শুক্রবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

নবী (সা.) ছিলেন কোরআনের নমুনা

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

নবী (সা.) ছিলেন কোরআনের নমুনা

‘ইকরা’ মানে পড়। প্রভুর এ বাণী দিয়েই শুরু হয়েছিল মহাগ্রন্থ কোরআনের পাঠ। হায়! মানুষ এ গ্রন্থ পড়েছিল শুধু ঠোঁটে ঠোঁটে। কিন্তু এ বাণী তারা আত্মায় ধারণ করতে পারেনি। নবী (সা.) কোরআনের নমুনা হয়ে গোটা জীবনটি যাপন করে গেছেন উম্মতের সামনে। যেন তারা কোরআন জীবনের অধিকারী হয়ে আলোকপ্রাপ্ত হয়। আহলে সুফফার দল এবং সাহাবিরা তাই হয়েছিলেন। কালের পরিক্রমায় আজ মুসলমান কোরআন হারা হয়ে ছিটকে পড়েছে সভ্যতা থেকে।  প্রযুক্তির দুনিয়া আজ মুসলমানকে যাচ্ছে তাই করে পছন্দ মতো ব্যবহার করছে, ছুড়ে ফেলছে। তাও মুসলমান বুঝছে না, হুঁশ আসছে না তাদের। হে মুসলমান তোমরা কি ফিরবে না কোরআনের দিকে?

পবিত্র কোরআন এমন এক সময় নাজিল হয়েছে যখন সমগ্র আরবসহ পুরো বিশ্ব অন্ধকারে ডুবে ছিল। এক আল্লাহর বিধান ভুলে হাজার খোদায় বিশ্বাসী ছিল মানুষ। মানুষ মানুষের গোলামি করত তখন। নারীরা হাটে বিক্রি হতো। কোরআন সর্বপ্রথম ঘোষণা করল, মানুষ কখনো মানুষের গোলামি করতে পারে না। মানুষ গোলামি করবে এক আল্লাহর, যার কোনো শরিক নেই। নারীরা মায়ের জাতি, তাদের ভোগ্যপণ্যের মতো বিক্রি করা যাবে না। কোরআনের এ নয়া ডাকে হুমড়ি খেয়ে পড়ল যুবকরা। দিশাহারা হয়ে গেল আরবের ধর্মব্যবসায়ী নেতারা। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ধর্ম ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে? গোলামরা মানুষের মর্যাদা পাবে? নারীদের সম্মান করতে হবে? না। এ কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। যে করেই হোক মুহাম্মদের মিশন বন্ধ করতে হবে। মক্কার বড় বড় কাফের নেতারা জরুরি সভা ডাকলেন। আবু জাহেল, আবু লাহাব, ওতবা, শায়বাদের উপস্থিতিতে মিটিং চলছে। একজন বলল, ‘অল্প কিছু দিন পরই হজ। হজের সময় মুহাম্মদ যেন বহিরাগতদের কাছে কোরআনের দাওয়াত পৌঁছাতে না পারে— এ জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’ আরেকজন বলল, ‘মুহাম্মদ যা বলছে, তা শোনামাত্রই মানুষ তার দ্বীন গ্রহণ করছে। তাই এমন একটা ব্যবস্থা করতে হবে, মানুষ যেন মুহাম্মদের কাছে না যায়।’ ‘তাহলে চলো আমরা ওলিদ ইবনে মুগিরার কাছে যাই। সেই আমাদের বলবে কী করতে হবে’— আরেক নেতা বলল। ওয়ালিদ ছিল আবু জাহেলের দূরসম্পর্কের চাচা। আরবের সবচেয়ে ধনাঢ্য এবং ক্ষমতাধর কবি। মক্কার নেতারা ওলিদের কাছে এসে বলল, ‘হে বয়োবৃদ্ধ-জ্ঞানবৃদ্ধ আরবের সৌরভ! আমাদের এমন কিছু কথা শিখিয়ে দিন যাতে মানুষ যেন মুহাম্মদের দাওয়াত গ্রহণ না করে।’ ওলিদ বলল, আগে তোমরা বল, আমি শুনব। তবে তোমাদের সবাইকে এক কথা বলতে হবে। মানুষ যেন তোমাদের বিশ্বাস করে। একজন বলল, আমরা বলব, মুহাম্মদ গণক। ওলিদ বলল, আল্লাহর শপথ! মুহাম্মদ গণক নয়। গণকরা যেভাবে অস্পষ্ট কথা বলে, মুহাম্মদ তা বলে না। সে তো দৃপ্তকণ্ঠে সুস্পষ্ট কথা বলে।’ তাহলে আমরা বলব, মুহাম্মদ পাগল। ওলিদ বলল, আল্লাহর কসম! মুহাম্মদ পাগল নয়। তাঁর কথা কেউই পাগলের প্রলাপ বলে বিশ্বাস করবে না। আরেকজন বলল, আমরা বলব, মুহাম্মদ একজন কবি। ওলিদ বলল, আমি আরবের শ্রেষ্ঠ কবি। কবিতার সব রকম ছন্দ আমার জানা আছে। মুহাম্মদের কথা কখনোই কবিতা হতে পারে না। কবিরা অনেক অবাস্তব এবং অশ্লীল কথা বলে থাকে। কিন্তু মুহাম্মদের কথায় চরম বাস্তবতা এবং পবিত্রতা ছাড়া আর কিছুই দেখি না। আরেকজন বলল, আমরা কী বলব মুহাম্মদ একজন মিথ্যাবাদী? ওলিদ বলল, তোমরা কি মুহাম্মদকে কখনো মিথ্যা বলতে শুনেছ? তোমরা তো তাঁকে আলআমিন বলেই জান। তাহলে আমরা বলব, মুহাম্মদ জাদুকর। ওলিদ বলল, মুহাম্মদ জাদুকরদের মতো গিঁট দেয় না, ঝারফুঁকও করে না। তোমরা বরং আমাকে চিন্তা করতে দাও।

