বুধবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ব্যক্তি ও চোরের দায় দল কেন নেবে

নঈম নিজাম

ব্যক্তি ও চোরের দায় দল কেন নেবে

খোলা আকাশ দেখতে কার না ভালো লাগে। মাঝে মাঝে ঢাকা ছাড়ি খোলা আকাশের নিচে চাঁদের আলোতে ভিজতে। শিশিরভেজা ঘাসে খোলা পা রাখতে। বর্ষায় ঝিঁঝিঁ পোকা আর ব্যাঙের ডাক শুনতে। শ্রাবণের অঝোর ধারায় আপ্লুত হতে। গন্ধরাজের মাতাল হাওয়াতে মৌমাছির গুঞ্জন দেখতে। এবার শীতের কোনো খবর নেই। তবুও বের হলাম কদিন আগে এক সকালে। কুয়াশায় ঢেকে আছে আকাশ। এই কুয়াশাকে ফাঁকি দিয়ে আকাশের বেরোনোর কোনো পথ নেই। কিন্তু ঘাসের ডগায় কুয়াশার ছটা দেখলাম না। প্রকৃতি ও পরিবেশ বদলে যাচ্ছে মানুষের মতো। আগের সেই গ্রাম নেই। পাখির কলকাকলি উধাও। সবকিছু এত দ্রুত বদলে যায় কেন? রুক্ষ, কাঠিন্যতায় চারপাশ। মানুষের জীবনে কিছু কঠিন সময় যায়। এই কাঠিন্যকে ভেদ করে পথ চলতে হয়। দুঃসহ বোবা আর্তনাদে কখনো থমকে যায় পথ চলা। তারপরও মানুষ থেমে থাকে না। জীবন যেন এক বহমান নদী। দুঃখ-কষ্টকে ছাপিয়েই এই নদী এগিয়ে চলে আঁকাবাঁকা পথ পাড়ি দিয়ে। পেছনে খড়কুটার মতো পড়ে থাকে জীবন যন্ত্রণার স্রোত। স্বপ্নিল জগত্ রঙিন হয়ে আছড়ে পড়ে নবপ্রভাতে। জাগতিক মায়ার জাল আচ্ছন্ন করে আমাদের। সময় ক্ষণভেদে মানুষ খোঁজে তার বর্তমান ও ভবিষ্যেক। অতীত জীর্ণ পাতার মতো পড়ে থাকে। কবিগুরু বলেছেন, ‘চক্ষে আমার তৃষ্ণা, ওগো তৃষ্ণা আমার বক্ষজুড়ে’।

