শুক্রবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

চন্দন বৃক্ষের প্রার্থনা

শারমিনী আব্বাসী

চন্দন বৃক্ষের প্রার্থনা

ছেলেবেলায় সন্ধ্যে শুরু হতো বিটিভি দেখে। প্রথমে পবিত্র কোরআনের বাণী, গীতা, বাইবেল। শেষ হতো মহামতি বুদ্ধের বাণী দিয়ে। যিনি পড়তেন হাস্যময়ী সেই পুরোহিতের শেষ বাক্যটি ছিল ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক’। আরবি, সংস্কৃত একটি ছোট মেয়ে বোঝে না, সে বুঝত নিজ ভাষার এই কথাটি। এতটা বছর চলে গেল এই প্রার্থনার অনুরণন হারায়নি। ঈশ্বরের হাত তো দীর্ঘ, সবাইকে ভালো রাখার মিনতি জানিয়ে ঘুমুতে যাই। যখন নৃশংসতার খবর শুনি মন কাতর হয় প্যারিসে বন্ধু এ্যানসিবিল, ফ্রাংফুটের সিলভি, মস্কোতে আনা, আরো কতজনার জন্য। সেই সঙ্গে অশ্রু ঝরে বাগদাদ কিংবা সিরিয়ায় লুণ্ঠিত, অত্যাচারিত, মানবতার নির্মম পরাজয়ে। শুধু আমার মুখ, সিঁথির ভাঁজ, ভাষার অন্ত্যমিল কিছু নয়। এতটা বছর চলে গিয়ে জেনেছি তুমিই আমি। হয়েছি চন্দন বৃক্ষ। একটি চন্দনের বৃক্ষে সুবাস আসতে প্রায়শ ৪০ বছর লেগে যায়। এর আগে সে কদাচ চেনে না সুগন্ধ কি? সে দৌড়ে বেড়ায়। সে ব্যস্ত থাকে স্ত্রীর জন্য গোলাপি স্বপ্ন কেনার ঘোড়সওয়ারে। সে সদর্পে বলে তুমি তোমার, আমি আমার। তারপর অতি ধীরে সে জানে যা তোমার তা তোমার, যা আমার তাও তোমার। এরপর চল্লিশের চূড়ায় দাঁড়িয়ে সে বলতে শেখে তোমার আর আমার বলে কিছু নেই। গভীরভাবে ভেবে দেখেছি মুহাম্মদ [সা.] হেনা রঙা পাহাড়ি পথ বেয়ে মানুষের কোলাহল থেকে দূরে হেরা গুহায় কেন যেতেন? কেন রাজপুত্র সিদ্ধার্থ সুন্দর স্ত্রী আর পুত্র রেখে অনির্বাণ কিছুর পানে ছুটলেন? এই অনুরাগ কিসের? ফিরে এলেন নির্বাণ হাতে। যারে ধরতে গেলে যায় না ধরা, করে লুকোচুরি, সেই অধরার সন্ধান জীবনের অলীক দুঃসাহসী অভিযান। এই খাঁচার শরীর, তার সুবেশ, সন্তান কিংবা ক্যারিয়ারের চিকিমিকি কত্ব দিন বিমুগ্ধ রাখতে পারে কোনো চক্ষুষ্মান মানুষকে। যাদের পারে তারা ভাগ্যবান ওমহড়ত্ধহপব রং নষরংং তাদের জন্য। পৃথিবীর প্রিয়তম দরবেশ জালালউদ্দিন রুমির বয়স যখন সাত, তখন তার বয়সী বালকেরা এ বাড়ির ছাদ থেকে ও বাড়ির ছাদে টপকে যাওয়ার খেলায় ব্যস্ত। তুমি কেন খেলছ না জিজ্ঞাসায় তার উত্তর ছিল ছাদ থেকে ছাদে লাফানোর খেলা কুকুর-বেড়ালের জন্য। মানুষ যাবে লোক থেকে লোকান্তরে।

রাষ্ট্রের বিপর্যয়ে মানুষ আগে পথে নামত। এখন নামে না। মিছিল, দেয়ালে দেয়ালে ফেস্টুন, নিষিদ্ধ ইস্তেহারের দিন শেষ। কেননা এখন সব সংঘাত নিজের ভিতরে। হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল হলে এখন ফেসবুকে যা ইচ্ছে মন চায় লিখে দেওয়া যায়। ‘লাইক’-এর সংখ্যা গুণেই পাখির ছানার মতো শান্ত মন। এখন তারুণ্যকে বলা যায় না

‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়। এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।

গভীর রাতে সন্তানদের ঘরে উচ্চকণ্ঠে হাসাহাসি শুনে উঁকি দিয়ে জানতে চাই, কি বিষয়? কিপিং ইউথ কিম কার্দাশিন নামক এক উদ্ভট রিয়ালটি শো তাদের বিমোহিত করে। চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলি। মনকে বলি থাক ওরা সুখে থাক। ‘হ্যাপি চিলড্রেনই’ আজকাল বড় সন্তোষ কারণ তারা হতাশ হলেই যাবে বিপথে। সব আন্দোলন পূর্ণতা পায় না। কালবেলা কাল পুরুষেরা নায়কেরা ব্যর্থই তো। সাম্যবাদের বিজয় হয়নি। কিন্তু মন্ত্রগুলো বৈদিক ছিল, বুর্জোয়া বিলাসের যুগেও কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।

কবীর সুমনের এক কনসার্টে মজা করে বলেছিলেন, তরুণেরা মাঝবয়সীদের দেখলে ঠোঁটের ঢালে এক ফালি সরু হাসি দেখা দেয়। মাথার চুল কমে গেছে, স্ফীত উদর। কিন্তু ওরা তো জানে না চল্লিশ পেরুলেই চালশে। উল্টো করে ভাবলে উত্তর চল্লিশে যখন চেহারার দীপ্তি অল্প অল্প করে হারায়, হৃদয় হয়ে ওঠে তত ঋণী, নত হয়ে আসে লেখনী। মনে হয় কত ছোট আমি বেঁচে আছি। কত কম গেয়ে উঠি গানে। যত ছাই জমে সংসারে ততই পাখি হয়ে ওঠে প্রাণ কূহেলী মাঠের প্রান্তরে— খোঁজে দেবদূত।

ধর্মের কথা বলতে ভয় পাব কেন? এই সিঁড়ি বেয়েই তো অসীমের ডানা মেলা। হোক তা জীবন বোধ, কিংবা যতি চিহ্নহীন মানবতাময় পৃথিবীতে রোদ্দস্নান কিংবা অমায়িক বুক ভরা গান। অতিন্দ্রীয় মানেই পুণ্যলোভী নয়। এক স্তর থেকে আরও উচ্চতায় যাওয়ার অভিলাষহীন জীবন মানব শ্রেষ্ঠর মানায়? সত্তার শাণিত প্রতিচ্ছবির জন্য মাটির বন্ধন হতে আরও উড়ন্ত, দীঘল দ্বিগবলয়ের সন্ধান মানুষের কল্যাণের জন্যই। আধ্যাত্মিকতার মাঝেই মুক্তির মন্ত্র লুকান। হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী অনলে শ্রাবণ ধারা শুধু সেই ঢালতে পারে। তুমি আর আমি যে এক এই জানাটুকুর জন্যই এতটা পথ পেরিয়ে আসা। চেতনার অগ্নি বলাকার ঝাপটান পাখা দেহের সীমায় বন্দী নয়। সে সীমার মাঝে অসীমের প্রলয়ঙ্করী রাজাধিরাজ। সে বিশ্বমানবতার মাঝে নিজের ক্ষুদ্র নাম, নিবাস, ধর্ম বর্ণের বিসর্জন দিয়ে নিজেই ঈশ্বর। শুধু অন্নজল গ্রহণ করে বেঁচে থাকার কথা ছিল না। শুধুই রেহেলে সাজান কোরআন, গৃহকোণে তুলসী মঞ্চে প্রকাশিত হবেন না প্রভু। আরাধনা ছাড়া আরাধ্য মেলে না। ভাবতে কি পারি না এক অলীক সাম্পানে চলেছি সবাই, যাচ্ছি ফুলে ফলে ছাওয়া সবুজ এক ভূ-খণ্ডে? যুদ্ধবাজ পৃথিবীর হয়ে ক্ষমা চাইছি ঈশ্বরের কাছে।  একবার এবং শেষবার।

     লেখক : আইনজীবী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর