শিরোনাম
বুধবার, ২৭ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

‘জাতীয় ঐক্য’ বনাম ‘রাজনৈতিক ধাপ্পাবাজি’

রোবায়েত ফেরদৌস

‘জাতীয় ঐক্য’ বনাম ‘রাজনৈতিক ধাপ্পাবাজি’

জঙ্গি প্রশ্নে জাতীয় ঐক্য দরকার; কেন দরকার? কারণ জঙ্গি সমস্যার কারণে উন্নয়নের মহাসড়কে হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে এগুনো বাংলাদেশ বর্তমানে এক গভীর সংকটে পতিত হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, স্বাধীনতার পর গেল ৪৫ বছরে বাংলাদেশে এখন যে জননিরাপত্তার সংকট তৈরি হয়েছে—এতটা বিপর্যয়ের মধ্যে দেশ আগে কখনই পড়েনি। এ অবস্থার পরিত্রাণ দরকার; সংকটটি যেহেতু জাতীয়, তাই সবাই জাতীয় ঐক্য চাইছে; কিন্তু প্রধান দুই রাজনৈতিক দল জাতীয় ঐক্য নিয়ে বর্তমানে জাতির সঙ্গে স্রেফ প্রতারণামূলক খেলা খেলছে। আওয়ামী লীগ বলছে, জঙ্গি প্রতিরোধে জাতীয় ঐক্য হয়ে গেছে। কার সঙ্গে ঐক্য হলো? সরকারের হালুয়া-রুটির অংশীদার জাসদের সঙ্গে? সরকারি সংসদের গৃহপালিত জাতীয় পার্টির সঙ্গে? আমরা পছন্দ করি বা না করি, এটা ভুলে গেলে ভুল হবে যে, বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি; নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বিএনপি সংসদে কত শতাংশ আসন পাবে—তার সবচেয়ে ভালো হিসাব আওয়ামী লীগের কাছে ঠিকই আছে। কাজেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপিকে বাদ দিয়ে ‘জাতীয় ঐক্য হয়ে গেছে’ বলাটা রাজনৈতিক ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। এ ছাড়া আপাত ছোট দল হলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক বলয় কিংবা সিভিল সোসাইটিতে সিপিবি কিংবা বাসদের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে; তারাও নেই সরকারের কথিত এই ঐক্য প্রক্রিয়ায়। আবার বিএনপিও জাতীয় ঐক্য নিয়ে জাতির সঙ্গে চালাকি করছে। কী হয় জামায়াতকে ছাড়লে? মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে মাননীয় আদালত ‘জামায়াতকে একাত্তরের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত মানবতাবিরোধী সংগঠন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তো জঙ্গি প্রশ্নে জাতীয় ঐক্য করতে হলে বিএনপিকে তো জামায়াত ছাড়তেই হবে। এখন জামায়াতের সঙ্গ না ছেড়ে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেওয়া বিএনপির মুখে শোভা পায় না; এটা কেবলই এক ‘পলিটিক্যাল রেটোরিক্স’—রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর; এর মধ্যে কোনো সত্য বা সততা নেই—এ এক ফাঁপা বুলি, শেষবিচারে যা অন্তঃসারশূন্য।  

এটা খুবই দুঃখজনক যে, জঙ্গিবাদের মতো জাতীয় ও সিরিয়াস বিষয়েও আমরা এক হতে পারছি না। গুলশানের হামলার পর জঙ্গি কোথায় উৎপাদন হচ্ছে, কারা করছে, কীভাবে করছে, কেন করছে —এ নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা হয়েছে। বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঐক্য সম্ভব কিনা সেটা বিবেচনা করার আগে আরও অনেকগুলো বিষয় বিবেচনা করা দরকার; এবং সেই সঙ্গে লক্ষ্য নির্ধারণ করা দরকার কেন জাতীয় ঐক্য; সেটি কীভাবে কাজ করবে; কোথায় অ্যাপ্লাই করা হবে, কীভাবে অ্যাপ্লাই করা হবে; কেন করা হবে? দেশের মানুষ কয়েকটি ইস্যুতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। অন্যতম হলো যুদ্ধাপরাধীর বিচার ইস্যু। এ ইস্যুতে জামায়াত সারা দেশে ভয়াবহভাবে তাণ্ডব চালিয়েছে এবং অনেক দেশে ও আমাদের দেশের অনেক মানুষের কাছ থেকে সিম্পেথি আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। সেটি টাকা খরচ করে হোক আর অন্যকোনো উপায় অবলম্বন করেই হোক।

বিএনপি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিভক্তি এখন গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। তার বড় প্রমাণ আমরা ইউপি নির্বাচনের মাধ্যমে পেয়েছি। আবার মুক্তিযুদ্ধের ইস্যুতে ধর্মকে টেনে এনে দেশটাকে ভাগ করে ফেলা হয়েছে। এখানে বড় দুই দলের রাজনৈতিক ব্যর্থতা সর্বাধিক। এখন প্রগতিশীলতাকে ধর্মহীনতার কাতারে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থা তৈরি হলো কেন? তাহলে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে পক্ষের শক্তির এত বড় দাবিদার হয়েও কেন তারা দেশের মানুষকে এখন পর্যন্ত এক ছাতার তলে আনতে পারল না? বিএনপি দাবি করে তারাও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, তারাও কেন পারল না? এ প্রশ্নে দুই দলই ব্যর্থ। দুটি দলই পুরনো। তাদের আদর্শ আছে। তাহলে দেশের মানুষের মধ্যে তারা কেন যুদ্ধের সেই চেতনা ছড়িয়ে দিতে পারল না। জামায়াতের আদর্শ এখনো দেশের মানুষ লালন করে কেন? সাধারণ মানুষের এই রাজনৈতিক দলের আদর্শ লালন করার কথা নয়। সেই আদর্শ তো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার কথাও না। জামায়াত যখন সারা দেশে তাণ্ডব চালাল তখন তো সামাজিক প্রতিরোধ হওয়ার কথা। কিন্তু হলো না কেন? আসলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বড় বড় কথা বললেও মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দল সিরিয়াসলি কাজ করেনি। সেই চেতনা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে রাজনীতিবিদরা যারপরনাই ব্যর্থ। ব্যর্থ বুদ্ধিজীবীরাও—তারাও সমাজে ধর্মান্ধতা আর কূপমণ্ডূকতার বিপরীতে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও বিজ্ঞানমনষ্ক মতাদর্শের উজ্জীবন ঘটানোর পরিবেশ তৈরি করতে পারেনি; নিঃসন্দেহে এটি একটি ‘ইন্টেলেকচুয়াল ফেইলিউর’।

গুলশানের হামলার পর দুই দল নতুন করে নড়েচড়ে বসেছে। দেশে জঙ্গিবাদের যে চাষবাস হয়েছে সেটা বেশকিছু দিন ধরেই টের পাওয়া গেছে। এই হামলার মধ্য দিয়ে সেটা ম্যাসিভ আকারে প্রকাশ্যে চলে এসেছে। তো এটা ভালো লক্ষণ যে, দুই দল টের পেয়েছে— দেশ না থাকলে রাজনীতি থাকবে না। রাজনীতি করার জন্য দেশ দরকার। বিএনপি আওয়ামী লীগের এই ‘বিলম্বিত উপলব্ধি’র জন্য ধন্যবাদ। পাঠক লক্ষ্য করুন, দুই দলই জঙ্গিবাদ দমন করতে চায় কিন্তু এক টেবিলে বসে একসঙ্গে তাদের পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়। আমরা বাঙালি, বাংলাদেশি কিংবা আমরা আদিবাসী, কিন্তু আমাদের নেতারা জাতীয় ইস্যুতে, দেশের এতবড় ক্রাইসিসের সময়ও এক টেবিলে বসে আলোচনা করতে পারছে না। তাদের মধ্যে আসলে সৌহার্দ্যবোধ কিংবা দেশ-ভাবনা কতখানি? তারা কি আদৌ দেশ নিয়ে ভাবেন? প্রশ্ন রইল।

