সোমবার, ২১ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা
আইন-আদালত

ধর্ষিতা ধর্ষণকারী এবং কিছু কথা

অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম সরকার

বাংলাদেশে ধর্ষণসংক্রান্ত খবর প্রায়শই পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে। সম্প্রতি (১৬.০৩.১৬) নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জে একটি রোমহর্ষ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এ ধর্ষণের ঘটনাই প্রমাণ করে আমাদের মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি কতটা নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। ধর্ষিতা একজন মাদ্রাসা ছাত্রী, প্রতিদিনকার মতোই মাদ্রাসা থেকে বাড়ি ফেরার জন্য পিকআপ ভ্যানে উঠে। পিকআপ ভ্যান চালক মারুকুল ইসলাম রক্ষক হয়ে যে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে সে কথা জানলে হয়তো কিশোরী মেয়েটির আজ এই নির্মম পরিণতি ভোগ করতে হতো না। ইতিমধ্যে মামলা হয়েছে, ভিকটিমের জবানবন্দিও রেকর্ড হয়েছে। মামলার অভিযুক্ত মূল আসামিও গ্রেফতার হয়েছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ গুরুত্বপূর্ণ অপরাধগুলো নিয়ে আর আলোচনা হয় না। ধর্ষণ কারও কাছেই কাম্য নয়, তথাপিও ধর্ষণ সংঘটন হচ্ছে। যারা ধর্ষিত হয়, তাদের অধিকাংশই মেয়েশিশু, কিশোরী। বিশ্বের ইতিহাস বলছে, ধর্ষণের একটি কুিসত নিদর্শন টলিয়ে দিয়েছিল রোমান সাম্রাজ্য পৌরণিক কাহিনীতে কুটিল, নিষ্ঠুর দেবতার ষড়যন্ত্রে ধর্ষিত হয়েছিল নিরীহ এক মেয়ে। সে সব গল্প আজও জীবন্ত হয়ে আছে অসংখ্য অবিস্মরণীয় ছবি, ভাস্কর্যে। ৫০৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নিষ্ঠুর রোমান রাজা তরকুইনের ছেলে সেক্সটাস তারকুইন ধর্ষণ করে লুক্রেশিয়াকে। সুন্দরী লুক্রেশিয়া বা লুক্রিস ছিলেন সম্ভ্রান্ত কোলাতিনুসের স্ত্রী। লুক্রেশিয়া এই আঘাত সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। কিন্তু এ ঘটনাটি হারিয়ে যায়নি আরও অসংখ্য ধর্ষণ-পাঁকের ভিড়ে। লুক্রেশিয়ার মৃতদেহ নিয়ে রাজদরবার বা রোমা ফোরামের সামনে রীতিমতো প্যারেড করে রাজার ভাগ্নে লুসিয়ার ব্রুটাস। রাজ পরিবারের কারসাজিতে যা হতে পারত জল, সেটাই যেন আগুন হয়ে জ্বলে উঠল এই নির্মম ঘটনার পর। রোমের সাধারণ মানুষ ক্ষেপে উঠল তারকুইনদের বিরুদ্ধে। তারকুইনকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং পরে একে হত্যাও করা হয়। এই ঘটনার পরও আগুন নিভে যেতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। একটি নৃশংস ধর্ষণের ঘটনা বদলে দিল পুরো ইতিহাস। লুক্রেশিয়া মৃত্যুর পর ছড়িয়ে পড়ল প্রতিবাদের ঝড়। রাজার সিংহাসন উল্টে গেল, প্রতিষ্ঠিত হলো রোমান প্রজাতন্ত্র। উইলিয়াম শেকসপিয়র এ ঘটনা নিয়েই লিখলেন দীর্ঘ কবিতা ‘দ্য রেপ অব লুক্রিস’।

এবার ফিরে তাকানো যাক আরও পেছনে। কোনো ঐতিহাসিক দলিল নেই এ ঘটনার। কিন্তু অলিসম্পয়া পর্বতের কোনো গল্পই আজ আর লুকিয়ে নেই মানুষের কাছ থেকে। তেমনই এক কাহিনী ‘ইউরোপার বলাত্কার’। এখানে জাদুর প্রভাব এবং বিস্তারের উপস্থিতি আধুনিক সময়ের চোখে হাস্যকর, কিন্তু বাকি কাঠামো এক নির্জন স্থানে নিয়ে যাওয়া, মুখোশের আবরণ সরে গিয়ে হিংস্র পাশবিক সত্তা বেরিয়ে পড়া, সব কিছুই প্রায় অপরিবর্তিত। গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী, দেবরাজ জিউস ইউরোপাকে দেখামাত্রই তার প্রেমে উন্মত্ত হয়ে যায়। যে কারণে ধর্ষণ ক্ষমার অযোগ্য, ঠিক সেই পথটাই বেছে নেয় জিউস। ঠাণ্ডা মাথায় সে নিজেকে বদলে ফেলে শান্ত, নিরীহ এক ‘ষাঁড়ে’। ইউরোপা তখন তার সখীদের সঙ্গে ফুল কুড়াচ্ছিল। ষাঁড়টিকে দেখেই সে এগিয়ে যায় তার দিকে এবং অবশেষে পিঠে চেপে বসে। এরই অপেক্ষায় ছিল জিউস। ইউরোপাকে নিয়ে সে নদী সাঁতরে ওঠে ক্রিট দ্বীপে, খসে যায় ষাঁড়ের-মুখোশ এবং অতঃপর ইচ্ছের বিরুদ্ধে অনিবার্যভাবে অমোঘ পরিণতি! ইতিহাস পুরাণ থেকে এবার নেমে আসুন এই পৃথিবীর মাটিতে। আধুনিক প্রগতিশীল পৃথিবীর কোথাও না কোথাও প্রতিদিন ধর্ষণের উল্লাস মাটি থেকে আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের দেশও সেই বৃত্তের বাইরে নয়। তাই ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইন পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রণয়ন করা হয়েছে নতুন আইনি কাঠামো। কিন্তু তাতেও তেমন কোনো লাভ হচ্ছে না। ধর্ষণের বিষয়ে মিথ্যে মামলা যেমন হচ্ছে ঠিক তেমনি অনেক ধর্ষণের সত্য ঘটনা আদালতের কাছে পৌঁছানোর আগেই চাপা পড়ে যাচ্ছে। ফলে প্রকৃত ধর্ষকরা পার পেয়ে যাচ্ছে। আমাদের উচিত ধর্ষণকারীদের সামাজিক ও পারিবারিকভাবে বয়কট করা। ধর্ষকরা ক্ষমার অযোগ্য, তাই তাদের প্রাপ্য শাস্তি পেতেই হবে এবং সে শাস্তি হবে কঠিন। যারা প্রকৃত ধর্ষক তাদের কারাদণ্ড কমিয়ে দেওয়া বা জামিনে মুক্তি পাওয়া, এমনটা আর কোনো মতেই চলবে না। এটাই সবার প্রত্যাশা। এ প্রসঙ্গেও শেকসপিয়রের একটি নাটকের কথা মনে পড়ে যায়। দৃশ্যপট, আদালত। এখানেও উপস্থিত এক বিচারপতি। তিনি বলেছেন ক্ষমতার কথা— [Mercy] is twice blest;/ It blesseth him that gives and him that takes. ‘দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস’ নাটকের পোর্শিয়ার এই সংলাপ অন্তত ধর্ষণের ক্ষেত্রে বড়ই বেমানান। ধর্ষকদের প্রতি নরম মনোভাব দেখানো মানে আরও ভয়াবহ কোনো অপরাধের (সেটা হতেই পারে ‘গ্যাং রেপ’ কিংবা ‘চাইল্ড অ্যাবিউজ’) আঁতুড়ঘর যত্ন নিয়ে স্বহস্তে তৈরি করা, এ রকমই মনে করেন ভারতের বিচারপতি সি কে ঠক্কর এবং বিচারপতি আলতামাস কবীর প্রমুখ। ভারতের মধ্যপ্রদেশে এক বিবাহিত মহিলাকে ধর্ষণ করার অপরাধে দুজনকে প্রাথমিক পর্যায়ে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হলেও পরে মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্টের এক বিচারপতি তাদের কারাদণ্ড দেন দুই মাস, তিন দিনের! এ হাস্যকর শাস্তি ধর্ষণকে উৎসাহিত করতে যথেষ্ট। ধর্ষণের মামলায় বিচারকদের আরও সংবেদী ও জেন্ডারবান্ধব হওয়া দরকার। ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজে যারা লিপ্ত হয়, তাদের কঠোরতম শাস্তি হোক।

আমরা আশা করব, ধর্ষণের ঘটনার সর্বশেষ সংযোজন (যখন লেখাটি লিখছিলাম) নীলফামারীর এই কিশোরী ছাত্রী পিকআপ ভ্যানের ড্রাইভার কর্তৃক যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে তার বিচার কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার মাধ্যমে অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা সম্ভব হবে। আর এ প্রক্রিয়ায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলে আমাদের সমাজের এসব মারাত্মক আদিম নোংরা প্রবণতা হ্রাস হবে অন্যথায় ধর্ষণের মিছিলে কিশোরী মেয়েদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তেই থাকবে।

লেখক : আইনজীবী এবং আইন বিষয়ক ছোট কাগজ ‘পঞ্চায়েত’-এর সম্পাদক।

     ই-মেইল : [email protected]

 

সর্বশেষ খবর