বুধবার, ১১ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

জোছনার আলো মায়ের হাসি

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

জোছনার আলো মায়ের হাসি

জোছনা যেভাবে ছড়িয়ে দেয় মন ভোলানো আলো। যে কারও মাও তার হৃদয়ে তেমনি আলো ছড়িয়ে দেন। জোছনার আলো এবং মায়ের হাসি যেন একই বৃন্তের দুটি ফুল। যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন জোছনা ছড়ানো মায়ের হাসি থাকবে। যে জোছনা ভালোবাসে, সে তার মাকেও ভালোবাসে।

মায়ের ভালোবাসায় বেড়ে ওঠে পৃথিবী। জীবজগৎ সবখানেই মায়ের ভালোবাসা অনন্য। দয়াময় আল্লাহ দয়ার নুমনাস্বরূপ মাকে সৃষ্টি করেছেন। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা ‘দয়া’ সৃষ্টি করে নিরানব্বই ভাগ নিজের কাছে রাখলেন। আর একভাগ সৃষ্টিকুলে ছড়িয়ে দিলেন। ওই একভাগের অর্ধেক মায়ের মধ্যে রেখে দিলেন। আর এ কারণেই সন্তানের প্রতি মায়ের এত ভালোবাসা।’ বাবা-মার প্রতি রহমতের ডানা বিছিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আপনার প্রতিপালক ফায়সালা করে দিয়েছেন যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারও ইবাদত করবে না এবং মা-বাবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে।’ (সূরা বনী ইসরায়েল : ২৩।) ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি কর, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করিও না, মা-বাবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার কর।’ (সূরা আন-নিসা : ৩৬।) এ নির্দেশ পূর্ববর্তী জাতির শরিয়তেও ছিল। আল্লাহ বলেন, ‘আমি বনী ইসরায়েল থেকে অঙ্গীকার নিয়েছি, তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারও উপাসনা করবে না এবং মা-বাবার সঙ্গে ভালো আচরণ করবে।’ (সূরা আল-বাকারা : ৮৩।)

হাদিসে রসুলেও মায়ের মর্যাদা সবার ওপরে স্থান দেওয়া হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রসুল (সা.)কে জিজ্ঞাসা করলেন, এই পৃথিবীতে আমার কাছে ভালো ব্যবহার পাওয়ার সবচেয়ে বেশি অধিকার কার? রসুল (সা.) বললেন, তোমার মায়ের। তারপর কার? রসুল (সা.) বললেন, তোমার মায়ের। এভাবে তিনবার বললেন। আল-আদাবুল মুফরাদের বর্ণনায় পাঁচবার মায়ের কথা বলে ষষ্ঠবারে বাবার কথা বললেন। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) বলেন, আমি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম, কোন আমল আল্লাহর কাছে প্রিয়? রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সময়মতো নামাজ আদায় করা। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম, এরপর কোন আমল? তিনি বললেন, মা-বাবার সঙ্গে সুন্দর আচরণ করা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তারপর কী? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। (বুখারি) আরেকটি হাদিস থেকে জানা যায়, মায়ের সেবা জিহাদের চেয়েও ভালো। মুয়াবিয়া (রা.) বলেন, আমি রসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এসে বললাম, হে আল্লাহর রসুল! আমি জিহাদে যেতে চাই। তিনি বললেন, আফসোস তোমার জন্য! তোমার মা কি বেঁচে আছেন? আমি বললাম, হ্যাঁ, বেঁচে আছেন। তিনি বললেন যাও, তার সেবা কর। এরপর আমি অন্যদিক থেকে এসে একই কথা বললাম। তিনি বললেন, আফসোস তোমার জন্য! তোমার মা কি বেঁচে নেই? আমি বললাম হ্যাঁ, বেঁচে আছেন। তিনি বললেন যাও, তার সেবা কর। অতঃপর আমি তাঁর সামনের দিক দিয়ে এসে আবার বললাম, হে আল্লাহর রসুল! আমি জিহাদ করতে চাই। তিনি বললেন, আফসোস তোমার জন্য! তোমার মা কি বেঁচে নেই? আমি বললাম, ইয়া রসুলুল্লাহ! আমার মা বেঁচে আছেন। তিনি আমাকে বললেন, তুমি তোমার মায়ের পা আঁকড়ে ধর। সেখানেই রয়েছে জান্নাত। (ইবনে মাজাহ।) মায়ের সেবার সর্বোচ্চ পুরস্কার আল্লাহতায়ালা বান্দাকে প্রশান্তিময় জান্নাত দান করবেন। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মেরাজের রাতে আমি জান্নাতে প্রবেশ করলাম, অতঃপর সেখানে কোরআন তিলাওয়াত শুনতে পেলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, এই ব্যক্তি কে? ফেরেশতারা বললেন, হারিসা ইবন নুমান (রা.)। রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, সে ছিল তার মায়ের সঙ্গে ভালো ব্যবহারকারী। (আল মুস্তাদরাক)

বিশ্বজুড়ে আজ মায়েরা অবহেলিত। সারাটি জীবন শত কষ্ট সহ্য করে, বৈরী আবহাওয়ার সঙ্গে লড়াই করে শুধু সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে বেঁচে থাকেন মা। আর সেই সন্তানরা মা-বাবার সঙ্গে রূঢ় আচরণ করে। একটু বয়স হলেই মা-বাবাকে ‘ওল্ড ম্যান হাউস’ তথা বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে। আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রম তেমন জনপ্রিয় না হলেও ইউরোপ-আমেরিকায় এটা খুবই জনপ্রিয়। বৃদ্ধাশ্রমে থাকা মায়েদের খোঁজখবর নেয় না সন্তানরা। তাই বিশেষজ্ঞরা চিন্তা করে বছরের একটি দিন বিশ্ব মা দিবস পালন করার উদ্যোগ নেন। যেন সন্তান মায়ের জন্য একটি দিন উৎসর্গ করে। ওই দিন তারা মার জন্য ভালো খাবার নিয়ে যায় এবং নানাভাবে মাতৃসেবা করে থাকে। আমাদের দেশেও আজ অভিশপ্ত বৃদ্ধাশ্রম বেড়ে চলছে। এটি আমাদের জন্য অশনী সংকেত। ধর্ম আমাদের শিক্ষা দেয়, মায়ের জন্য কোনো দিবস নয় বরং জীবন উৎসর্গ কর। বিশ্ব মা দিবসে প্রতিটি সন্তানের কাছে ধর্মের এ উদাত্ত আহ্বান রাখছি।

হে প্রেমময় যুবক-যুবতীর দল। আসুন আমরা শপথ করি জীবনে যত কষ্টই আসুক আমরা বাবা-মাকে আদর-যত্নে আমাদের ঘরেই রাখব। কেননা মা যে আমাদের জান্নাত। জান্নাতকে কেউ কি বৃদ্ধাশ্রমে ঠেলে দেয়। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

সর্বশেষ খবর