বুধবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

আমরা আত্মহত্যা করছি, কেন করছি

নঈম নিজাম

আমরা আত্মহত্যা করছি, কেন করছি

ছেলেটিকে দেখতাম একা একা হাঁটছে। কারও সঙ্গে তেমন কথাবার্তা বলত না। আমাকে দেখলে সালাম দিত। মাঝে মাঝে লুকিয়ে কোনার দোকান থেকে সিগারেট কিনে খেত। সামনে পড়ে গেলে লুকিয়ে ফেলত। আমিও না দেখার ভান করতাম। বয়স আর কত হবে? ১৮ অথবা ১৯। আমার ড্রাইভার জানাল ছেলেটির বাবার নাম আতিকুল হক চৌধুরী। বাংলাদেশের বিখ্যাত নাট্যকার-নির্মাতা। এরশাদ আমলে আতিকুল হক চৌধুরীর প্রথম নাটক দেখেছিলাম বাবার কলম কোথায়? এখনো মনে গেঁথে আছে। আমরা লালমাটিয়া নিউ কলোনির একই বিল্ডিংয়ে থাকতাম। এক দিন বাসায় ফিরে জানলাম সেই ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে। মনে কী দুঃখ ছিল জানা হয়নি। ছেলের মৃত্যুতে ভেঙে পড়লেন বাবা। আহারে এক অসহায় পিতা। আমি গেলাম দেখা করতে। আতিকুল হক চৌধুরী আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালেন। তারপর বললেন, ও চলে গেছে। কী করুণ দৃশ্য। আমার ভীষণ খারাপ লেগেছিল। আহারে মানুষ কেন আত্মহত্যা করে! আমাদের আরেক বন্ধুপত্নী আত্মহত্যা করেছিলেন স্বামীর প্রতি অকারণে অভিমান করে। সেই সকালে সেই বাড়িতে গিয়েছিলাম। যুবলীগ নেতা চঞ্চল মাঝে মাঝে ফোন করতেন। সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক নেতা। হুট করে আত্মহত্যা করে বসলেন। কেন করলেন আজও জানা যায়নি। যেমন জানা যায়নি নায়ক সালমান শাহের করুণ দুঃখের কথা। দেশ-বিদেশের অনেক বিখ্যাত মানুষের আত্মহত্যা আমাদের আহত করে। জীবনানন্দ দাশ তেমনই একজন। মেরলিন মনরো আরেকজন। সুন্দর এই পৃথিবীকে খুব সহজে তারা বিদায় দিয়েছেন। এই মানুষগুলোর জন্য খারাপ লাগে। দুনিয়াটাকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিলেই পারতেন তারা। কিন্তু সবাই সব পারেন না। পারেননি কবি জীবনানন্দ দাশও। অভাব-অনটনের জীবন ছেড়ে তিনি চলে যান নীরব অভিমানে।

