো? কয়েক লাখ ভোটারের একটা নির্বাচনী এলাকায় পাঁচ ভোট পেলে কেউ জিততে পারে? এটা বিশ্বাসযোগ্য? এতে সরকারের সম্মান বাড়ে, না কমে যারা প্রচার করছে তা তারা ভেবেও দেখছে না। নির্বাচনে বিশ্বস্ততা, নির্বাচন কমিশনের বিশ্বস্ততা, সর্বোপরি সরকারের বিশ্বস্ততার যে কত ক্ষতি হচ্ছে তা ভেবে দেখার কেউ নেই।

গতকাল প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিমকোর্টের ফুল বেঞ্চে কালিহাতী উপনির্বাচন নিয়ে শুনানি ছিল। হাইকোর্টের রিটের দিন যেমন দেখেছি অবকাশকালীন বেঞ্চে সবার আগে অ্যাটর্নি জেনারেল গিয়ে হাজির, ঠিক তেমনি গতকালও তিনি সবার আগে প্রধান বিচারপতির আদালতে হাজির ছিলেন। কালিহাতী উপনির্বাচনের শুনানি ছিল ৬ নম্বর তালিকায়। আমাদের অ্যাডভোকেট এ জে মোহাম্মদ আলী ঠিক সময় উপস্থিত হতে না পারায় শুনানিটি একটু পিছিয়ে নিয়ে তালিকায় ৯ নম্বর শেষে আমাদেরটি ধরেন। অ্যাটর্নি জেনারেল চুকিয়েই ছিলেন। তিনি অনেক কথা বলার চেষ্টা করেছেন। মনে হয় সব কথা তার বিপক্ষে গেছে। চারজন বিচারপতিই তাকে নানা প্রশ্ন করেছেন। তেমন একটা উত্তর দিতে পারেননি। আমাদের উকিল কিছু বলতে চাইলে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনার তেমন বলার প্রয়োজন নেই। আমি এটা হাইকোর্টে পাঠাচ্ছি। একজন গ্রাহককে ১০ বছরের সুবিধা দেওয়া হবে, তার ঋণ পুনঃতফসিল করে একবার ডিক্লাসিফাই আবার ক্লাসিফাই- এটার আগে মীমাংসা হোক তারপর নির্বাচন। ৩১ জানুয়ারির মধ্যে হাইকোর্টকে এটা নিষ্পত্তির নির্দেশ দিচ্ছি।’

আপাতত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত কালিহাতীর উপনির্বাচন স্থগিত। মানে এ বছর আর টাঙ্গাইল-৪, কালিহাতী নির্বাচন হচ্ছে না। আইন-আদালতের ওপর এখনো আমার আস্থা রয়েছে, তাই অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় কী?

লেখক : রাজনীতিক

সর্বশেষ খবর