রাজনীতির মতো জটিল বিষয়গুলোতে হিসাব-নিকাশ সব সময় মেলে না। জটিলতা তৈরিই যেন রাজনীতির কাজ। পরিবর্তনের ধারাগুলো অনেক সময় আমাদের ভালো লাগে না। তবুও মেনে নিতে হয়। সহ্য করতে হয়। ১৯৩৬ সালে সোভিয়েত রাশিয়াতে শুরু হয়েছিল দ্য গ্রেট পার্জ, স্টালিনের মহাশুদ্ধিকরণ পরিকল্পনা। মূল আয়োজনটা ছিল অ্যান্টি-কমিউনিস্ট লোকজন ও ক্রিয়াকর্মকে ছেঁটে ফেলা। এখানে সহনশীলতার কোনো বালাই ছিল না। সমালোচনা শোনার সময় ছিল না। মিডিয়ার স্বাধীনতা ছিল না। কখন কাকে ধরে নিয়ে যাবে কেউ জানত না। পেশাজীবীদের অনেকে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী হলেও তারা নিষ্ঠুরতার বিপক্ষে ছিলেন। বিবেকবানরা তাই মুখ খোলা বন্ধ করে দিলেন। ভুলেও তারা বললেন না, জোতদের কৃষিজমি দখলের পর তা ধ্বংসে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র। ধ্বংস নয়, সৃষ্টিতেই আনন্দ। সৃষ্টির আনন্দকে জাগ্রত করতে হবে। কবির দল মুখ খুলল না। তারা চাটুকারিতায় লিপ্ত হয়। সাহিত্যিকরা স্টালিনকে নিয়ে বড় বড় বই লিখে ফেলেন। অনেক অতিউত্সাহী উপন্যাসও রচনা করেন। চারদিকে শুধু স্টালিনের জয়গান। লেনিনের পথ ধরে স্টালিন রাশিয়ার বিস্তার ঘটান। একের পর এক রাষ্ট্র যুক্ত করেন রাশিয়ার সঙ্গে। ১৯২২ থেকে ৫৬ পর্যন্ত রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয় আরমেনিয়া, আজারবাইজান, বেলারুশ, এস্তনিয়া, জর্জিয়া, কাজাখ, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, মান্ডোভা, তাজিকিস্তান, ইউক্রেন ও উজবেকিস্তান। নতুন নাম হয় সোভিয়েত সোসালিস্ট ইউনিয়ন। হাজার বছরের পুরাতন যার একনায়কতন্ত্রকে তছনছ করেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের যাত্রা। সেই বিপ্লবকে দেশে দেশে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন লেনিন, স্টালিন, ক্রুশ্চেভ। সেই রাশিয়া আজ কোথায়? রাশিয়ার উন্নতি, অগ্রগতি পড়তাম উদয়ন ও সোভিয়েত নারীতে। ডাকযোগে আমাদের বাড়ি আসত এই ম্যাগাজিনগুলো। বছর শেষে আমরা বইয়ের মলাট লাগাতাম। সোভিয়েত নারী নিয়ে গভীর মনোযোগী আমার মেজবোন। আমার উত্সাহটা বেশি ছিল বইয়ের মলাট ব্যবহারে। বন্ধুদেরও উপহার দিতাম। তারা খুশি হতো।

 

 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়ার বিশাল অবদান রয়েছে। সেই সময় রাশিয়ার সমর্থন বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছে। রাশিয়াকে বাংলাদেশের বন্ধু করতে একজন নারীর বিশাল অবদান রয়েছে। তিনি আর কেউ নন ইন্দিরা গান্ধী। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় যার অবদানের শেষ নেই। সেই সময়ে ভারতের অর্থনীতি মোটেও আজকের অবস্থানে ছিল না। দারিদ্র্য ছিল। সমস্যা ছিল। কিন্তু ইন্দিরার হাত ছিল আমাদের জন্য খোলা। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বাড়ি ছিল সরগরম। আমার মা রোজ নামাজ পড়ে দোয়া করতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য। বঙ্গবন্ধুর ডাকেই তার সন্তান, ভাই যুদ্ধে গেছে। অংশ নিয়েছে সম্মুখসমরে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমার ফুফাতো বোনের স্বামী শহীদ হয়েছেন। তিনি পাকিস্তান আর্মি ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। আমাদের বাড়ি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও খাওয়ার আয়োজন ছিল আমাদের বাড়িতে। আমার মা রান্না করতেন সন্তান, ভাই ও তাদের সহযোদ্ধাদের জন্য। আমাদের অঞ্চলের আঞ্চলিক কমান্ডার ছিলেন আবদুল মালেক। আমি যখন গ্রামে ঘুরে ঘুরে রাজনীতি করতাম তখন তিনি আমাকে প্রায় বলতেন, ভাগ্নে মুক্তিযুদ্ধে তোমার মা ও নানীর অবদান কোনো দিন ভুলব না। আমার ছোট মামা ছিলেন মালেক কমান্ডারের বন্ু্ল। এই কারণে তিনি আমার নানীকে মা ডাকতেন। আমার মাকে ডাকতেন বোন। সেই সময়ে গ্রামে খুব কম পরিবার ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার। হঠাত্ করে অনেক মানুষের খাওয়ার আয়োজন করার। আমাদের গ্রামে আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তার নাম ছেরু মিয়া। এখন তিনি ট্রাক চালান। মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট আজও পাননি। জেনারেল ওসমানী ও মেজর হায়দারের সার্টিফিকেট নিয়ে তার সন্তানরা দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। ট্রাকচালক ছেরু মিয়ার সন্তানরা জানেন না তাদের পিতা সম্মানটুকু পাবেন কিনা। সত্যিকারের অনেক মুক্তিযোদ্ধা এভাবে আড়ালে পড়ে আছেন। আমার ভাই মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ উদ্দিন ভূইয়া এখনো আক্ষেপ করেন, বিজয় দিবসের দিন থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বঞ্চনা শুরু। ১৬ ডিসেম্বরের পর গজিয়ে ওঠে সিক্সটিন ডিভিশন। তারাই সব কিছুর নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার পর আবেগে আপ্লুত ছাত্রলীগের মেধাবী তারুণ্য চলে যায় জাসদে। যাদের প্রায় সবাই অংশ নিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। আর সেই সুযোগে তখন আওয়ামী লীগে দাপুটে হয়ে ওঠে সিক্সটিন ডিভিশন। স্বাধীনতার পর এই সিক্সটিন ডিভিশন আওয়ামী লীগকে ডুবায়। আওয়ামী লীগের সর্বনাশ করে। ১৫ আগস্টের পর এদের আর দেখা যায়নি।