১৪ অক্টোবর ১৯৫৪ সাল। চলন্ত ডাউন বালিগঞ্জ ট্রাম স্টেশন থেকে একটুখানি দূরে। জলখাবার ও কুয়েল হাউসের সামনের রাস্তায় হঠাৎ ট্রামচালক খেয়াল করলেন, একজন মানুষ রাস্তা অতিক্রম করছেন। চলনে অন্যমনস্কভাব। অবিরাম ঘণ্টা বাজাচ্ছেন চালক। চিৎকার করছেন। কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। মানুষটির থামার কোনো লক্ষণই নেই। দ্রুত পারও হচ্ছেন না রাস্তা। প্রাণপণে ট্রাম থামানোরও চেষ্টা করছেন চালক। একপর্যায়ে গাড়ি থামল বটে। কিন্তু ততক্ষণে যা ঘটার তাই ঘটল। প্রচণ্ড ধাক্কায় মানুষটির দেহ ক্যাচারের ভিতরে ঢুকে গেছে। অনেক কষ্টে সবাই মিলে টেনেহিঁচড়ে রক্তাক্ত দেহ বের করলেন। কেটে ছিঁড়ে থেঁতলে গেছে সারা দেহ। ভেঙে গেছে বুকের পাঁজর, ডানদিকের ঊরুর হাড়। হাসপাতালে নেওয়া হলো। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। এই মানুষটি কবি জীবনানন্দ দাশ। বাংলা ভাষার অসাধারণ কবি। কবির মৃত্যুর পর ঝড় ওঠে বাংলাজুড়ে। কবি কি আত্মহত্যা করেছেন না দুর্ঘটনার শিকার? কবির পরিবার থেকে বলা হলো তিনি কখনোই সুখী ছিলেন না পারিবারিকভাবে। এই কারণে আত্মহত্যা করেছেন। কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য লিখেছেন, আমার মনে হয় জীবনানন্দ ঠিক ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা যাননি। যদিও এই কথাটাই সর্বত্র বলা হয়ে থাকে আমরা দেখেছি : তথাপি আমার ধারণা তিনি আত্মহত্যা করেছেন। জীবনানন্দের আত্মহত্যা প্রসঙ্গে কবির আট বছর আগের একদিন কবিতাটিও আলোচনায় ছিল। কারণহীন স্বেচ্ছামৃত্যুকে তিনি ব্যবহার করেছিলেন এই কবিতায়। কবিপত্নী লাবণ্য দাশ বলেছেন... মৃত্যুর পরপার সম্বন্ধে ওর একটা অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল। মাঝে মাঝে ওই কথা বলতেন। বলতেন, মৃত্যুর পরে অনেক প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা হয়। আর খালি বলত আমি মারা গেলে তুমি কী করবে?

 

 

শেষ জীবনে কবি জীবনানন্দ চরম অর্থকষ্টে ছিলেন। তুচ্ছ কারণে চাকরি হারিয়েছেন বারবার। এর মাঝে যোগ হয় স্ত্রীর বারবার অসুস্থতা। তিনি ছিলেন অনেকটা অসহায়। অর্থকষ্টের কারণেই ভাড়া বাড়ির একটি অংশ সাবলেট দিয়েছিলেন। এই ভাড়াটিয়া ছিলেন নর্তকী। এতে আরও বিপত্তি বাধে। তার যন্ত্রণায় কবির লেখালেখির বারোটা বাজে। কিন্তু টাকার জন্যই এই ভাড়াটিয়াকে মেনে নিতে হয়েছিল। এ সময় কবি অনেক ধারকর্জ করেছেন। কবি তার সেই সব কষ্টের কথা লিখেছিলেন স্বরাজ পত্রিকার সম্পাদক হুমায়ূন কবীরকে। তিনটি চিঠিতে এই কষ্টের কথাগুলো উঠে আসে কবির মৃত্যুর কয়েক মাস আগে। চরম কষ্ট থেকে মানুষ অনেক কিছু করতে পারে। আর সেই কষ্ট হয়তো সইতে না পেরে কেউ কেউ চলে যান না ফেরার দেশে। অনেক সময় বাস্তব নয় উপন্যাসের চরিত্রও আমাদের নাড়া দেয়। শরৎচন্দ্রের দেবদাস উপন্যাস পড়ে কিশোরবেলায় আমাদের চোখ ছলছল করত। কষ্ট থেকে দেবদাস মদ পান করতেন। আর মদ খেতে খেতেই মৃত্যু হয় দেবদাসের। বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজে দেবদাস এখনো আলোচিত কষ্টের নায়ক। আবার বিশ্বখ্যাত মানুষও হতাশায় সব ছেড়ে চলে যেতে পারেন। দুনিয়া কাঁপানো মেরলিন মনরো তেমনই। লস এঞ্জেলসের বিলাসবহুল বাড়িতে এক সকালে দেখা গেল তার দেহ একাকী পড়ে আছে বিছানায়। আত্মহত্যা করেন তিনি। সারা দুনিয়া কেঁপে ওঠে এই মৃত্যু সংবাদে। স্বামী বিবেকানন্দ ধ্যান করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন। পৃথিবীর সেরা রোমান্টিক ইংরেজ কবি শেলি মাত্র ৩০ বছর বয়সে পানিতে ডুবে মারা যান। অনেকে বলেন, জীবনানন্দ দাশের মতোই তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। আবার কারও মতে লর্ড বায়রনের সঙ্গে লড়াইয়ের কারণে তাকে হত্যা করা হয়। আরেক কবি জন কিটসও চলে যান অকালে। আবার অনেক তারকার সর্বনাশ হয় ড্রাগের কারণে। বিংশ শতাব্দীর সেরা গায়কদের একজন এলভিস প্রেসলির মৃত্যুও ছিল করুণ। অতিরিক্ত ড্রাগই সর্বনাশ করেছিল তার।

অনেক দিন পর মনে হচ্ছে, শুধু ব্যক্তি নন দেশ সমাজ, রাষ্ট্রও অনেক সময় আত্মহত্যা করে। বর্তমান বিশ্বে তাই হচ্ছে। বাংলাদেশে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আত্মহত্যার পরিমাণ বেড়েছে। আমাদের সমাজ, রাষ্ট্রব্যবস্থাও হরহামেশা আত্মহত্যাকে উৎসাহিত করছে। সারা জীবন গণতন্ত্রের পক্ষে থেকে অগণতান্ত্রিক কাঠামোর পক্ষে সাফাই এক ধরনের আত্মহত্যা। জীবন সংসারকে ধ্বংস করা আরেক ধরনের আত্মহত্যা। অপরের অমঙ্গল কামনা করা ও দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থার কাছে আত্মসমর্পণও আত্মহত্যা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করা আত্মহত্যা। রাজনীতিবিদদের নীতি আদর্শচ্যুতিও এক ধরনের আত্মহত্যা। আমরা হরহামেশায় আত্মহত্যা করছি। নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করছি। ধর্মের নামে বোমাবাজরা মসজিদ উড়িয়ে দিচ্ছে। নিজ ধর্মের ভাইকে হত্যা করছে। মানব বোমা বিশ্বকে তছনছ করে দিচ্ছে। টুইন টাওয়ার ধ্বংসকারীরাও নিজেদের জীবনকে বিসর্জন দিয়েছিলেন। ধর্মের নামে খুন করা হচ্ছে। মানবিক মূল্যবোধগুলো ধ্বংস করে আত্মহত্যা করছে মানুষের মন ও শরীর। ব্যক্তি ও জাতীয় জীবন থেকে স্বাভাবিক উপলব্ধিবোধ ওঠে যাচ্ছে। আমাদের অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের একটি ইমেজ ছিল। সেই ইমেজ এখন আত্মহননের পথে। আমরা বুঝি যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে। কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে দেওয়া যায় না। তারপরও আমরা সবকিছু রক্ষা করতে পারছি না। একের পর এক ব্লগার, প্রকাশক খুন হচ্ছে। একটি হত্যাকাণ্ড আরেকটিকে ডেকে আনে। প্রথমগুলোর বিচার হলে পরেরগুলো হতো না। খুনিদের শনাক্ত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। খুনিদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। অন্যথায় আইনের শাসন বলে কিছু থাকবে না। সন্ত্রাস নৈরাজ্য বাড়বে। সমাজ এগিয়ে যাবে আত্মহত্যার পথে। যা থেকে তাকে ফেরানো যাবে না। বাংলাদেশকে আমরা পাকিস্তানের মতো আত্মহননকারী দেশ হিসেবে দেখতে চাই না। দুঃসহ অবস্থার অবসান চাই। আত্মহননে রয়েছে আমাদের খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুর-ডোবা। নাগরিক জীবন পদে পদে বিপন্ন। খাবারে, পানীয়তে, ওষুধে, কসমেটিকসে, মসলাতে, ফলে ভেজাল মিশিয়ে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে ঠাণ্ডা মাথায়। জেনে শুনে এসব হত্যাকাণ্ড বড় ধরনের আত্মহনন। আমরাই আমাদের ঠেলে দিচ্ছি সেই হননে।

