মঙ্গলবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

টঙ্গী ট্র্যাজেডি : ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

রুপালি, পারভীন, নার্গিসদের কান্না কি কখনো আমরা থামাতে পারব? আমরা কি তাদের আগুনে পোড়া ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারব? পোড়া মাটির অভিশাপে তাদের স্বামীদের মৃতদেহগুলো তারা কি কখনো ফিরে পাবে? নাকি আগুনে পোড়া কয়লাগুলো তাদের জীবনসঙ্গীদের অস্তিত্বের কথা বলবে। এ প্রশ্নের উত্তরগুলো হয়তো কোনো দিনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ কোনো একটি ঘটনা যখন ঘটে তখন সেই ঘটনা সারা দেশকে সাময়িকভাবে নাড়া দিলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা আমরা ভুলে যাই। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এ বিয়োগান্ত ঘটনাগুলো রোধ করার জন্য সে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নেওয়া দরকার তা আমরা কখনো বিবেচনা করি না। ফলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে, দীর্ঘ হয় লাশের সারি, কপাল পোড়া রুপালি, পারভীন, নার্গিসদের মতো নারীদের। যারা তাদের পরিবার নিয়ে সুখের স্বপ্ন দেখছিল, ছেলেমেয়েদের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ যাদের আগামী দিনগুলোকে আশান্বিত করে তুলেছিল। আজ যেন সব মরীচিকা। রোমের সেই অভিশপ্ত আগুন যেন সাম্প্রতিককালে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল রাজধানীর নিকটবর্তী টঙ্গীর বিসিক শিল্পনগরীর টাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড কারখানায়। এরপর ভবন ধসে পড়ে পুরো কারখানা এলাকাটি একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪-এ। অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। এখনো খোঁজ মিলছে না ১১ শ্রমিকের। তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা একমাত্র বিধাতা জানেন। তবে নিরোর মতো এ ধরনের কারখানার মালিকেরা লাভের অর্থ গুনলেও মানুষের নিরাপত্তার কথা তারা কখনো ভাবেন না। এ ক্ষেত্রেও কারখানার মালিকের কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। রানা প্লাজার মতো এই কারখানার মালিককেও আইনের আওতায় আনা জরুরি। ইতিহাসে পাতা ঘাঁটলে দেখা যায়, গাজীপুরের টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরী ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে সেখানে ১৫২টি শিল্প কারখানা রয়েছে। যাদের অধিকাংশের অবকাঠামোগত দিকটি যুগোপযোগী নয়। যে শিল্প কারখানাগুলো বর্তমানে সচল রয়েছে তার মধ্যে অন্তত ৫০টি ভবনে শ্রমিকরা ঝুঁকিপূর্ণভাবে কাজ করছে। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, অধিক মাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণে ৭টি শিল্প কারখানা ইতিমধ্যে পরিত্যক্ত ঘোষিত হয়েছে। ৫৪ বছরের অধিক পুরনো ও জরাজীর্ণ এই কারখানাগুলোয় জীবন-জীবিকার তাগিদে অনেক শ্রমিক জীবন বাজি রেখে কাজ করে চলেছেন, তাদের জীবনেও যে কোনো সময় নেমে আসতে পারে এ-জাতীয় মহাদুর্যোগ। টাম্পাকো ফয়েলসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বিসিকের পক্ষ থেকে আঞ্চলিক পরিচালক শফিকুল আলমকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এ কমিটি টাম্পাকো ছাড়াও শিল্প এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ কারখানাগুলোর বর্তমান অবস্থার বিচার-বিশ্লেষণ করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ দুর্ঘটনা সম্পর্কে অনেকে অনেক মন্তব্য করেছেন। কেউ বলেছেন মালিকের গাফিলতি ও জরাজীর্ণ ভবন, কারও কারও মতে, গ্যাসের পাইপলাইন লিকেজ, বয়লারের প্রযুক্তিগত ত্রুটি, মেয়াদোত্তীর্ণ বয়লারের ব্যবহার, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, দাহ্য ফুয়েল, কেমিক্যালসহ নানা ধরনের কারণ এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

তবে যে যাই বলুক, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছাড়া এ ধরনের ঘটনাগুলো রোধ করা সম্ভব নয়। সময় পরিবর্তিত হয়েছে, টেকনোলজিক্যাল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে গড়ে উঠেছে। শিল্পকারখানাগুলোর প্রকৃতি অনুযায়ী যে ধরনের ভবন নির্মাণ করা দরকার সেই প্রযুক্তিগত ভিন্নতার বিষয়টি আমরা শিল্পকারখানা নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করছি না। আধুনিক অগ্নিনিরোধক যন্ত্র ব্যবহার করে শিল্পকারখানাগুলো সুফল পেতে পারে। সরকারের উদ্যোগে ফায়ার ফাইটিংসহ নিরাপত্তার বিষয়টিতে জোর দেওয়া হলেও এ বিষয়ে সচেতনতার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। শিল্পকারখানা ও শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে দেশে প্রচলিত, শিল্পকারখানা ও শ্রম আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ সম্ভব হচ্ছে না। কারখানা ও শ্রমসংক্রান্ত এ আইনগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন করা দরকার। এখানে একটি বিষয় ভাবা যেতে পারে, আমাদের দেশে ডুয়েট, বুয়েট, কুয়েট, রুয়েট, চুয়েটসহ যেসব প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, সচেতনতা ও  গবেষণার ক্ষেত্রে কাজ করে চলেছে; উন্নত বিশ্বের মতো প্রতিটি শিল্পকারখানাকে এই বিশ্ববিদ্যালয়-গুলোর সঙ্গে আইন করে সম্পৃক্ত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের ভবন  নির্মাণ, নিরাপত্তা, পণ্যের গুণগতমান উন্নয়নসহ বিশেষায়িত পরামর্শ প্রদান ও গবেষণা কার্যক্রম চালাবে। বিনিময়ে গবেষণার অর্থের জোগান দেবে এই শিল্পকারখানাগুলো। এতে শিল্প-কারখানাগুলো যেমন উপকৃত হবে, তেমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণার মাধ্যমে উন্নত রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা রাখবে। শিল্পকারখানাগুলোয় যে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার আগেই আমাদের তা প্রতিরোধের বিষয়টি ভাবতে হবে। যে ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে তা ভেঙে ফেলে আধুনিক প্রযুক্তিগত ধারণা প্রয়োগ করে ভবনগুলো নির্মাণ করতে হবে, যেখানে বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে। যে সময়ে ভবনগুলো নির্মিত হবে সেই সময়ে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ অথবা বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার ক্ষুণ্ন না হয়। আমরা আর শ্রমজীবী মানুষের লাশের মিছিল দেখতে চাই না, আমরা গাইতে চাই জীবনের জয়গান।

লেখক : রেজিস্ট্রার ও বিভাগীয় প্রধান ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট) গাজীপুর

সর্বশেষ খবর