সেদিন এক আড্ডায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে বিতর্কে পড়লাম। আজকাল আড্ডা আসরে রাজনীতি নিয়ে কথা বলি না। কেবল শুনি। কারণ নবাগত, বহিরাগত হাইব্রিডদের চেতনার কাহিনীর শেষ নেই। এই মানুষগুলোকে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে কখনো দেখিনি। এখন তাদের কথা হলো, আওয়ামী লীগের কোনো এমপি, মন্ত্রী চুরি করলে লেখা যাবে না। মাদক পাচার, মানুষ পাচার, গডফাদারদের বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না। ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের। কারণ এতে নাকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এসব কথা শুনে হাসব না কাঁদব বুঝতে পারি না। হায়দার হোসেনের কণ্ঠের গানটা মনে মনে গাই, ‘কী দেখার কথা, কী দেখছি? কী শোনার কথা, কী শুনছি? কী ভাবার কথা, কী ভাবছি? কী বলার কথা, কী বলছি? ৩০ বছর পরও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি’। নবাগত, বহিরাগতদের বলছি, শুনুন, আপনারাই আওয়ামী লীগের সর্বনাশ করছেন। অতি চাটুকারিতায় সরকারের সর্বনাশ হয়। আর সরকারগুলোকে ডুবায় হাইব্রিডরা। ৫ জানুয়ারির আগে হাইব্রিডদের তত্পরতা থেমে গিয়েছিল। এখন আবার সবাই মাঠে। এর মাঝে গত দুই বছরে আবার নতুন করে একদল হাইব্রিডের সৃষ্টি হয়েছে। আজকাল তাদের টিভির পর্দায় দেখি। বাজারের সব তেল পড়ছে টিভির পর্দা গলিয়ে। আমি বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে কোনো আপস করা যাবে না। বাংলাদেশের সংবিধান আর জাতীয় পতাকার সঙ্গে আপস চলবে না। শেখ হাসিনা স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের শেষ ঠিকানা। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদের অবসানে তার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু যারা দলের নাম ভাঙিয়ে, ক্ষমতার দাপটে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে তাদের ছাড় দেওয়া যাবে না। তাদের কাহিনী তুলে ধরতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে হবে। বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে গডফাদার, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ আর দুর্নীতিবাজ, দখলবাজদের। অন্যথায় বঙ্গবন্ধুর আত্মা কষ্ট পাবে। একাত্তরের বীর শহীদ যোদ্ধাদের আত্মা চিত্কার করে বলবে, এই বাংলাদেশ দেখার জন্য আমরা যুদ্ধ করিনি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল দুর্নীতি ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত। এই চেতনাকে ক্ষতি করা যাবে না। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, ব্যক্তি ও চোরের দায় নেবে না তার দল। কথাটি নিয়ে বাংলাদেশকে ভাবতে হবে।

আগে গ্রামেগঞ্জে পালাগানের উত্সব হতো। লড়াই হতো শরিয়ত আর মারিফতের। দুই পক্ষই রাতভর যুক্তিতে অংশ নিতেন। মানুষ রাত জেগে শুনতেন। রাতভর গান শুনে ভোরে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরতেন। তখন মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ব ছিল। দল, মত, ধর্ম, বর্ণের বাইরে গিয়ে একজন দাঁড়াতেন আরেকজনের পাশে। কোথায় যেন আজ সব হারিয়ে গেছে। নিভে গেছে আশার আলোগুলো। এখন গ্রামে যাত্রাপালা বসে না। লড়াই হয় না শরিয়ত-মারিফতের। বাউলদের খারাপ সময় যাচ্ছে। যাত্রাপালার নামে চলে অশ্লীল নৃত্য। চারদিকে একটা অসুস্থতা। সন্ত্রাসীরা হামলা করে যাত্রাপালায়। চাঁদাবাজরা ভাগ বসায় সার্কাস আর পুতুল নাচের আয়োজনে। প্রিন্সেস টিনা খান, রত্নাদের নাচ হতো জিয়া-এরশাদ আমলেও। এখন কোনো কিছুই নেই। আমাদের এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে হবে। জীবনকে উপলব্ধি করতে হবে। থাকতে হবে বাস্তবতায়। তবে এবার ফোক ফেস্ট ও উচ্চাঙ্গসংগীতের আয়োজন আমাকে আশাবাদী করেছে। মাঝরাত অবধি হাজার হাজার মানুষ স্টেডিয়ামে বসে গান শুনছে। উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছে। শুধু পবন দাস বাউল নন, তারা উচ্চাঙ্গসংগীতের আসরেও মাতোয়ারা ছিল। যে দেশে মাঝরাতে হাজার হাজার মানুষ দলবেঁধে গান শোনে সেই দেশে জঙ্গিবাদের আবাদ হতে পারে না। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে চাই জিরো টলারেন্স। আমাদের এই ভূখণ্ডকে রক্ষা করতে হবে। রাজনীতি আর ধর্মের নিষ্ঠুরতার বলি আমরা কোনো কিছুকে হতে দিতে পারি না। পরমতের প্রতি সহিষ্ণু হতে হবে। এখানে দল থাকবে না, মত থাকবে না সবাইকে আসতে হবে এক চেতনায়। শুধু বাংলাদেশ নয়, অনেক কিছু নিয়ে বিশ্ব মোড়লদেরও ভাবতে হবে। মনে রাখতে হবে, সাদ্দামকে সরিয়ে দেওয়া ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ভুল। সাদ্দাম জীবিত থাকলে আজকে আইএসের ডালপালা এ অবস্থানে আসতে পারত না। সাদ্দামের একনায়কতন্ত্র, কুয়েত দখল করার বিপক্ষে বিশ্বজনমত শক্তিশালী ছিল। তাকে কোণঠাসা রেখেই সবকিছু অন্যভাবে মোকাবিলা করা যেত। বিশ্বের এই মুহূর্তের বড় চ্যালেঞ্জ জঙ্গিবাদ মোকাবিলা। আফগানিস্তানে ধর্ম দিয়ে সমাজতন্ত্রকে অপসারণের খেসারত সবচেয়ে বেশি দিতে হয়েছে আমেরিকাকে।

-লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

সর্বশেষ খবর