এখন আসি কেন আত্মহনন বন্ধ করতে হবে তা নিয়ে। কারণ আমাদের ধর্মে স্বেচ্ছায় জীবন বিসর্জন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সতর্ক হতে হবে সবাইকে। হতাশার কিছু নেই। দুনিয়ার অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বই বারবার ব্যর্থতা সামাল দিয়ে সফলতার মুখ দেখেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন তার জীবনে সবচেয়ে বেশি পরাজিত ছিলেন। ২৩ বছর বয়সে চাকরি হারান, রাজনীতিতে পরাজিত হন। এই তার হার শুরু। এরপর ব্যবসায় লস করেন। স্পিকার পদে, কংগ্রেস প্রার্থী নির্বাচনে, সিনেট নির্বাচনে, ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে তিনি হেরে যান। একবার ভূমি অফিসার পদেও রিজেক্ট হয়েছিলেন। সেই আব্রাহাম লিংকন ৫২ বছর বয়সে জয়ী হন, এই জয় তাকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বানিয়ে দেয়। দুনিয়া কাঁপিয়ে দেন তিনি। আব্রাহাম লিংকন থেকে শিক্ষা নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। এই দুনিয়াতে বেঁচে থাকার চেয়ে আনন্দের আর কিছুই নেই। এক সময় বাংলাদেশের ঝিনাইদহ জেলার মানুষ সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করত। আমাদের ধর্মও আত্মহত্যার বিপক্ষে। আত্মহত্যায় বিরত থাকতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। কোরআনে নির্দেশ আছে, ‘তোমরা নিজেদের হত্যা কর না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু এবং যে কেউ সীমা লঙ্ঘন করে অন্যায়ভাবে আত্মহত্যা করবে, তাকে অগ্নিতে দগ্ধ করব, এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ।’ পৃথিবীটা অনেক সুন্দর। এই পৃথিবীকে সুন্দর রাখতে আমাদের সবাইকে চেষ্টা করতে হবে। এখানে অনিয়ম-অসঙ্গতি ছিল, আছে। থাকবে। এর মাঝে কাজ করতে হবে আমাদের। বাসযোগ্য করতে হবে পৃথিবীকে। এটা কারও একার পক্ষে সম্ভব নয়। সবার সম্মিলিত প্রয়াসেই তা হতে পারে।

পাদটীকা : দুর্ঘটনার পর কবি জীবনানন্দ দাশের বেঁচে থাকার আকুতি ছিল। তার দুর্ঘটনার খবরের পর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন সবাই ছুটে আসেন হাসপাতালে। বাদ যাননি কলকাতার বড় চিকিৎসকরাও। সবাই মিলে শেষ চেষ্টা করছেন। এ প্রসঙ্গে সুবোধ রায় লিখেছেন, ‘শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে দুই নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয় কবিকে। খবর পেয়ে দেখতে আসেন অনেকেই।এসে পড়েন কবির নিকটাত্মীয় স্বনামধন্য চিকিৎসক শ্রী অমল দাশ এবং আরেকজন বিশেষজ্ঞ ড. একে বসু। ডাক্তার অমল দাশকে দেখে বড় প্রাণ এলো কবির, কে বুলু? বাঁচিয়ে দে...। শিশুর মতো অসহায় কণ্ঠ বুলু, বাঁচিয়ে দে ভাই!’

ডাক্তাররা শেষ চেষ্টা করলেন। পারলেন না। কবির শেষ আকুতি সবাইকে আপ্লুত করেছিল। কিন্তু কিছুই হলো না। ধানসিঁড়ি নদী পেরিয়ে কবি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আগেই লিখে গিয়েছিলেন, ‘পাই নাই কিছু, ঝরা ফসলের বিদায়ের গান তাই গেয়ে যাই আমি, মরণেরে ঘিরে এ মোর সপ্তপদী।’ ‘যে ঘুম ভাঙে নাকো কোনো দিন ঘুমাতে ঘুমাতে সবচেয়ে সুখ আর সবচেয়ে শান্তি আছে তাতে।’

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

 

 

 

 

সর্বশেষ খবর