গুলশান হামলার পর খালেদা জিয়া সব ভেদাভেদ ভুলে দল-মত-নির্বিশেষে সন্ত্রাসবিরোধী ঐক্যের মাধ্যমে নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান জানান। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে জঙ্গিবাদ ইস্যুতে দলটি জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানায়। সেই প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জামায়াতের সঙ্গ ছাড়লে বিএনপির সঙ্গে সন্ত্রাসবিরোধী বা জাতীয় ঐক্যের বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। বিষয়টি দুই রাজনৈতিক দলের জন্যই বড় সুযোগ বলতে হচ্ছে। গুলশানের হামলা দুই রাজনৈতিক দলের জন্য পৌষমাস এনে দিয়েছে, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই; আওয়ামী লীগ ভাবছে, জঙ্গি দমন কেমন আওয়ামী লীগই পারে—এই ধারণা দেশে ও বিদেশে চাউর করে যতদিন খুশি ক্ষমতায় থাকা যায়; অন্যদিকে বিএনপি জঙ্গি দমনে সরকার ব্যর্থ—এটা প্রচার করে নতুন নির্বাচনের জন্য সরকারকে চাপে রাখতে চাইবে এবং ক্ষমতা আরোহণের খোয়াব বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু এই হামলায় দেশের যে কত বড় ক্ষতি হয়েছে তা নিশ্চয়ই সবার বোধগম্য। যে ক্রাইসিস তৈরি হয়েছে জঙ্গিবাদ ইস্যুতে তাতে দুদলের একটি ঐক্যের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এটাকে শুধু সুযোগ বললে ভুল হবে, এটাকে প্রয়োজনই বলতে হবে। তাই প্রয়োজনের তাগিদে দুদলকে ছাড় দিতে হবে। এখন সেই ছাড় কারা কীভাবে দেবে সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপার। তবে তারা উদ্যোগ গ্রহণ করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, দুই দল এক হয়ে এই সংকটের সমাধান করবে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, দেশের রাজনীতি সুস্থধারায় ফিরে আসবে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, দুই দলের উচ্চপর্যায়ের নেতা থেকে শুরু করে সবাই এক টেবিলে বসবে। আমরা মনে করি, গণতান্ত্রিক সরকার মানেই ‘গভর্নমেন্ট বাই ডিসকাশন’। এক টেবিলে বসে, আলোচনা করে তারা সমস্যার সমাধান করবে। কারণ এই বিশ্বাস এখন আমাদের জন্য অপরিহার্য। আমরা প্রতিদিন আতঙ্কে থাকতে চাই না। আমাদের এই আতঙ্ক থেকে মুক্তি দেওয়া হোক।

কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, বিএনপি তাদের কাছাকাছি মনোভাবের লোকজনের সঙ্গে ঐক্য করছে, করুক। আওয়ামী লীগও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের নিয়ে ঐক্য করে এগিয়ে চলেছে। শান্তির জন্য কাজ করতে চাইলে যে কেউ যেকোনো ভুবনে দাঁড়িয়ে করতে পারে। (২৩ জুলাই, প্রথম আলো) তার এ কথার যুক্তি আছে। আসলেই শান্তির জন্য কাজ করতে চাইলে যে কোনো জায়গা থেকে কাজ করা যায়। কিন্তু সমস্যাটি আদর্শিক। আর সমাধানটি হতে হবে রাজনৈতিকভাবে। আর সাধারণ মানুষকে নিয়ে কাজ করে সেই সমস্যার সমাধান করতে হলে এ দুটি রাজনৈতিক দল একসঙ্গে থেকে সমস্যার সমাধান করা সহজ হবে সেটা নিশ্চয় একজন প্রবীণ রাজনৈতিক হিসেবে তিনি বেশি বোঝেন। বিএনপি এ বিষয়ে ইঙ্গিতও দিয়েছে। এ বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে জোট করার লাভ-লোকসান নিয়ে শুরু থেকেই বিএনপির ভিতরে পক্ষ-বিপক্ষ ছিল, আছে। বিষয়টি ব্যক্তিপর্যায়ে ছিল, এখন প্রকাশ্যে এসেছে। তিনি আরও বলেছেন, জাতীয় ঐক্য গড়ার সুবিধার্থে যদি জামায়াতকে ছাড়তে হয়, তা করতে হবে। তবে এটি বিএনপির দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয় নয়, জাতীয় সিদ্ধান্তের বিষয় (পূর্বোক্ত)। সাদা চোখে বিবেচনা করলে নোমানের এ কথা থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ঐক্যের প্রয়োজনে তারা জামায়াত ছাড়তে রাজি।

এখন আওয়ামী লীগ এই সুযোগটা নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জাতীয় ঐক্য হয়ে গেছে। যদিও তার কোনো প্রক্রিয়া বা কাজ আমরা এখনো মাঠে দেখিনি। আমরা তা দেখতে চাই। প্রতারণা, ধাপ্পাবাজি আর রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরতা ঝেড়ে ফেলে, আমরা মনে করি, যেকোনো মূল্যে দেশ ও দশের স্বার্থে জঙ্গিবাদের সমাধান করতেই হবে। বাংলাদেশের সামনে এর বাইরে আর কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]

সর্বশেষ খবর