এ ঘটনার অল্প কয়েক দিন আগে ওলিদ রসুল (সা.)-এর কাছে গিয়েছিলেন। রসুল (সা.) তাকে সূরা মু’মিন-এর প্রথম দুটি আয়াত শুনিয়ে ছিলেন। ওলিদ কোরআন শুনে খুবই চমত্কৃত এবং মুগ্ধ হন। পবিত্র কোরআন সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করে এবার ওলিদ বলল, ‘আল্লাহর শপথ! আমি মুহাম্মদের মুখে এমন বাণী শুনেছি, যা কোনো মানুষ কিংবা জিনের বাণী নয়। সে বাণী এত হূদয়স্পর্শী, যেন ফুল-ফল ভরা কোনো অবাক বৃক্ষ। এর শেকড় মাটির গভীরে প্রোথিত। এ বাণী কখনো পরাভূত হবে না। এর বিজয় সুনিশ্চিত। তোমরা এর বিরুদ্ধে যে কথাই বল না কেন, এর প্রচার-প্রসার, বিজয় রুখতে পারবে না। তোমরা বল এটা জাদু। এটা পিতাকে পুত্রের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেয়। ভাইকে ভাইয়ের শত্রু বানিয়ে দেয়। মানুষকে তার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।’ আল্লাহতায়ালা ওলিদের অন্যায় এ মতামতের জবাবে সূরা মুদ্দাসিরের ৮টি আয়াত (১৮-২৫) নাজিল করে দিলেন।

আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে কাফেররা খুব ভালো করে বুঝে ছিল, কোরআন নিছক কোনো ধর্মগ্রন্থ নয়। কোরআন একটি বৈপ্লবিক গ্রন্থ। সমাজ, সংস্কৃতি এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান বদলে দিতে পারে কোরআন। বিশ্বকে পাল্টে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে কোরআন। তাই তারা সর্বশক্তি দিয়ে কোরআনকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছিল।  কিন্তু তারা সফল হয়নি। আর কোনো দিন হবেও না।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসিসরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

     www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর