বৃহস্পতিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

টেলিভিশন মাধ্যম টিকে থাকবে তো?

ড. শেখ আবদুস সালাম

টেলিভিশন মাধ্যম টিকে থাকবে তো?

এখন থেকে মাত্র চার বছর আগে ২০১১ সালে বিশিষ্ট যোগাযোগ পণ্ডিতেরা (উইমার এবং ডোমিনিক) রেডিও এবং টেলিভিশনের জনপ্রিয়তা তথা শ্রোতা-দর্শক সংখ্যা ও শ্রোতা-দর্শকদের এসব গণমাধ্যম দেখা বা শোনার সময় হ্রাস পাওয়া সম্পর্কে বলেছিলেন যে, ঞযব যঁমব ত্ধফরড় ধহফ ঞঠ ধঁফরবহপব ধত্ব মড়হব; The huge radio and TV audience are gone; They are to disappear because there are many choices for listeners and viewers.. তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কনটেক্সট বা পারিপার্শ্বিকতা এবং ডাটা বা তথ্য উল্লেখ করে বলেছিলেন মাত্র কয়েক বছর আগেও ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মার্কিন দর্শক টেলিভিশনের প্রাইম-টাইম প্রোগ্রামগুলো দেখত। বর্তমানে তা দেখছে মাত্র ১৪ শতাংশ দর্শক।

সারা বিশ্বে আজ আইসিটি এবং নিউ মিডিয়ার জয়জয়কার। অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশের যুব সমাজ বিশেষ করে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা স্মার্ট ফোন, ল্যাপটপ, নেটবুক, ট্যাব, ডেস্কটপ প্রভৃতি তথ্যপ্রযুক্তিগত টুলস বা মাধ্যম ব্যবহার করে ইন্টারনেটের সাহায্য বিশ্বনাগরিক হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলছে। তারা এসব থেকে খবর, বিজ্ঞাপন, শিক্ষা-বিজ্ঞান ও জ্ঞানভাণ্ডারের তথ্য, ইন্টারটেইনমেন্টের যাবতীয় উপাদান দ্রুততম সময়ের মধ্যেই পেয়ে যাচ্ছে এবং তা ব্যবহার ও উপভোগ করছে। এসবের কারণে সংবাদপত্র তো বটেই এমনকি অন্যান্য ইলেকট্রনিক মিডিয়া যেমন : রেডিও, টিভি প্রভৃতি তাদের আবেদন হারিয়ে ফেলতে বসেছে। এমনকি বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের একটি ব্যাপকাংশ আজকাল ইন্টারনেট ব্যবহার করে তাদের ল্যাপটপে টিভি প্রোগ্রাম ডাউনলোড করে নিচ্ছে এবং ল্যাপটপেই বা কম্পিউটারে সুবিধামতো সময়ে তা দেখে নিচ্ছে। একটি নাটক টেলিভিশনের পর্দায় দেখতে যে সময় ব্যয় হয় ল্যাপটপ বা কম্পিউটারে তা দ্রুত এবং অতি কম সময়ে দেখে ফেলা যায়। এটিও টেলিভিশন দর্শক কমে যাওয়ার একটি বড় কারণ হয়ে থাকতে পারে।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা তথ্যে দেখা গেছে, ২০১২-১৩ সালে চট্টগ্রাম শহরে টিভি দর্শকরা দৈনিক গড়ে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা টেলিভিশনের বিভিন্ন প্রোগ্রাম দেখে সময় ব্যয় করত। ২০১৫ সালের আর একটি স্টাডি অনুযায়ী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখন দৈনিক গড়ে ৬৭ মিনিট টেলিভিশন দেখছে। টেলিভিশন মাধ্যমের জন্য এটি একটি বড় দুঃসংবাদ। হতে পারে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা তথা ইয়ং জনগোষ্ঠী আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ার অন্যান্য টুলস বা ফ্যাসিলিটিজগুলো বেশি ব্যবহার করছে; আর সে কারণে তাদের টেলিভিশন দেখার সময় আগের তুলনায় কমে যাচ্ছে।

উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের বিকাশের দিকে চোখ বুলালে দেখা যায় বাংলাদেশে সংবাদপত্র বিশেষ করে হার্ড কপি পড়ার পাঠক সংখ্যা টিকে আছে হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি পত্রিকা ঘিরে। বহুল প্রচারিত এসব পত্রিকার ক্ষেত্রেও দেখা যায় এগুলোর অনলাইন ভার্সনের পাঠক সংখ্যা হার্ড কপির পাঠক সংখ্যা থেকে অনেক বেশি। বাংলাদেশে পত্রিকার সংখ্যা বাড়লেও সেই হারে পাঠক বাড়ছে না। আমি ১৯৯৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টারে কাগজে ছাপা সংবাদপত্র টিকে থাকবে কি থাকবে না এ বিষয়ের ওপর একটি বক্তৃতা শুনেছিলাম (বক্তার নামটি এখন মনে নেই)। ওই বক্তৃতায় বক্তা তখনই ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিলেন উন্নত বিশ্বে সংবাদপত্র আর হয়তো মাত্র ২০-২৫ বছর টিকে থাকবে। সংবাদপত্র সংক্রান্ত এই পূর্বাভাসটি দিন দিন যেন বাস্তবতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান প্রভৃতি দেশে বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় সংবাদপত্র বন্ধও হয়ে গেছে। বিশ্বায়ন এবং তথ্যপ্রযুক্তিগত উত্কর্ষের কারণে এই পরিস্থিতি থেকে এক সময় উন্নয়নশীল বিশ্বও রেহাই পাবে বলে মনে হয় না। অন্যদিকে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার একসময়ের অন্যতম সর্বজনপ্রিয় মাধ্যম রেডিওর অস্তিত্ব এবং শ্রোতা সংখ্যাও দিন দিন কমে আসছে। এখন কেবল এফএম রেডিও এবং কোনো কোনো দেশে কমিউনিটি রেডিও এই সম্প্রচারব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছে। প্রযুক্তির সঙ্গে এখন প্রিন্ট মিডিয়া এবং রেডিও সম্প্রচার যেন তাল মিলাতে পারছে না। দিন দিন এসবের পাঠক-শ্রোতা সংখ্যা কমে যাচ্ছে। 

বাংলাদেশে টেলিভিশনের এখন আপাতত সুদিন। এই খাতে ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে এখন করপোরেট পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভিন দেশের হুবহু অনুকরণে এই মাধ্যমটির প্রোগ্রামগুলোর কাঠামো, কনটেন্ট বা বিষয়বস্তু তৈরি এবং তা সম্প্রচার করে অডিয়েন্স ধরে রাখার প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু কৃেকৗশলগত ভিন্নতার কারণে আইসিটির অন্যান্য মাধ্যমের কাছে টেলিভিশনও একসময় মার খেয়ে যাবে না তা বলা কঠিন। বাংলাদেশে টিভি প্রোগ্রামগুলোতে অপরাধ এবং রাজনীতি মূলত এই দুটি বিষয় নিয়ে এক ধরনের চটকদারিত্ব তৈরি করে এই মাধ্যমের শ্রোতা-দর্শক ধরে রাখা বা বৃদ্ধির চেষ্টা হচ্ছে বলে অনেকেই মনে করে থাকেন। বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মোজাহিদের ফাঁসিকে ঘিরে সেদিন প্রায় সব চ্যানেলের প্রচারণায় অতি চটকদারিত্ব দর্শকদের মধ্যে এক ধরনের বিরক্তির উদ্রেকও ঘটিয়েছিল। মূলত বাস্তবনিষ্ঠ ও জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়বস্তু মার্জিত ও ভারসাম্যপূর্ণ উপায়ে উপস্থাপন কৃষ্টি তৈরি না করতে পারলে আমাদের টেলিভিশন সম্প্রচারও একসময় মার খেয়ে যাবে। 

বর্তমান সময়ে আধেয় এবং সম্প্রচারগত দিক ছাড়াও টেলিভিশনের মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে উঠে আসছে আইসিটির বিভিন্ন প্রকরণ ও উপাদানগুলো। দিন দিন এগুলোর কৃেকৗশলগত মাত্রা এবং উন্নয়ন টেলিভিশনের জন্য এক বড় থ্রেট বা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি আমরা Understanding the pattern of cell phone use : A study on Dhaka university students শিরোনামে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছি। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ২০১৫ সালের মে মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে সেল ফোন এবং পিএসটিএন ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১২৫.৯৭ মিলিয়ন। আমাদের দেশে এখন কমবেশি ৪৭.৪২ মিলিয়ন মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৬ শতাংশ শিক্ষার্থী এখন সেলফোন ব্যবহার করছে (সেলফোন ব্যবহারের ন্যাশনাল বা জাতীয় হার হচ্ছে প্রায় ৮০ শতাংশ) এবং সেলফোন ব্যবহারকারী এসব শিক্ষার্থীর ৮৬ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। এদের মধ্যে ২৩ ভাগ এক ঘণ্টা, ৩০ ভাগ দুই ঘণ্টা এবং ১৪ ভাগ দুই ঘণ্টার ওপরে ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য সময় ব্যয় করে থাকে। এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে ৯৪ ভাগ শিক্ষার্থী আজকাল ফেসবুক ব্যবহার করছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে প্রায় ৭১ ভাগ ব্যবহারকারী দৈনিক ৩০ মিনিট বা তার বেশি সময় ব্যয় করে এই কাজে।

এখন আমরা যদি উপর্যুক্ত পরিসংখ্যানগুলো পর্যালোচনা করি তাহলে বুঝতে পারি বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা (তারা ইয়ং জেনারেশন নাগরিকও বটে) এখন তথ্য কিংবা বিনোদনের জন্য দিন দিন বেশি করে আইসিটি মাধ্যমগুলো ব্যবহারের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। গণমাধ্যম বা টেলিভিশন থেকে তারা আগে যেসব বিষয়ে উপভোগ করতে পারত সেসব এখন তারা সহজেই পেয়ে যাচ্ছে আইসিটি মাধ্যম বা নিউ মিডিয়া থেকে। ফলে তাদের কাছে টেলিভিশনের উপযোগিতা দিন দিন কমে আসছে। টেলিভিশন এখন নতুন জেনারেশনের জনগোষ্ঠীর মবিলিটির সঙ্গে তাল মিলাতে হিমশিম খাচ্ছে। বাসায় বসে টেলিভিশন সেটে প্রোগ্রাম দেখতে এই জেনারেশন এখন একঘেয়েমি অনুভব করছে।  এই প্রবন্ধের প্রথম দিকেই আমরা দেখেছি যে, চট্টগ্রামে এই ইয়ং জনগোষ্ঠী টেলিভিশন দেখার জন্য আগে যেখানে দৈনিক ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা সময় ব্যয় করত এখন তারা মাত্র ৬৭ মিনিট সময় ব্যয় করছে। ইয়ং জেনারেশনের  প্রতিনিধিত্বকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গড়ে দেড়-দুই ঘণ্টা সময় ব্যয় করছে ইন্টারনেট এবং আইসিটির বিভিন্ন টুলস ব্যবহারের পেছনে। আমার বিশ্বাস এখন থেকে পাঁচ-দশ বছর আগে তারা টেলিভিশন দেখে যে সময় ব্যয় করত তা এখন ক্রমশ কমে যাচ্ছে। টেলিভিশনের উপযোগিতা তাদের কাছে হয়তো দিন দিন কমেও আসছে। বিষয়টির বাস্তবতা খতিয়ে দেখার জন্য সংশ্লিষ্টজন সুনির্দিষ্ট গবেষণার আশ্রয় নিতে পারেন। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে এবং টেলিভিশন সম্প্রচার মাধ্যম হিসেবে সময় ও প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলাতে না পারলে এটিও একসময় ক্লিসে এবং সেকেলে মাধ্যমে পরিণত হয়ে যেতে পারে।  

-লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক।

     E -mail:[email protected]

সর্বশেষ খবর