বুধবার, ১১ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্য করতে বিএনপির টার্গেট জয়

মুসা সাদিক

বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্য করতে বিএনপির টার্গেট জয়

বঙ্গবন্ধু দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে হত্যার ষড়যন্ত্র করে বিএনপি ফেঁসে গেছে। বেগম জিয়ার এক উপদেষ্টা এখন জেল হাজতে। ১৯৯১ সালেও বিএনপি জয়কে হত্যার টার্গেট করেছিল। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর দেশবাসী ও বাংলাদেশের সিভিল-আর্মি প্রশাসন ধরেই নিয়েছিল যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হতে যাচ্ছে।  কিন্তু আরব বিশ্বের অর্থানুকূল্য এবং ১৯৭১-এ বাংলাদেশের জন্মলগ্নে বিরোধিতাকারী বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর একটি দেশের গোপন ভূমিকায় ও তত্পরতায় বাংলাদেশের ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক কেন্দ্রগুলো বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়ে।

এরশাদের পতনের পর আওয়ামী লীগের দিকে দেশব্যাপী গণজোয়ার দেখে শেখ হাসিনা তার পান্থপথের সর্বশেষ সভায় ভাবী প্রধানমন্ত্রীর ভাবগাম্ভীর্যে তার বক্তব্য শেষ করেন। সারল্য রেখার শেখ হাসিনা তখনো অনুমান করতে পারেননি যে, বহিঃশক্তি ততক্ষণে তার দলের অভ্যন্তরেও অনুপ্রবেশ করেছে। বঙ্গভবনে বসে আমি নিজেও তা জেনে তাজ্জব বনে গেলাম।

১৯৯১ সালের ইলেকশনের ৩ দিন আগে অর্থাৎ ২৫ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সের বিখ্যাত লে মঁদে পত্রিকার সাংবাদিক শেরাটন হোটেলে আমাকে বলেন যে, ‘বেগম জিয়া প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন।’ বিবিসির সিরাজুর রহমানও আমাকে একই কথা বলেন তার শেরাটন হোটেলের কক্ষে বসে। আমি তত্ক্ষণাৎ নেত্রীর পিএস এবং পিআরও-কে সেখানে ডেকে পাঠালাম। তাদের সামনেও তিনি একই তথ্য প্রকাশ করেন এবং এক বোমা ফাটিয়ে বলেন ‘তার দলের (Pro-American) নেতারাও তো এ কথা জানেন। আপনাদের নেত্রী কি কিছুই জানেন না? আপনারা অবাক হচ্ছেন দেখে আমি এখন দ্বিগুণ অবাক হচ্ছি!’

ওই রাতে আমি নেত্রীর ড্রাইভার আলী হোসেনসহ (শহীদ নূর হোসেনের ভাই) নেত্রীর দেওয়া পাজেরো নিয়ে আমার অন্ধ অনুসারী দুজন মুক্তিযোদ্ধা অফিসার নিয়ে রাত ২টায় রেকিতে বেরুলাম। (সে সময় নেত্রী পুরনো পাজেরো তিনি আমাকে দিয়ে রাখেন আমার বিশ্বস্ত লোক দিয়ে তার কাজ করার জন্য। নাভানা তখন তাকে চারটি নতুন লাল টয়োটা জিপ দিয়ে দেয়। তার ওই পাজেরো সে সময় আমার বাসায় থাকত। তার ড্রাইভার আলী হোসেন সকালে এসে আমার কাছে রিপোর্ট করত এবং গভীর রাত পর্যন্ত ডিউটি করে যেত)। প্রথমে গেলাম নেত্রীর দুই সিট তেজগাঁও ও পুরান ঢাকার বাস্তব অবস্থা দেখতে। তেজগাঁওয়ে গিয়ে দেখলাম আওয়ামী লীগের টেন্টগুলো সব জনশূন্য। আর মেজর মান্নানের টেন্টগুলো জনসমাগমে গমগম করছে। পুরান ঢাকায় গিয়েও একই অবস্থা দেখলাম। নেত্রীর প্রতিদ্বন্দ্বী সাদেক হোসেন খোকার টেন্টে জৌলুস উপচে পড়ছে আর নেত্রীর টেন্টগুলোতে শ্মশানের নিস্তব্ধতা। নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। হঠাৎ হতবাক হয়ে গেলাম। আমরা তেজগাঁও ও পুরান ঢাকায় ভোর ৬টা পর্যন্ত আলী হোসেনের পাজেরো নিয়ে ঘুরলাম। ভোর ৬টায় নেত্রীকে ফোন দিয়ে বললাম : ‘ঢাকার ২ সিটে আপনি হেরে যেতে পারেন। কোথাও বড় ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা হচ্ছে।’ সব শুনে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, ‘তেজগাঁওয়ে আমার মেন এজেন্ট হুদাকে খুঁজে বের করুন। সে আমার সঙ্গে গত ৩-৪ দিন যোগাযোগ করেনি।’ নেত্রীর কথার সুরে বুঝে গেলাম লখিন্দরের ঘরে সাপ ঢুকে পড়েছে!

হুদা থাকত মগবাজার চৌরাস্তার পশ্চিম পাশের একটি তিনতলা বাড়িতে। কিন্তু নেত্রীর লোকেরা তাকে সেখানে বারবার গিয়েও খুঁজে পাচ্ছে না। তিনি আমাকে বললেন, ‘যে কোনো উপায়ে তাকে খুঁজে বের করে আমার সামনে হাজির করেন।’ আমি তখন এক প্রকার মরিয়া হয়ে তদানীন্তন এনএসআইয়ের ডিজি জামান সাহেবের শরণাপন্ন হলাম। তার সাহায্যে ১৯৯১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ নির্বাচনের এক দিন আগে হুদাকে তেজগাঁওয়ে মেজর মান্নানের একটি গোপন আস্তানায় খুঁজে পাওয়া যায় এবং নেত্রীর লোকদের কাছে তাকে হস্তান্তর করা হয়। নেত্রী তাকে এই বলে ছেড়ে দেন যে, তোর মতো বেইমান, বিশ্বাসঘাতক আমার দলে যেন আর কেউ না থাকে। তার গায়ে তিনি টোকাটি দিতে দেননি। যারা তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তারা হতাশ হয়ে পড়ে, আমিও হতাশ হয়ে পড়ি। কারণ, তাকে ধরতে কম খড়-কাঠ পোড়াতে হয়নি। পরে বুঝলাম, দয়ার সাগর বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকারী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শনেরও সর্বোত্তম উত্তরাধিকারী।

মার্চে বঙ্গভবনে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেগম জিয়া শপথ নেন। সেটাই বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির প্রথম সরকার। সরকার গঠন করেই তারা জয়কে প্রথম টার্গেট করে। প্রথম টার্গেটের ঘটনাস্থল আমার বাড়ির সামনে। আমি তখন থাকতাম সরকারি পরিত্যক্ত ভবন ৬৪, গুলশান এভিনিউর দোতলা বাড়িতে। নিচে থাকতেন পিএসসির সদস্য ব্রিগেডিয়ার ইসলাম। বেগম জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ক’দিন পরেই এক রাতে আমার বাড়ির সামনে একটি লাল টয়োটা জিপ প্রচণ্ড শব্দে উল্টে পড়ে। সেদিন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বড় ভাই অধ্যাপক আবু জাফরের বাসা থেকে রাত ১টায় ফিরি। তখনো আমি আমার ড্রেস চেঞ্জ করিনি। মনে হলো আমার বাড়ির গেটে কেউ বোম ব্লাস্ট করেছে। আমার শ্যালক ইসমাইলসহ আমি দৌড়ে গেলাম। গিয়ে দেখি আমার গেটের ঠিক সামনে বরাবর এভিনিউতে একটি লাল রঙের নতুন টয়োটা জিপ উল্টে পড়ে আছে। তাতে দুজন ছেলে ছিল। আমাদের চোখের সামনে আমার পাশের মিড টাউন হোটেলের দারোয়ান, হোটেলের সামনের পান-বিড়ির দোকানদাররা মিলে তাদের গাড়ি থেকে টেনে বের করে দেয়। আল্লাহর রহমতে তারা কেউ আহত হয়নি। কারণ, আমার বাড়ির সামনের একটা কিশোর বয়সী দেবদারু গাছের ওপর জিপটি ফুল স্পিডে আছড়ে পড়ে। গাছটি দুমড়ে স্প্রিংয়ের মতো বেঁকে যায়। ফলে গাড়িটি দোলা খেয়ে এভিনিউয়ের ওপর উল্টে পড়ে। গাছটি বয়সী হলে এক্সিডেন্টের রেজাল্ট ভয়াবহ হতে পারত। আমরা সবাই ধরাধরি করে গাড়িটি সোজা করে দিই। ততক্ষণে আমার পাশের সরকারি পরিত্যক্ত বাড়িতে বসবাসরত ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী লুত্ফর রহমান তার তিনজন পুলিশসহ জিপ গাড়িটির দিকে এগিয়ে আসেন। তাকে ধাবিত হয়ে আসতে দেখে আমি আমার শ্যালককে নিয়ে আমার গেটের ভিতরে চলে আসি। সে গাড়িটির কাছে জড়ো হওয়া লোকদের কাছে কিনা কি শুনে আমার গেট ধাক্কাতে থাকে। আমি দোতলা থেকে নেমে এলে লুত্ফর রহমান বলেন, ‘আমার বাড়িতে পুলিশ সার্চ করবে। জয় এ গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে এবং লোক মেরে ফেলেছে। এখন সে আপনার বাড়িতে লুকিয়ে আছে কি-না আমার পুলিশ সার্চ করে দেখবে।’ আমি লক্ষ্য করলাম যে, তিনি একজন প্রতিমন্ত্রী হয়ে আমার মেন গেট ধাক্কাচ্ছেন। তাকে একটা shock treatment দিতে হবে। তখন আমি আমার শ্যালককে বললাম, গেটের তালা খুলে ফেল। জটলাধারী লোকজনের সামনে এসে সোজা আমি তার দিকে আঙ্গুল উঠিয়ে বজ্র কণ্ঠে আওয়াজ তুলে তার পুলিশদের বললাম, “Arrest him. I am a Magistrate. I give you order. Arrest him and put handcuff. If you don’t arrest him, I will phone IG and I will ask IG to dismiss you and you will loose your job” (সে সময় আমি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে উপ-সচিব পদে কর্মরত ছিলাম এবং আমাকে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে magistracy powerদেওয়া ছিল। বিভিন্ন ম্যানপাওয়ার কোম্পানির মধ্যে লিখিত পারস্পরিক অভিযোগগুলো আমার কক্ষে দুই পক্ষের উকিলের সওয়াল-জবাবের মাধ্যমে বিচার করে আমাকে রায় দিতে হতো)। আমার হুমকিতে কাজ হয়। প্রতিমন্ত্রীও ভয় পেয়ে যান। তার সঙ্গে আসা পুলিশ তার হাত ধরে তাকে থামাচ্ছিল এবং বলছিল, ‘স্যার চলে আসেন। আমরা ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের হুকুম তামিল করতে বাধ্য। আপনি ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের বিরুদ্ধে কিছু বললে আমরা আপনার সঙ্গে থাকতে পারব না। আপনি কি আমাদের চাকরি খাবেন? এ সময় তার জার্মান স্ত্রী এসে তার হাত ধরে টানতে থাকেন এবং বলতে থাকেন, ‘Don’t do silly things here. He is a Magistrate. You shall have to honour him.’ আমি তার মিসেসের উদ্দেশে বললাম,‘Thank you German lady for your sense of civilization. Please lock him into your bedroom.’

পরদিন ডিসি, ডিবি আমাকে ফোন করলেন। রাতে আমার বাড়ির সামনে জয় এক্সিডেন্ট করেছে এবং মানুষ মেরে ফেলেছে বলে আমাকে জানাল এবং সে বিষয়ে আমার বক্তব্য রেকর্ড করার জন্য ডিবি অফিসে আমাকে যেতে বললেন এবং তদন্ত কাজে সহযোগিতা করার জন্য বললেন। আমি তাকে বললাম, ‘আমার বাড়ির সামনে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি এবং এমন কোনো ঘটনার বিষয়ে আমি কিছু দেখিনি বা আমি জানি না। আর আপনি যেতে বললে আমি যাব না। আপনি আমাকে চিঠি দেবেন।’ উত্তরে তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে বললেন, ‘আপনাকে আমার লোকেরা তুলে নিয়ে আসবে।’ আমি তাকে সতর্ক করে বললাম, ’৭১-এ শহীদী দরজা থেকে আমি ফিরে এসেছি। তাজউদ্দীন স্যার সে ঘটনা উল্লেখ করে লিখে রেখে গেছেন : ‘কেয়ামত পর্যন্ত আমার কাছে এ জাতির ঋণ এ মাটির ওপর লেখা থাকবে।’ আর আপনার সাহস এত বড় যে, আপনি আমাকে তুলে নেওয়ার কথা বলেন। আমি বিসিএস মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের মহাসচিব। আমাকে তুলে নিলে আপনার ডিবি অফিসের মিন্টু রোডে গিয়ে শহীদ পরিবার ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা গায়ে অগ্নিসংযোগ করে আত্মাহুতি দেবে। পারবেন আপনি তাদের মোকাবিলা করতে? আমার হুঙ্কারে কাজ হয়। আমাকে বাদ দিয়ে তারা আমার শ্যালক ইসমাইলকে ৬৪, গুলশান এভিনিউ বাসা থেকে নিয়ে যায়। আমি তাকে ঠিকমতো ব্রিফ করে দিই। ঘটনার সময় আমার সঙ্গে সে যা দেখেছে, ডিবির লোকদের সে কথাই বলে। নেত্রী সব ঘটনা জানার পর আমার শ্যালককে তার কাছে পাঠাতে বলেন। তিনি তার কাছ থেকে সব শুনে বিস্মিত হয়ে পড়েন এবং বলেন, ‘তারা কি এখন জয়কে টার্গেট করেছে?’

তার অনুমান পুরোপুরি সত্য ছিল। ডিবি আমাকে দলে ভিড়াতে ব্যর্থ হলে বেগম জিয়া তার ছেলে তারেকের ব্যবসায়ী অংশীদার মামুনের ভাই, যিনি ভোলায় জাল ভোট করে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের নায়ক তোফায়েল আহমেদকে পরাজিত করে এমপি হয়েছিলেন, সেই হাফিজ ইব্রাহিমকে আমার অফিসে পাঠান। তিনি আমার পূর্ব পরিচিত ছিলেন। তিনি আমাকে ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেক কথা বলে আমার কাছে প্রস্তাব দিয়ে বলেন, ‘আপনাকে বেগম জিয়া ডবল প্রমোশন দিয়ে উপ-সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব করবেন এবং যে কোনো মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব করবেন। আপনার বাড়ির সামনে জয় মদ খেয়ে গাড়ি চালিয়ে এক্সিডেন্ট করেছে এবং দুজন লোক মেরে ফেলেছে বলে পুলিশ কেস সাজিয়েছে। আপনি শুধু সাক্ষী দেবেন। একবার মাত্র সাক্ষী দেবেন।’ আমি তাকে বললাম, ‘জয় তো কোনো নেতা না, একজন ছাত্র। তাকে কেন টার্গেট করছেন?’ সে ঝটিকা উত্তর দিল, ‘জয়ের মাথায় বাড়ি পড়লে, হাসিনার মাথায় বাড়ি পড়বে।’ তার প্রস্তাব শুনে আমি তাকে বুঝিয়ে বলি যে, ‘আমি একজন শিক্ষক ও ইমামের সন্তান। আমাকে মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী করলেও আমি এ ধরনের জ্বলজ্যান্ত মিথ্যা কথা বলতে পারব না। আমাকে টেবিলে তুলে কুচি কুচি করে কেটে ফেলতে পারেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু দৌহিত্রের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রে আপনি কেন, রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীও আমাকে লিপ্ত করতে পারবে না। কোনো লোভ-লালসা দিয়ে আমাকে কেউ কখনো কোনো বশ করতে পারবে না, অতীতেও কেউ পারেনি।’ তাকে হতাশ হয়ে ফিরে যেত হলো।

পুনরায় বিএনপির ২০০১ সালে সরকার গঠনের পর বিমানবন্দরে ভিআইপিতে তার সঙ্গে আবার আমার দেখা হয়ে যায়। তিনি তখন তার এয়ার হোস্টেস স্ত্রী ও একমাত্র পুত্র সন্তানকে নিয়ে আমেরিকায় যাচ্ছিলেন সেখানে স্কুলে ভর্তি করাতে। আমাকে দেখে বলে উঠলেন, ‘স্যার, আমার কথা শুনলে এতদিনে আপনি সিনিয়র সচিব হয়ে থাকতেন...।’ আমি তীক্ষ উত্তরে বললাম, ‘কিন্তু আপনাদের কথা শুনলে আমি মীরজাফর হয়ে থাকতাম। নবাব আলিবর্দি খানের দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করে বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যার স্বাধীনতা ২০০ বছর অস্তমিত হয়ে গিয়েছিল। আপনারা বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্রকে হত্যা করে বাঙালি জাতির হাতে-পায়ে ২০০ বছর পাক সেনাদের গোলামির জিঞ্জির পরিয়ে দিতেন।’ হাফিজ ইব্রাহিম কিছুটা বিব্রত ও ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, ‘স্যার, আপনি কি আমাদের বিশ্বাস করে উঠতে পারেন না? আমার ভাই মামুন আর তারেক হাওয়া ভবন থেকে রাষ্ট্র চালায়। আপনার সচিবালয়ের সচিবরা তাদের ডিক্টেশনে চলে। তাদের সামনে এসে করজোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আর আপনি বিশ্বাস করতে পারেন না যে, আপনার জন্য আমরা miracle করে দিতে পারি।’ আমি তার স্ত্রী ও পুত্রের সামনে বললাম, ‘আপনারা শুনে রাখুন, আল্লাহর miracle-এ ’৭১ সালে আমি শহীদী দরজা থেকে ফিরে এসেছি। পাক সেনারা আমাকে মেরে ৮ নম্বর সেক্টরের চাঁচড়ায় লাশের স্তূপে ফেলে রেখে গিয়েছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন হুদা সেই লাশের স্তূপ থেকে জীবন্মৃত ও মুমূর্ষু অবস্থায় আমাকে উদ্ধার করে আনেন বলে আজও আমি বেঁচে আছি। আমি আল্লাহকে বিশ্বাস করি। তাওয়াক্কুলতু আল্লাহ।

সে আমাকে বলল, ‘হারিছ চৌধুরী আপনাকে ফোন করেনি? আপনি তার কথাও তো শোনেন না। তার কথা মানে বেগম জিয়ার কথা। আপনি কি তাকেও বিশ্বাস করেন না?’ মাথা নাড়িয়ে আমি বললাম, ‘হারিছ চৌধুরী, বেগম জিয়া, কামাল সিদ্দিকী, হাওয়া ভবন মিলে ১৬৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও কর্মচারীকে যারা জবাই করে দিয়েছে, তাদের বাংলাদেশের কোনো একটি মুক্তিযোদ্ধাও বিশ্বাস করে না।’

হাফিজ ইব্রাহিম এই বলে পুত্রসহ সস্ত্রীক ভিআইপি থেকে প্লেনের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন : ‘আপনি ভুলে যান যে শেখ হাসিনা আর কোনো দিন ক্ষমতায় আসবে আর তার রাজতন্ত্রের সিঁড়ি বেয়ে জয় ক্ষমতাসীন হবে। তবে জয়ের কেচ্ছা যেদিন ফাঁস হবে সেদিন আমরা তাকে লটকাব।’ (১৯৯১ সালে জয়কে কয়েক ঘণ্টার জন্য হলেও জেলে নিতে পারলে কয়েদি বিদ্রোহ ঘটিয়ে তাকে হত্যা করে ফেলত)। সুদূর আমেরিকায় জয়কে অপহরণ ও হত্যা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে বাংলাদেশের দুজন সম্পাদকের প্রত্যক্ষ যোগসাজশের মুহূর্তে ফ্লাশব্যাকে ভেসে উঠল ১৯৯১ ও ২০০২ সালের ঘটনা দুটি। জয়কে টার্গেট করতে ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির পূর্বাপর কার্যক্রম এ সত্যকে দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর চোখের সামনে সূর্যের মতো প্রতিভাত করে তোলে।

মহাত্মা গান্ধী হত্যা, প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন হত্যা, বঙ্গবন্ধু হত্যা, ইন্দিরা গান্ধী হত্যা, ঢাকার কারাগারে বাঙালির জাতীয় চার নেতা হত্যা এসব জাতিগুলোকে এবং সমগ্র মানব জাতিকে বহু বহু বছর পিছিয়ে দিয়েছে। তার সর্বোত্তম প্রমাণ হচ্ছে এ মুহূর্তে বাংলাদেশের বাৎসরিক প্রবৃদ্ধির হার ৭%। যেখানে গণচীনের ৬.৩% এবং ভারতে ৬.৪%। এশিয়ার দেশগুলো তো বটেই, ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোর নেতারা বাংলাদেশের দিকে পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার দৃষ্টি মেলে তাকাচ্ছে এবং বিস্ময় মিশ্রিত অভিনন্দন জানাচ্ছে।  কিন্তু খোদা নাখাস্তা, ২১ আগস্ট যদি খুনিরা জাতির জনকের কন্যাকে গ্রেনেডবৃষ্টিতে হত্যা করতে পারত, তাহলে বাংলাদেশ এই বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করতে পারত না এবং কয়েক যুগ পিছিয়ে পড়ত।

লেখক : স্বাধীন বাংলা বেতারের ওয়ার করেসপন্ডেন্ট এবং সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার।

ই-মেইল : [email protected],

web: www.musabd.com

সর্বশেষ খবর