রবিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

রামপালে হাসিনা-খালেদা মুখোমুখি

কাজী সিরাজ

রামপালে হাসিনা-খালেদা মুখোমুখি

রামপাল নিয়ে রাজনীতির খেলাই জমে গেল? ১৮৩৪ একর জমির ওপর ১৪ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা খরচে সরকার সেখানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প করতে বদ্ধপরিকর। ২০১০ সালের ২৭ ডিসেম্বর সেখানকার জমি অধিগ্রহণের আদেশ জারির পর নিষ্ঠুর উচ্ছেদ অভিযান, স্থানীয় জনগণের ক্ষোভ, বাদ-প্রতিবাদ এবং দেশের মানুষের সচেতন একটি অংশের বিরোধিতা— কোনো কিছুই সুন্দরবনবিনাশী এ প্রকল্প থেকে লীগ সরকারকে ফেরাতে পারেনি। সুন্দরবন কিছু গাছগাছালি আর কিছু পশুপাখির আবাস বা আশ্রয়স্থলই নয়। সুন্দরবন অনেক প্রাণের সমষ্টি এক মহাপ্রাণ, অসাধারণ জীববৈচিত্র্যের আধার হিসেবে তুলনাহীন এক ইকোসিস্টেম ও প্রাকৃতিক রক্ষাবর্ম, বিশ্বঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত।  সুন্দরবন লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার যেমন সংস্থান করে, তেমনি সিডর আইলার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায় চার কোটি মানুষের জীবন ও সম্পদও রক্ষা করে। দেশের সীমানায় এবং সীমানার বাইরে বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চল কার্যত সুন্দরবনের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে এতদিন দেশব্যাপী জোরদার কোনো আন্দোলন গড়ে তোলা যায়নি। তবে এর ক্ষতিকর দিকসমূহ তুলে ধরে এর বিরুদ্ধে জনসচেতনতা ও জনমত গড়ার কাজ অনেক আগে থেকেই শুরু করে ‘তেল-গ্যাস, খনিজসম্পদ ও বিদ্যুত্বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’। ছোট হলেও দুটি বাম রাজনৈতিক দল— সিপিবি ও বাসদ শুরু থেকেই তাদের সঙ্গে আছে। সবাই জানেন ও মানেন যে, তেল-গ্যাস, খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট তাদের অনেকেই বিষয়বিশেষজ্ঞ। এ কথা আজ স্বীকার করতে হবে যে, ‘জাতীয় কমিটি’ শুরু থেকে এ ব্যাপারে সোচ্চার না থাকলে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে আমরাও অনেক কিছুই জানতাম না। জাতিকে অন্ধকারে রেখেই ‘বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে ক্ষতিকর প্রকল্পটি হয়ে যেত বিনা প্রতিবাদে, বিনা বাধায়। অনেক বিলম্বে হলেও দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি রামপালে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। গত ২৪ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এ সংক্রান্ত সরকারি সিদ্ধান্তকে ‘দেশবিরোধী’ ও ‘গণবিরোধী’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বিকল্প আছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিকল্প স্থানও আছে; কিন্তু সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই। ঠিক তিন দিন পরই একই ইস্যুতে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলন করে বেগম জিয়ার বক্তব্য নাকচ করে বলেছেন, রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে। তাতে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না। বিদ্যুৎকেন্দ্রবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে গুলশানের জঙ্গি হামলার মিল রয়েছে বলে দাবি করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এমন একটা সময় যখন বাংলাদেশে বিনিয়োগের সব থেকে সুন্দর পরিবেশ। বিশ্বব্যাপী মানুষ উন্মুখ হয়ে ছিল বাংলাদেশে আসবে। বিনিয়োগ করবে। ঠিক সে সময় কয়েকটা ঘটনা ঘটিয়ে বিনিয়োগটাকে থামানো, উন্নয়নটাকে থামানোর চেষ্টা... ঠিক একইভাবে মনে হয় যেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটা নিয়ে আন্দোলনের নামে এত কথা এবং বাধা দেওয়া (প্রথম আলো, ২৮-৮-২০১৬)। বিএনপি এ ব্যাপারে মুখ খোলার আগে প্রধানমন্ত্রীকে এ ইস্যুতে এভাবে আর রি-অ্যাক্ট করতে দেখা যায়নি। এরপর আমাদের দেশের রাজনীতির চেনাপথেই হাঁটলেন বিএনপি নেত্রী। বেগম খালেদা জিয়াও তাত্ক্ষণিক জবাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের। শুভ জন্মাষ্টমী উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘সেদিন রামপাল নিয়ে আমি বক্তব্য দিয়েছিলাম, উনাদের খুব গায়ে লেগেছে। গায়ে বেশি জ্বালা ধরেছে বলে আজকে (শনিবার) বক্তব্য দিয়েছে। কিন্তু উনি আগে বলুক যে, আমি যে বক্তব্য দিয়েছি কোনটি ভুল, মিথ্যা’ (প্রথম আলো, ২৮-৮-২০১৬)। খালেদা জিয়া আরও বলেন, ‘আমরা তো বলি নাই যে, বিদ্যুৎকেন্দ্র চাই না। আমরা বলেছি এখানে বন্ধ করতে হবে। আরও অনেক জায়গা আছে করার মতো। আমরা বারবার বলেছি, এই যে ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসি, ভারতের বিভিন্ন জায়গায় তারা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে চেয়েছে। কিন্তু প্রত্যেক জায়গায় বাধা পেয়েছে। জনগণ প্রতিবাদ করেছে পরিবেশ এবং মানুষের ক্ষতি হবে বলে। সেখানকার (ভারত) গণতান্ত্রিক সরকার মানুষের কথা চিন্তা করে সে প্রতিবাদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। আর সেই জিনিস বাংলাদেশে করা হচ্ছে। এর প্রভাবে দক্ষিণের সব জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হবে’ (২৮.৮.২০১৬ এর প্রথম আলো)। রামপাল ইস্যুতে তিন দিনের ব্যবধানে সরকারপ্রধান ও বিএনপির চেয়ারপারসনের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য এমন আভাসই দিচ্ছে যে, ইস্যুটি এখন আর পরিবেশ আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে দ্রুত রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নিতে যাচ্ছে। রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রথম বিরোধিতাকারী এবং এ ব্যাপারে যথেষ্ট অনুকূল জনমত সৃষ্টিকারী তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা কমিটিও একটি সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য খণ্ডন করে রামপালে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরোধিতার নানা যুক্তি তুলে ধরে। এ কথাগুলো তারা আগেও বলেছেন। বেগম খালেদা জিয়া গত ২৪ আগস্টের সংবাদ সম্মেলনেও তার বক্তব্যের স্বপক্ষে কনভিন্সিং কিছু যুক্তি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ভারতের মধ্যপ্রদেশের নরসিংহপুর জেলায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের রামপাল কয়লা-বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব ভারত সরকার বাতিল করে দিয়েছে। নরসিংহপুরের জনবসতি, কৃষিজমি, স্থানীয় নর্দমা নদী থেকে ঘণ্টায় ৩২ কিউসেক পানি উত্তোলন করতে হবে বলে প্রকল্পটি বাতিল করা হয়।

বাগেরহাট জেলার আয়তন নরসিংহপুরের চেয়ে অনেক কম, জনসংখ্যার ঘনত্ব নরসিংহপুরের চেয়ে অনেক বেশি, ৩৮২ জন। ভারতের যে প্রতিষ্ঠান নরসিংহপুরের প্রকল্পের প্রস্তাব দিয়েছিল সেই ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশনের (এনটিপিসি) সঙ্গেই যৌথভাবে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি করেছে সরকার। প্রকল্পটিকে বাংলাদেশের জন্য ‘অলাভজনক ও লোকসানি’ উল্লেখ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রকল্পের ১৫ শতাংশ অর্থ জোগান দেবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), ১৫ শতাংশে ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসি। বাকি ৭০ শতাংশ ব্যাংক ঋণ নেওয়া হবে। বাংলাদেশ থাকবে গ্যারান্টার। কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেলে বা ঋণ শোধে ব্যর্থ হলে পুরো ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে। উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনবে পিডিবি। যে নিট লাভ হবে তা ৫০ শতাংশ হারে পিডিবি ও এনটিপিসির মধ্যে ভাগ হবে। অথচ শতভাগ পরিবেশ ধ্বংস হবে বাংলাদেশের। ১৫ শতাংশ বিনিয়োগ করে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ৫০ শতাংশ মুনাফা নেবে এবং ট্যাক্স ফ্রি সুবিধার আওতায় মুনাফার পুরো টাকা তাদের দেশে নিয়ে যাাবে। ভারতে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে কয়লা-বিদ্যুকেন্দ্র স্থাপনে আইনি বাধা আছে। এ কারণে ২০১২ সালে তামিলনাড়ুতে, ২০০৮ সালে কর্ণাটকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব বাতিল করে ভারত সরকার। অথচ জনগণ ও দেশের স্বার্থের প্রতি উদাসীন সরকার সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে। খালেদা জিয়ার এসব বক্তব্যের জবাব অবশ্য প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন তার সংবাদ সম্মেলনে। তিনি বলেছেন, শব্দ দূষণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ১৪ কিলোমিটার দূরে শব্দ যাবে না। ২০০ মিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। পশুর নদ থেকে পানি নিয়ে ব্যবহারের পর তা শীতল করে নদীতে ফেলা হবে। এ প্রকল্পে অর্থ বিনিয়োগ না করার জন্য দেশি-বিদেশি ১৭৭টি সংগঠনের পক্ষ থেকে ভারতের এক্সিম ব্যাংকের কাছে যে আহ্বান জানানো হয়েছে সে সংগঠনগুলোর ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সংগঠনগুলো কারা আমরা খবর নিচ্ছি। যদি তারা (এক্সিম ব্যাংক) টাকা না দেয় নিশ্চয়ই আমরা অন্য সোর্স থেকে পাব। আর তাও যদি না পাই, আমরা নিজেদের টাকায় করব।’ এর অর্থ দাঁড়াল, প্রধানমন্ত্রী রামপালে কয়লভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প করতে বদ্ধপরিকর। বিএনপি চেয়ারপারসন রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরোধিতা করায় প্রধানমন্ত্রী তার সিদ্ধান্তে যেন আরও অটল হয়ে গেছেন। বিষয়টা এখন রাজনৈতিক দলের মধ্যকার রেষারেষির পর্যায়ে চলে গেছে বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টা রাজনৈতিক দলের মধ্যকার বিরোধ বা জেদাজেদির বিষয় নয়। এর সঙ্গে সুন্দরবনের অস্তিত্ব, জীববৈচিত্র্য বিনাশ, ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ধ্বংস, জনজীবনের দুর্গতির জরুরি বিষয়সমূহ জড়িত। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী যেসব তথ্যের ভিত্তিতে বলেছেন, এ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন হলে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না, পরিবেশ দূষণ হবে না ইত্যাদি, এ তথ্যগুলো যারা সরবরাহ করেছেন তারা সঠিক তথ্য দেননি। তারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে মিসলিড করছেন। দেশ-বিদেশের অভিজ্ঞতা এবং দেশে বিভিন্ন গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ থেকে গত ২৬ জুলাই ২০১৬ ‘তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা’ কমিটির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ সম্পর্কে যে খোলা চিঠি দেওয়া হয় তার আলোকে বলা যায় (ক) কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বছরে ৪৭ লাখ ২০ হাজার টন কয়লা পুড়িয়ে ৭ লাখ ৫০ হাজার টন ফ্লাই অ্যাশ ও ২ লাখ টন বটম অ্যাশ উত্পন্ন হবে। এই ফ্লাই অ্যাশ, বটম অ্যাশ, তরল ঘনীভূত ছাই বা স্তরি ইত্যাদি ব্যাপক মাত্রায় পরিবেশ দূষণ করবে। কারণ এতে আর্সেনিক ও বিভিন্ন ভারী ধাতু যেমন পারদ, সিসা, নিকেল, ভ্যানাডিয়াম, বেরিলিয়াম, বেরিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, সেলেনিয়াম, রেডিয়াম মিশে থাকে। এর ফলে সন্দরবনের পশুপাখি, বৃক্ষ লতাপাতাসহ অসংখ্য প্রাণ ও ইকোসিস্টেম ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে; (খ) কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিষাক্ত সালফার ও নাইট্রোজেনের বিভিন্ন অক্সাইড গ্যাস নির্গমনের ফলে মানুষ, গাছপালা ও জীবজন্তুর জীবন বিপন্ন হবে; (গ) সাড়ে ৪ বছর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকালে আমদানি করা কয়লাসহ নির্মাণসামগ্রী সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে নদীপথে পরিবহনের সময় বাড়তি নৌযান চলাচল, তেল নিঃসরণ, শব্দদূষণ, আলো, বর্জ্য নিঃসরণ, ড্রেজিং ইত্যাদির মাধ্যমেও বিপর্যয় সৃষ্ট হবে।

বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আমদানি করা কয়লা সুন্দরবনের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত পরিবহনে কয়লার জাহাজ থেকে নির্গত কঠিন ও তরল বর্জ্য, জাহাজের শব্দ, জাহাজসৃষ্ট ঢেউ, সার্চলাইটের আলো, কয়লা, লোড-আনলোডের ফলে সৃষ্ট দূষণ সুন্দরবনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটাবে; (ঘ) কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের টারবাইন, জেনারেটর, কম্প্রেসার, পাম্প, কয়লা উঠানো-নামানো, পরিবহন ইত্যাদির কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য যানবাহন থেকে ভয়াবহ বায়ুদূষণ হবে; (ঙ) কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত দূষিত পানি এবং অন্যান্য কঠিন ও তরল বর্জ্য সুন্দরবনের পশুর নদ ও সংযুক্ত খালগুলোর পানি দূষিত করে ফেলবে। যেসব নদী সুন্দরবনের প্রাণ, সেগুলোর অবস্থা বুড়িগঙ্গার চাইতেও খারাপ হবে।

প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সরবরাহকৃত যে তথ্য দিয়েছেন, উপরের বিশ্লেষণের সঙ্গে তা সামঞ্জস্যহীন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন ক্যারিয়ার রাজনীতিবিদ। রাজনীতিবিদদের আমলা-নির্ভরতার চেয়ে গণ-নির্ভরতাই বেশি। যে নেতা-নেত্রী ক্ষমতায় গিয়ে অতিমাত্রায় আমলানির্ভর হয়ে যান, তিনি একদিকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান এবং আমলা-কর্মচারীর বুদ্ধি-পরামর্শ গ্রহণ করে ভুল করে আখেরে পস্তান। রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী তার নিজস্ব দলীয় সোর্সে তথ্য সংগ্রহ করলে প্রকৃত অবস্থা ও সেখানকার জনমত সম্পর্কে সম্যক অবহিত হতে পারবেন বলে মনে করি।

 

বিএনপি এর বিরোধিতা করছে বলেই এটা করতে হবে এর কোনো যুক্তি নেই। বিষয়টা তো রাজনৈতিক নয়। বিএনপি তো বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরোধিতা করছে না। অন্য কোনো উপযুক্ত স্থানে ভারতীয় এ কোম্পানিকে দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করলেও বিএনপি আপত্তি করবে বলে মনে হয় না। যদি করে, তখনই বলা যাবে তা উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা, তখনই তাকে বলা যাবে অন্ধ ভারত-বিরোধিতা। বিএনপিরও উচিত হবে রামপালে না করে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র কোথায় স্থাপন করলে সুবিধা হবে এবং শর্তে কী কী পরিবর্তন আনতে হবে তা স্পষ্ট করে বলা— শুধু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা নয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে কোনো রাজনীতি নয়। আশা করতে চাই, রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া পরস্পরবিরোধী অবস্থান থেকে ফিরে আসবেন। বেগম খালেদা জিয়া এবং তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি রামপালে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হলে ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের যে বিষয়গুলো চিহ্নিত করেছেন, প্রধানমন্ত্রী তা অনুধাবন করবেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনভিজ্ঞ আমলাদের কথা না শুনে বিষয় বিশেষজ্ঞদের মতামত নেবেন। প্রয়োজনে একটা ওপেন ডিবেটের আয়োজন করবেন। বন, জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশ নিয়ে কাজ করা নির্দেশ বিজ্ঞানী ও গবেষকদেরও তাতে আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। দেশের দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে সর্বসম্মত একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে রামপালের ব্যাপারে চূড়ান্ত পদক্ষেপের কথা ভাবতে পারে সরকার।  তা না হলে ‘রামপালে’ হাসিনা-খালেদার মুখোমুখি অবস্থান পরিস্থিতি জটিল করে তুলতে পারে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর