বৃহস্পতিবার, ১৬ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

আজাদকে ওরা বাঁচতে দিল না

নঈম নিজাম

আজাদকে ওরা বাঁচতে দিল না

আজাদের বাড়ি জয়পুরহাটে। মাস তিনেক আগে আমাকে ফোন দেন। বললেন, ভাই আমি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছি। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছি। পেয়ে যাব। আমি বললাম, আমার বাড়ি কুমিল্লায়। আমাকে ফোন করলেন কেন? জয়পুরহাটে আমার কী কাজ? আজাদের সাফ জবাব আপনি আমাকে চেনেন। ১৯৯০ সালে দেশবাংলা পত্রিকায় ফটোসাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছি। এই পত্রিকায় আপনি তখন কিছুদিন ছিলেন। জবাব দিলাম, এত বছর পর মনে নেই। ফোন কেটে দিলাম। আবার কিছুদিন পর আজাদের ফোন, ভাই মনোনয়ন পাইনি। কিন্তু এলাকার মানুষের অনুরোধে ভোট করছি। আপনি দোয়া করবেন। এলাকার মানুষ আমার পক্ষে। প্রশাসন বিপক্ষে। তাতেও সমস্যা নেই। কারণ মানুষের জোয়ারের কাছে ভোট চুরি সম্ভব নয়। ফোন করলাম, জয়পুরহাট প্রতিনিধি মাজেদকে। আজাদের  দিকে খেয়াল রাখতে বললাম।  ভোটের পর আবার আজাদের ফোন। বললেন, ভাই আমি জয়ী হয়েছি। কিন্তু ভালো নেই। সন্ত্রাসীরা নির্বাচনে হেরে আমার বিরুদ্ধে কাজ করছে। পুলিশ প্রশাসন সন্ত্রাসীদের পক্ষে। যারা আমাকে মনোনয়ন দেয়নি তারাও সন্ত্রাসীদের পক্ষে। প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে ক্লান্ত। আমার জন্য দোয়া করবেন। সেই আজাদ আর নেই। তার আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করে আজাদ চলে গেলেন। সন্ত্রাসীরা তাকে কিছুদিন আগে কুপিয়ে আহত করে। নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসেবে পুলিশ তার পাশে দাঁড়ায়নি। আহত আজাদকে ঢাকায় আনা হয়। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত পরাস্ত হলেন। এভাবে তার চলে যাওয়ার কথা ছিল না। মৃত্যুকে তার আলিঙ্গনের কথা না। তবুও যেতে হলো। সন্ত্রাসীরা তাকে বাঁচতে দিল না। আজাদের মৃত্যু আইনের শাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। পুলিশের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ পুলিশ। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আজাদ অভিযোগ করেছিলেন পুলিশের কাছে। নির্বাচন কমিশনে। তারপরও কেউ তার পাশে দাঁড়ায়নি।

হিংসা, প্রতিহিংসার রাজনীতি দীর্ঘদিনের। কিন্তু স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এবারের মতো নিষ্ঠুর মৃত্যুর মিছিল আগে দেখিনি। আমার পরিবারেও স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি ছিলেন। চেয়ারম্যান ছিলেন। মেম্বার ছিলেন। একই বাড়িতে একই সময়ে চেয়ারম্যান আর মেম্বার। কোনো সমস্যা ছিল না। আগে নির্বাচন হতো। ভোট কারচুপিও হতো। কিন্তু এতো খুনোখুনি হতো না।  ভোটের নামে খুনের মিছিল এবারই ভয়াবহ। আমাদের এই নির্বাচনী সংস্কৃতি থেকে বের হতে হবে। একটা ভালো পরিবেশ আমরা দেখতে চাই। স্থানীয় সরকারকে নিয়ে এত ঝামেলার দরকার ছিল না। বিদ্রোহী কিংবা অন্য দলের প্রার্থী অধিক জয়ী হলে কী যেত-আসত? সরকার তার অবস্থানেই থাকত। মানুষের এখন সবচেয়ে বড় চাওয়া আইনের শাসন। রাষ্ট্র ব্যক্তি গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি থাকতে পারে না। পরমতের প্রতি সহনশীল হতে হবে। চিন্তার স্বাধীনতা দিতে হবে। সরকার সতর্ক না হলে দেশ-বিদেশে ভুল বার্তা যাবে। কিছুদিন আগে সিঙ্গাপুর গিয়েছিলাম নিউজটোয়েন্টিফোরের কাজে। পথ চলতে এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের বাংলাদেশ ভাবনায় বিস্মিত হলাম। ট্যাক্সিতে বসে হঠাৎ খেয়াল করলাম, ড্রাইভার আমার দিকে তাকাচ্ছেন লুকিং গ্লাস দিয়ে। একপর্যায়ে প্রশ্ন করলেন, তোমার বাড়ি কোথায়? বললাম, বাংলাদেশ। ট্যাক্সি ড্রাইভার আবার বললেন, গাজীপুর?  না ঢাকা। তুমি গাজীপুরের নাম কী করে জান? ড্রাইভার বললেন, আমার কিছু প্রতিবেশী আছে, ওদের বাড়ি গাজীপুর। ওরা হাসিনাকে পছন্দ করে না। বলছে, তিনি আয়রন লেডি। তোমার দেশে গণতন্ত্র নেই। ভোট নেই। সিঙ্গাপুরে সিমলিম স্কয়ার মার্কেট থেকে মোস্তফা সেন্টার খুবই কাছে। হাঁটলে ১৫-২০ মিনিট। আমি নিলাম ট্যাক্সি। এর মাঝে কথা হচ্ছে। বললাম, তোমার দেশের কথা বল? তোমাদের সবকিছু ঠিক আছে তো। ড্রাইভার হাসলেন। বললেন, তোমার প্রশ্ন বুঝতে পেরেছি। সিঙ্গাপুর উন্নত দেশ। আমি বললাম, তোমরা একদিন উন্নত ছিলে না। সন্তোসা আইল্যান্ডে তোমাদের পঞ্চাশ ও ষাট দশকের চিত্র আমি দেখেছি। মালয়েশিয়া তোমাদের ছেড়ে দিয়েছিল তোমাদের ভয়াবহ খারাপ অর্থনীতির কারণে। মালয়েশিয়া নিজ থেকে সিঙ্গাপুরকে ত্যাগ করার পর লি কুইয়ানি স্বাধীনতার পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে চোখের জল মুছেছিলেন বারবার।  অশ্রু চোখে বারবার বলছিলেন, ওরা আমাদের ছেড়ে দিল? সেই সিঙ্গাপুর কীভাবে আজকের বিশাল অবস্থানে তা তুমিও জান, আমিও জানি। একটি দেশকে এগিয়ে নিতে একজন সাহসী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন হয়। কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়ন উদাহরণ সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়ার। ট্যাক্সি ড্রাইভার হাসলেন। বললেন, আমি ওদের কাছে যা শুনেছি তাই তোমাকে বললাম। এবার আমি তার কাছে জানতে চাই সিঙ্গাপুরে সম্প্রতি জঙ্গিবাদের দায়ে আটক বাংলাদেশিদের নিয়ে। ড্রাইভার বললেন, এক সময় তিনিও আটক হয়েছিলেন। অভিযোগ ছিল কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে গোপন সম্পর্ক। আসলে তিনি মাও সেতুং, লেনিন, মার্কসের কিছু বই নিয়েছিলেন পড়তে। পুলিশ ভাবল এত কিছু থাকতে কমিউনিস্ট বই কেন পড়তে হবে। ষাটের দশকে আমাদের দেশেও লেনিন, মার্কস পড়া মানে কমিউনিস্ট পার্টি করা। সিঙ্গাপুরে আটকদের নিয়ে ভাবতে হবে। চিন্তা করতে হবে। বাংলাদেশ দূতাবাসকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে সবকিছুর ওপর। বাংলাদেশের জনশক্তিকে ঘিরে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত কিনা তাও দেখতে হবে।

রাজনীতি এক জটিল অঙ্ক। আর এই অঙ্ক শুধু দেশে নয় বিদেশেও। বাংলাদেশ পার করছে এক কঠিন সময়। রাষ্ট্র ও সমাজের নীরব রক্তক্ষরণ চোখে দেখা যায় না। অনেকটা মানুষের হৃদয়ের মতো। হেঁটে চলা মানুষ হঠাৎ হৃদক্রিয়া বন্ধে স্তব্ধ হয়ে যান। সমস্যার তলানিতে হাত দিতে হবে। সমাধানের পথ বের করতে হবে বাস্তবসম্মতভাবে। জীবনের আঁকাবাঁকা পথ আছে, থাকবে।  মানুষের জীবনটা বড় অদ্ভুত। বড় কষ্টের। সমাজে বেশিরভাগ মানুষ নিজেকে ফাঁকি দেয়। সমাজ, পরিবারে নিজের কাজটুকুও ঠিকমতো করে না।

এম আর আখতার মুকুলের কথা মনে পড়ছে। পাকিস্তান আমলের দাপুটে সাংবাদিক। একাত্তরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তার চরমপত্র অনুষ্ঠান মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করত। এরশাদ আমলে তিনি বেইলি রোডে একটি বইয়ের দোকান দেন। কলাম লিখতেন বিভিন্ন সংবাদপত্রে। এই সময়ে তার লেখা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কয়েকটি বই তুমুল আলোচনায় আসে। একদিন মুকুল ভাইয়ের সঙ্গে তার বেইলি রোডের বইয়ের দোকানে বসে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমি কেন এত কাজ করছি জান? কারণ প্রতি পাঁচ বছর পর একটি জেনারেশন তৈরি হয়। যার বয়স ১০ ঠিক পাঁচ বছর পর তার বয়স ১৫। ১০ বছরের ছেলেটি অনেক কিছু বোঝে না। কিন্তু ১৫ বছর বয়সে নিজেকে যুবক ভাবতে শেখে। আর যার বয়স ১৩ ঠিক পাঁচ বছর পর তার পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। তাই ভাবতে হবে প্রজন্মকে নিয়ে। ৫ জানুয়ারি কীভাবে নির্বাচন হলো পাঁচ বছর পর অনেকের তা মনে থাকবে না। আবার কবে আইল্যা হলো তা কত শতাংশ মানুষের এখন মনে আছে? প্রজন্মকে ঘিরে কাজ করতে হবে। কবি শামসুর রাহমান এক সময় রাজাকার উপদ্রবে ক্ষিপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে লিখেছিলেন, একজন খাঁটি রাজাকার বানিয়ে দিতে। আমাদের প্রিয় শামসুর রাহমান নেই। থাকলে হয়তো লিখতেন, একজন খাঁটি চাটুকার বানিয়ে দিতে। দেশে চাটুকারের সংখ্যা বাড়ছে, সত্য কথা বলা মানুষের সংখ্যা কমছে। একদিন অবস্থা এমন দাঁড়াবে সত্য কথা বলা অপরাধ বলে গণ্য হবে। সবাইকে বলতে হবে আ হা বেশ বেশ বেশ। যারা বলবেন না তাদের বারোটা বাজাবে আ হা বেশ বেশকারীরা। এখন কোনো পক্ষে না গেলে কিছুই হয় না। আপনাকে একটি পক্ষ নিতে হবে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতো মানুষের সংখ্যা, শিক্ষকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। একদিন দেখা যাবে সবাই চাটুকারদের দলে। আমরা এতটাই নিষ্ঠুর মুহম্মদ জাফর ইকবালকেও সুযোগ পেলে আক্রমণ করে বসি। সবকিছু দেখে রক্তক্ষরণ হয়। তবে একটা কথা বলতে চাই, চাটুকাররা কারও বন্ধু নয়। তারা সুযোগ পেলে ছোবল মারবে। দরকার ভালো-মন্দের সমালোচক। যারা খারাপকে খারাপ, ভালোকে ভালো বলবেন। সত্য বলার দায়ে লেনিনকে রাশিয়া ছাড়তে হয়েছিল। দীর্ঘ নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ফিরে আসেন বিপ্লবের লাল ঝাণ্ডার বিজয় নিয়ে। রাজনীতি এক ধৈর্য পরীক্ষা। সময়ের সঙ্গে অনেক কিছু বদলাবে। তোষামোদকারীরা কারও বন্ধু হতে পারে না। তাদের একটাই পরিচয় তারা চাটুকার। সময় বদলালে ওদের রূপ বদল হয়। মন বদল হয়।

একবার মন ভাঙলে জোড়া লাগে না। কবি নজরুলের তাই হয়েছিল। দ্রোহ ও প্রেমের কবি গিয়েছিলেন কুমিল্লার মুরাদনগরে। আসলে তাকে কলকাতা থেকে মুরাদনগরের দৌলতপুরে নিয়ে যান আকবর আলী খান। কবি তখন ঘুরে বেড়াতেন। কলকাতায় আকবর আলী খানের সঙ্গে কবির হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। এই কারণেই মুরাদনগর সফর। সুনসান নীরবতার দৌলতপুর গ্রামটি কবিকে মুগ্ধ করে। ভালোই কাটছিল তার। এক চাঁদনী রাতে কবি পুকুরঘাটে বসে বাঁশিতে সুর তোলেন। অদ্ভুত বাঁশি বাজাতেন নজরুল। সুরের মূর্ছনায় ঘর থেকে বের হয়ে আসেন এক নারী। নাম নার্গিস। আসলে এ নামটি কবির দেওয়া। তার আসল নাম সৈয়দা খানম। এই নারীর প্রেমে পড়েন নজরুল। বিয়ের প্রস্তাব দেন নার্গিসের মামা আকবর আলী খানের কাছে। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এই পরিবারে নানামুখী কথা। ঘুরে বেড়ানো বাউণ্ডুলে স্বভাবের এক কবির কাছে তারা কেন বিয়ে দেবেন? কিন্তু অন্যদের কথা কানে না তুলে আকবর আলী খান ভাগ্নির বিয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। বিয়ের সময়ও ঠিক হয়। বিয়ের রাতেই সমস্যা তৈরি হয়। আত্মীয়রা শর্ত দেন কবিকে থাকতে হবে মুরাদনগরে শ্বশুরবাড়ি। এই সময়ে উঠে আসে আরও অনেক ইস্যু। ঘোলাটে পরিস্থিতিতে নীরবে অভিমানে বিয়ের রাতেই মুরাদনগর ছাড়েন কবি। চলে আসেন কুমিল্লা শহরে। এরপর আমরা নার্গিসকে খুঁজে পাই গানে-কবিতায়। কবির ভাঙা মন আর জোড়া লাগেনি। কিন্তু রাজনীতি করা চাটুকারদের ভাঙা মন জোড়া লেগে যায়। তারা যখন তখন তেমন রূপ নেন। এই রাজনীতি আমরা চাই না।

     লেখক : সম্পাদক বাংলাদেশ প্রতিদিন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর