বিনা হিসাবে জান্নাতে যাওয়া যাবে কি? এ সম্পর্কে রসুলুল্লাহ [সা.]-কে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। আল্লাহ তাঁকে দেখিয়ে দিলেন কিছু লোককে যারা উপবেশন করেছিলেন তার ডান দিকের একটি টিলায়। আর এক দল ছিলেন বাম দিকের টিলায়। যারা জান্নাতে যাবেন তাদের স্থান নির্ধারিত। কোরআনের একটি আয়াত তিনি তেলাওয়াত করলেন। তার অর্থ : ‘তাদের মধ্যে একটি বৃহৎ দল পূর্ববর্তীদের মধ্যে হবে। আর একটি দল পরবর্তীদের মধ্যে হবে।’ এর সংখ্যা নির্ধারিত। যারা শিরক করেনি, মন্ত্রতন্ত্রের পেছনে কালাতিপাত করেনি, দুনিয়াদারি ও নেতৃত্বের পেছনে ছোটেনি। এরাই তারা যারা বলেছেন : আমরা একমাত্র নির্ভর করি আল্লাহতে। ‘কারও ভরসা করিস নে তুই, এক আল্লাহর ভরসা কর’ [নজরুল]।
সম্প্রতি আমেরিকায় একটি বই পাঠ করেছি, যেখানে জনৈক ব্যক্তি আঠারো হুইলারের নিচে চাপা পড়ে নব্বই ঘণ্টা মৃত ছিলেন। ফিরে এসে বই লিখেছেন। দাম ২০ ডলার। ‘Near Death Experience’ অর্থাৎ এনডিই নিয়ে আরও অনেক বই সাজান। আমার সমবয়সীরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। আশি বছরের জনৈক মহিলা পড়তে পড়তে অজ্ঞান। বললেন : ‘হে ঈশ্বর, আমাকে আর কতকাল এখানে ফেলে রাখবে? আমি এক্ষুনি যেতে চাই স্বর্গে।’ হে ঈশ্বর আমি আমার সবকিছু দিয়ে দেব, শুধু আমাকে স্বর্গ দিও। আপনারা জেনে অবাক হবেন আমেরিকার অর্ধেক বুড়ি তাদের সম্পদ চার্চকে দিয়ে যান। রোটারি ফাউন্ডেশনের অর্ধেক অর্থ বুড়োবুড়িরা দিয়ে যান। এমনকি তাদের নামও কেউ জানতে পারে না। এরই নাম দান। যার প্রতিদান স্বর্গ।
লেখক স্বর্গ দেখে এসেছেন। এত চিত্তাকর্ষক যে কিছুক্ষণের মধ্যে পাঠ করে ফেললাম। কোনো কথাই ভোলা গেল না। হুরপরীর কথা নেই, আছে পুরনো বন্ধু-বান্ধবদের কথা, যারা তাকে অভ্যর্থনা করার জন্য দাঁড়িয়ে। বাবা-মা, ছেলেমেয়েরা সবাই আছে, কেউ বাদ নেই। আনন্দের হাট যেন। দুঃখ পরিবেশকে স্পর্শ করতে পারেনি। চারদিকে ঝরে পড়ছে ঈশ্বরের বিগলিত করুণা ধারা, বলেছি আমার বিভিন্ন লেখাতে:‘বিগলিত করুণা, জাহ্নবি যমুনা’
‘বিগলিত করুণা, রাহমান রাহিমা’।
বাড়ি ফিরে হাতের কাছে জান্নাতের বইগুলো নিয়ে আবার বসলাম। আরও চিত্তাকর্ষক। যদিও বর্ণনা তেমন মধুর নয়। বিখ্যাত আলেমদের লেখা। ধরা যাক ফলের কথা, এমন ফল যাতে কাঁটা আছে হয়তো, কিন্তু কাঁটাও যে মধুর চেয়ে মধুর। আমার নাতিকে কয়েকটি ফলের নাম বলতে বললাম। সে ১৪টি বলার পর থেমে গেল। আমিও ৫০টির বেশি বলতে পারলাম না। এর মধ্যে ২৫টির বেশি ফল নিজেই খাইনি।
এ বছর আমের এত ফলন হয়েছে যে বলার নয়। তার মধ্যে কয়েকটি উপহার পেয়েছি। আমেরিকায় গিয়ে খেলাম ৩০টি বিভিন্ন রকমের আম। খবর নিয়ে জানলাম এই আমের জাতিসংখ্যা হবে ১০০টিরও বেশি। জনৈক ব্যক্তি আমাকে একটি আম উপহার দিলেন, যার বিচিটি ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা থেকে আনা হয়েছে। ফলটি এত মিষ্টি যে আমেরিকায় এ নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। ফলটির নাম ‘জাকার্তা’। আমি এর আঁটি সংগ্রহ করেছি, যাতে এটি দিয়ে গাছ তৈরি করা যায়। এখন ভাবুন, এক আমই যদি এই পৃথিবীতে এত বিচিত্র রকমের ফলানো সম্ভব হয় তা হলে জান্নাতে কত রকমের আম হতে পারে। আমের কথা বললাম এ কারণে যে, অনেকের মতে আমই শ্রেষ্ঠ। বলে গেছেন জহিরউদ্দিন শাহ বাবর। কিছু দিন আগে আমার এক রোটারিয়ান বন্ধু আমাকে ১০টি চওসা আম পাঠান। এ রকম আম জীবনে খাইনি। আমার স্ত্রী ছাড়া আর কাউকে এ আমের ভাগ দিইনি। জান্নাতের বর্ণনায় আছে যে, ‘প্রত্যেকটি ফলের স্বাদ হবে বাহাত্তর রকমের’। এই স্বাদ সারা পৃথিবীর কেউ কখনো পায়নি। তুশতারির জীবন নিয়ে আলোচনার প্রসঙ্গে একটি বেহেশতি ফলের কথা বলেছি, যেটি খাওয়ার পর তুশতারির মাথা খারাপ হওয়ার উপক্রম। তিনি বলেন, একটি ফল খেয়েই যখন এত তৃপ্ত হলাম, তখন আমি কেন সারা দিন বেহেশতের তালাশ করব না? আমি কি এত বোকা যে, একটি ফলের স্বাদও বুঝতে পারব না? হাদিসে লেখা : ‘প্রত্যেকটি ফলের স্বাদ অপরটি হতে ভিন্নতর হবে।’
আল্লাহর রসুল [সা.] প্রায়ই সাহাবাদের সঙ্গে নানা গল্পে মশগুল হয়ে যেতেন। তিনি ছিলেন মজলিসি মানুষ। সবাই তাঁর বন্ধু। যেমন আনন্দবাহী, তেমনি মজার ও ভবিষ্যতের স্বপ্নবাহী সেই গল্পগুলো [আহা! যদি এমন সভায় উপস্থিত থাকতাম, গল্পগুলো তুলে নিয়ে আসতাম]। তিনি বলতেন, ‘তুবা’ নামে এক গাছের কথা, যার ফল হবে অতুলনীয়। আবার শাম দেশের একটি গাছের কথা বলেছেন, যার নাম জাওজাহ। সেটি এত বড় হবে যে যদি কেউ তিন বছর ধরে সেই গাছটি অতিক্রম করতে চায়, পারবে না। এই জাওজাহ গাছটির ফল কেমন হবে তা তিনি বলেননি। অর্থাৎ এটা কারও কল্পনায় আসবে না। আঙুর ফলের কথা বলেছেন, যা পৃথিবীতে কেউ কখনো দেখেনি। বলেছেন, বেহেশতের আঙুরের একটি দানা এত সুস্বাদু ও বিপুল হবে যে তা দিয়ে রসুলুল্লাহ [সা.]-এর পরিবারের সবারই পেট ভরে যাবে। এতই তার বরকত ও স্বাদ। এগুলো স্বয়ং রসুলুল্লাহ [সা.]-র কণ্ঠনিঃসৃত। সব কথা কেউ লিখে রাখেনি। অল্প একটু পাওয়া যাবে ‘তাফসিরে ইবনে কাসির’ গ্রন্থে। আমি পেয়েছি হজরত ইউসুফ কান্ধলবির ‘হায়াতুস সাহাবাহ’ থেকে। ইংরেজি অনুবাদ হলে এগুলো ‘বার্নস অ্যান্ড নোবেল’-এর ওই বইয়ের তাকগুলোয় পৌঁছে দিতাম।
একদিন হজরত ওমর কাঁদছেন। দৃশ্যটি বিরল। শুধু কাঁদতেই লাগলেন। তারপর বললেন, আসমানি খবর এসেছে। সে খবরে আভাস পাওয়া যায় কে যাচ্ছে জান্নাতের দিকে, কে বা যাচ্ছে দোজখ পানে। তিনি এইমাত্র শুনলেন রসুলুল্লাহ [সা.]-র বাণী। তিনি বলছেন, হে আলী, তুমি কি জান আমার যারা সাহাবা তাদের মধ্যে আবু বকর ও ওমর মধ্যবয়সী জান্নাতের সরদার। আল্লাহ পাক তাদের প্রবেশ করাবেন এই আনন্দের হাটে।
গল্পগুলো বড়। অল্প শোনালাম। ওমরের কান্না থামতেই চায় না। বললেন, আমাদের জন্য যে এত খাদ্য এখানে এবং জান্নাতে, তা হলে যারা এই পৃথিবীতে খেতে পায়নি, তাদের কী হবে? ওমর নিজেই উত্তর দিলেন : ‘হে আমার বন্ধুরা, শুনে রাখ। সেই সব গরিবের জন্যই তো জান্নাত। তারা জান্নাতের সব নিয়ামত ভোগ করবে। আমরা যারা প্রতিনিয়ত সম্পদের তালাশ করছি এই পৃথিবীতে, অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ে ফেলছি, তাদের জন্য তেমন কিছুই থাকবে না। পৃথিবীতে ভোগ চাই না। হে আল্লাহ, গরিব হিসেবে মৃত্যু দিও।’
আজ সকালে ‘হায়াতুস সাহাবাহ’ পাঠ করে আমি যেন অন্য মানুষ। আসুন আমরা যেভাবে পারি জান্নাতের তালাশ করি। এই পৃথিবীর সম্পদকে দুপায়ে ঠেলে দি। সম্পদই জান্নাতের অন্তরায়। ‘বার্নস অ্যান্ড নোবেল’-এ যে গ্রন্থগুলো দেখে এসেছি তার কোনোটিই সাজানো নয়, প্রকাশ আলাদা।
লেখক : সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।